Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার দুই সঙ্গী

বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবদান অনেক

বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিক্রমাটি বিস্ময়কর। শুরুতে ‘তলাহীন ঝুড়ি’র ৯০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের দিন কাটত ঝড়-বন্যা, কলেরা, হাম, গুটিবসন্তের ভয়ে। ৫০ বছর পেরোনোর আগেই অনুন্নত দেশের গ্লানি ঘুচিয়ে সে দেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

প্রচলিত উন্নয়নতত্ত্বে এ অগ্রগতির বিশ্লেষণ মেলে না। তেমনি মেলে না যে দেশে প্রতিষ্ঠান গড়তে গড়তেই ভেঙে পড়ে, সেখানে ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া ব্র্যাকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবনী উন্নয়ন সংগঠন হয়ে ওঠার সমীকরণও। এই দুই অসম্ভব যে সম্ভব হয়েছে, এ কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। দেশের উন্নয়নযাত্রায় ব্র্যাকের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমদায়িত্ববোধ নিয়ে অংশগ্রহণ উন্নয়নে এনেছে গতি আর ব্র্যাককে দিয়েছে বড় হওয়ার অভিপ্রায়।

বাংলাদেশের উন্নয়নধারা আর দশটা দেশের মতো নয়। একটা বড় পার্থক্য হলো, এ দেশের উন্নয়নযাত্রায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থসামাজিক উন্নয়নের সাধারণ একটা ধারা ছিল অবকাঠামো ও শিল্পে বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগের সিংহভাগই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিবেচনা। জার্মানি, জাপান, প্রায় পুরো ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা ফিলিপাইন—সব ক্ষেত্রেই মোটামুটি একই ছাঁচ। তবে ভারতবর্ষ এ বিনিয়োগের কোনো হিস্যা পায়নি। উল্টো ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়ার সময়ও রক্তস্নানের ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল অনৈক্য, সাম্প্রদায়িকতা, ধনিকতন্ত্র আর বিপুল দারিদ্র্য।

এরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলে ভারতে শুরু হয় সরকারবিরোধী রক্তক্ষয়ী নকশাল আন্দোলন। তাতে যোগ দিল শিক্ষিত যুবকেরা। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে বাংলাদেশে শুরু হলো মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গেই শুরু হলো অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন।

সরকারের বাইরে থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের পুরোভাগে এগিয়ে এলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো উচ্চশিক্ষিত যুবকেরা। গড়ে তুললেন উন্নয়ন সংগঠন। এসব সংগঠনে, যা এখন এনজিও নামেই বেশি পরিচিত, যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত তরুণ-তরুণী। মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণের ভিত্তি তৈরি করেছিল।

এ কারণেই বহু রাজনৈতিক উত্থান-পতন, অপবাদ বা রাজনীতিকীকরণের চেষ্টা—কোনোটাই এনজিওদের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। একই কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একনিষ্ঠ সমর্থক ছাড়া অন্য কোনো ভাবধারার সংগঠনের অনুপ্রবেশ এনজিওদের মূলধারায় ঘটেনি।

বাংলাদেশের উন্নয়নে ব্র্যাকের মতো দেশি এনজিওদের আরেকটি প্রবণতা হলো তারা তত্ত্বনির্ভর নয়, নিরীক্ষানির্ভর। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি এনজিওরা তত্ত্বে বিশ্বাসী। তারা একবার অবকাঠামো উন্নয়নের বিগ পুশ, আবার উদার অর্থনীতি, কখনো–বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, এমনি নিত্যনতুন নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে উন্নয়নকে দেখতে অভ্যস্ত।

অন্যদিকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাথরিন লেভেল তাঁর ব্রেকিং দ্য সাইকেল অব পভার্টি বইটি লিখতে গিয়ে দারিদ্র্য নিরসন বিষয়ে ব্র্যাকের লিখিত কোনো তত্ত্বই খুঁজে পাননি, বদলে যা পেলেন, তা হলো কিছু নীতি। সেসব নীতিও আবার ব্র্যাকের সফলতা-ব্যর্থতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্যাসমাত্র। এসব নীতিকে ব্র্যাকের ডিএনএ বলা যায়, তবে সে ডিএনএ বিকাশমান।

