গদ্যকার্টুন

বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা

অসংখ্য পাখি মরে মাঠে পড়ে আছে
অসংখ্য পাখি মরে মাঠে পড়ে আছে

নড়াইলের কালিয়ায় ঝড়ে–বৃষ্টিতে হাজারো পাখি মরে মাঠে পড়ে আছে। সবুজ মাঠ পাখিদের লাশে সাদা হয়ে গেছে। যেন তুষারে ঢেকে গেছে বাংলার প্রান্তর। আসুন, পাখিদের জন্য শোক করি।
তারপর সাহিত্যালোচনা করি।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছয় শব্দের একটা গল্পকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র গল্প বলা হয়।
আমার অনুবাদে গল্পটা এ রকম:
বিক্রির জন্য:
শিশুর জুতা। একেবারে অব্যবহৃত।
হোর্হে লুইস বোর্হেসের একটা সাত লাইনের গল্প আছে। অনুবাদ করে দিচ্ছি।
স্বপ্ন
ইরানের এক মরুভূমিতে এক অনুচ্চ টাওয়ার, তার নেই কোনো দরজা–জানালা। তাতে একটা মাত্র রুম (মেঝে গোলাকার আর নোংরা), তাতে একটা মাত্র টেবিল আর বেঞ্চি। সেই বৃত্তাকার সেলে আমার মতো দেখতে একটা লোক অবোধ্য অক্ষরে লিখছে একটা দীর্ঘ কবিতা—কবিতাটা সে লিখছে একটা লোককে নিয়ে, যে একটা গোলাকার সেলে আরেকজন লোককে নিয়ে আরেকটা কবিতা লিখছে, যাতে আরেকটা লোক আরেকটা গোলাকার সেলে আরেকজন লোককে নিয়ে লিখছে কবিতা, যাতে আরেকটা লোক... এই প্রক্রিয়া কখনো শেষ হবে না, আর কেউ জানতে পারবে না বন্দী কী লেখে।

আবু সাঈদ ১০০ শব্দের ১০০টা গল্প নিয়ে বই বের করেন। শত কথার শত গল্প। এবার বেরিয়েছে তার দ্বিতীয় সংখ্যা। তাতে আমি একটা গল্প লিখেছি। গল্পটা হলো:
বাগদত্তা
আনিসুল হক
১০০ শব্দের গল্প দেন।
সাধনা ছাড়া হয় না।

করেন সাধনা।
চোখ বন্ধ করলাম। এক দিন, দুই দিন বন্ধ, ২৩ দিন চোখ বন্ধ।
লিখলাম:

মেয়েটি ডায়াল করল। ছেলেটার ভয়েস শোনা গেল: ‘আমি আপনার কল ধরতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমিই আপনাকে কলব্যাক করব।’
মেয়েটা রোজ ফোন করে। রোজ এই রেকর্ডেড ভয়েসটাই শোনে।
ডুবে যাওয়া লঞ্চের ভেতর থেকে সেই ফিরতি কলটা কোনো দিনও আসে না।