ব্র্যাক তাত্ত্বিক আলোচনায় অংশ নিয়েছে, কিন্তু তত্ত্বমন্ত্রে বাধা পড়েনি। যেটুকু ভালো মনে করেছে গ্রহণ করেছে, বাকিটা নির্দ্বিধায় বর্জন করেছে। দরিদ্র জনগণের মতামতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তারা। তাদের তত্ত্বাবধানেই নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। বৈশ্বিক তত্ত্ব আর নিজের সফলতা ও ব্যর্থতা থেকে প্রতিনিয়ত শিখছে ব্র্যাক।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাককে বলতেন বড় একটা পরীক্ষাগার। ফলে ব্র্যাকের উদ্যোগ বরাবরই থেকেছে প্রাসঙ্গিক। সরকারও বিদেশি সহায়তার ঘেরাটোপে থেকে, কখনো–বা দাতাদের মধ্যস্থতায়, যখনই পেরেছে এসব উদ্যোগকে আপন করে নিয়েছে।

খাবার স্যালাইন প্রচলনের জন্য ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ করেছে সরকার, কখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া রোধে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে ব্র্যাককে, কখনোবা দিয়েছে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজ। যক্ষ্মা নির্মূল কার্যক্রমে ব্র্যাককেই বানিয়েছে বৃহত্তম সহযোগী। এ ছাড়া উপপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতি, কিশোরী ক্লাব, কখনোবা মাঠ-কর্মকর্তাদের হাত ধরে ব্র্যাকের পুরো কার্যক্রমকে আপন করে নিয়েছে।

উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি মেলবন্ধনের আরেকটি ক্ষেত্র হলো নারীর অংশগ্রহণ। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সাম্য বিধানে ব্র্যাক বরাবরই কাজ করে গেছে। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থান ছিল। তাই বেছে বেছে তাঁরাই ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পদে গেছেন, যাঁরা নারীর ক্ষমতায়ন ও সাম্যে বিশ্বাসী। আমি বলছি না যে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে।

বরং স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর ৮০তম জন্মদিনে নারী-পুরুষের অসাম্যকেই তাঁর সবচেয়ে বড় আক্ষেপ বলে গেছেন। তবে উন্নতি যে হয়েছে, সেটা মাপার জন্য জাতিসংঘ কি বিশ্বব্যাংকের সূচকের প্রয়োজন হয় না, বাংলাদেশের সব উন্নয়নকর্মীই এ ব্যাপারে একমত। ব্র্যাকের মতো এনজিওদের অগ্রণী ভূমিকায় উন্নয়নে নারীসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও বিশেষ করে পাকিস্তানের উন্নয়নের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দীর উন্নয়নযাত্রায় এনজিওদের যে অবদান, তা কি আগামী দিনেও আকারে-প্রকারে একই থাকবে? আমার তা মনে হয় না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘হোয়াট গেটস ইউ হেয়ার, উইল নট টেক ইউ দেয়ার’—নতুন গন্তব্যের যাত্রাপথ নতুনই হবে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরোনো বাংলাদেশের সামনে নারী-পুরুষের সাম্য, দারিদ্র্য বিমোচনের মতো পুরোনো সব সমস্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে কর্মসংস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুতির মতো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

এই নতুন উন্নয়নযাত্রায় নতুন পথে, নতুন সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের রূপরেখা খুঁজে নেওয়ার সময় মনে রাখতে হবে, অংশীদারত্বের মূল ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা যেন ঠিক থাকে। তা না হলে, যে বিস্ময়যাত্রা পার হয়ে আমরা এত দূর এসেছি, সে যাত্রা থেকে বিস্ময়টাই হয়তো হারিয়ে যাবে।

কে এ এম মোরশেদ: ঊর্ধ্বতন পরিচালক, ব্র্যাক