ভালো হয় নাই। আরেকটা লেখেন।
ডিলিট করলাম। চোখ বন্ধ। ২৩ মাস পর চোখ খুললাম। বললাম, নাও।
‘গোসলের সময় মুর্দার আঙুল থেকে আংটি খুলে নিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাওনা অনাদায়ি রেখে দাফন তো করা যায় না।’
ফাল্গুন মাস। বাইরে আষাঢ় মাসের মতো বৃষ্টি। মাঘ মাসে ফ্যান ছেড়ে ঘুমাতে হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন আর গল্প নয়। এটা ভীষণ এক বাস্তবতা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, পাঁচ বছর আগে এটা সবাই হাসি–ঠাট্টামূলক কল্পনা ভাবত, এটা এখন বাস্তবতা। দ্বিতীয় মেয়াদেও হয়তো ট্রাম্প আসবেন। মোদি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বাস্তবতা। ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এইটাও বাস্তবতা। কোনটা যে বাস্তবতা, কোনটা পরাবাস্তবতা, কোনটা জাদুবাস্তবতা কিছুই বুঝছি না।
সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতায় একটা চেষ্টা ছিল মানুষের অবচেতনকে ধরার। স্বপ্নে সে কী ভাবে, আধো–তন্দ্রায় তার মনে কী খেলা করে, সেটা ক্যানভাসে কিংবা কবিতায় ধরে রাখার। আর জাদুবাস্তবতায় বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায় ম্যাজিক্যাল উপাদান, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখায় আমরা দেখি, একটা ছেলে যা–ই স্পর্শ করে, তার রং পাল্টে যায়। তার দাদি বলেন, নিশ্চয়ই তুই প্রেমে পড়েছিস। প্রেমে পড়লেই কেবল এই রকম হয়, স্পর্শমাত্র জিনিসপত্র রং পাল্টাতে থাকে। কিংবা একটা জনপদে সবাই ঘুমুতে থাকে, সবাই সবকিছু ভুলে যেতে থাকে; গরুর গায়ে শেষে লিখে রাখে, এ হলো গরু, এটা দুধ দেয়, এই দুধ থেকে কফি বানানো যায়।
বাংলাদেশে আমরা আর বুঝতে পারি না কোনটা বাস্তবতা, কোনটা কল্পনা, কোনটা পরাবাস্তবতা, কোনটা জাদুবাস্তবতা।
চকবাজারে আগুন লাগে, রাস্তায় আগুনের নদী বয়ে যায়।
দোলা আর বৃষ্টি। একজন পড়েন গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে, আরেকজন পড়েন ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। আবৃত্তি করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলার মঞ্চে আবৃত্তি করে তাঁরা রিকশা নিয়ে যাচ্ছেন পুরান ঢাকার দিকে। ওখানেই দুই জায়গায় দুজনের বাড়ি। তাঁরা কি চকবাজারের সেই আগুনমুখা গলির দিকে গিয়েছিলেন?
সিসিটিভিতে দেখা গেছে, তাঁরা রিকশায় বসে হাসছেন, কথা বলছেন। তারপর আর নেই।
বৃষ্টির মা বিলাপ করেন। তিনি তাঁর মেয়েটাকে একটা কাপড় দিতে চান। সাদা কাপড়। কাফনের কাপড়। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে কি এত গরিব বানিয়েছেন যে মেয়েটাকে কাফনের কাপড়টুকুও দিতে পারলাম না? সে পুড়ে গেল!’
দোলার বাবা মানেন না যে দোলা আর আসবে না। তিনি মনে করেন, ওই সিসিটিভির পরের দৃশ্য তো দেখা যায় নাই। ওরা তো দৌড়ে কোথাও গিয়ে আশ্রয়ও নিতে পারে। দোলা আছে। দোলা ফিরে আসবে...তাঁরা অপেক্ষা করেন। আমরাও প্রার্থনা করি, দোলা ফিরে আসুক তাঁর মা–বাবার কোলে। বৃষ্টি ফিরে আসুক তাঁর মা-বাবার কাছে।
কিন্তু এক বাস্তবতায় মন বসাতে না–বসাতে আরেক বাস্তবতা আমাদের পরাবাস্তব করে তোলে।
বিমান হাইজ্যাকের খবর আসে। ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। খবর আসে। ছিনতাইকারী দুটো গুলি করেছে। খবর আসে। ছিনতাইকারী মারা গেছে। খবর আসে। পিস্তলটা ছিল খেলনা, খবর আসে। বোমা ছিল না, ছিল বোমাসদৃশ জিনিস। খবর আসে।
এরপর গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস টাইম মেশিনে ফিরে আসেন এ কথা লিখতে যে একজন ব্যর্থ প্রেমিক একটা সত্যিকারের পিস্তল হাতে একটা কাগজের প্লেন হাইজ্যাক করেছে। আর তা দেখে শিলাবৃষ্টির সময় নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পানিপাড়া গ্রামের অরুণিমা ইকোপার্কসহ রিসোর্ট গলফ ক্লাবের বিভিন্ন গাছে আশ্রয় নেওয়া বক ও নানা প্রজাতির হাজার হাজার পাখি মরে পড়ে থাকে।
সিটি করপোরেশনের ভোট শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়।
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক