বিজয়বর্গীয়র চিড়া উপাখ্যান

চিড়া আজও বাঙালিদের প্রিয় খাদ্য। শুধু বাঙালি কেন, এখন অবাঙালিরাও খাচ্ছেন এই চিড়া। দই–চিড়া। এই চিড়া থেকে কতই না খাবার তৈরি হয় এখন। চিড়ার পোলাও, চিড়ার পায়েস, ক্ষীর চিড়া, চিড়া পটোল, চিড়ার পুলি, চিড়ার মোয়া, চিড়া-বাদামের মোয়া, চিড়ার খাজা, আর সেই চিড়া-নারকেল গুড় বা চিনি, আরও কত–কী! চিড়া-মুড়ি আর দুধ–কলাও বাঙালিদের আরেকটি প্রিয় খাবার। আর চিড়া-বাদামের তো কথাই নেই। এক কাপ চায়ের সঙ্গে বিকেলে বা সন্ধ্যায় চিড়া-বাদাম অনেকের প্রিয়। 

তাই চিড়া এখন আর শুধু বাঙালিদের হৃদয় জয় করেনি, জয় করেছে অবাঙালিদের হৃদয়ও। আর বাংলাদেশিদের তো কথাই নেই। তাদের প্রিয় খাবার এই চিড়া বা দই–চিড়া। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষেও খাওয়ানো হয় এই দই–চিড়া। ভারতের হিন্দি বলয়ের বহু রাজ্যে এখনো চিড়া জনপ্রিয়। ওখানে তো চিড়া দিয়ে তৈরি পোহা দারুণ জনপ্রিয়। তবে দক্ষিণ ভারতে তেমনটা নয়। দক্ষিণ ভারতের প্রিয় খাবার ইডলি, ধোসা আর বড়া। মাষকলাই থেকে তৈরি এসব খাবার। ভোরের নাশতাও চলে এই ইডলি-ধোসা আর বড়া দিয়ে। তবে বাঙালি এলাকায় লুচি-পুরির সঙ্গে এখনো প্রিয় দই–চিড়া। 

সম্প্রতি বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় চিড়া খাওয়া নিয়ে এক মন্তব্য করে দেশজুড়ে ঝড় তুলেছেন। 

বিজয়বর্গীয় ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ইন্দোরের বাসিন্দা। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা। ছিলেন ইন্দোরের মেয়র।  মধ্যপ্রদেশের বিধানসভার বিধায়ক হয়েছেন ছয়বার। মধ্যপ্রদেশ রাজ্য সরকারের মন্ত্রী ছিলেন ১২ বছর। সেই বিজয়বর্গীয় মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সিএএর পক্ষে মিছিল করে এক সমাবেশে মন্তব্য করেছিলেন, চিড়া খায় অনুপ্রবেশকারীরা। গোটা দেশে অনুপ্রবেশকারীরা কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তারই উদাহরণ দিতে গিয়ে বিজেপির এই নেতা ওই মন্তব্য করেন। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ওই সমাবেশে বিজয়বর্গীয় বলেছিলেন, ‘আমার বসতভূমিতে আমি নতুন একটি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিই। সেখানে যেসব শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রি কাজ করছেন, তাঁদের দেখতাম ওঁরা চিড়া খাচ্ছেন। আর তখনই আমি বুঝতে পারি, ওঁরা অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে এসেছেন।’ 

ব্যস, বিজয়বর্গীয়র এই মন্তব্যে গোটা দেশেই ঝড় ওঠে। বিতর্ক শুরু হয় চিড়া কি শুধু অনুপ্রবেশকারীরা খান? তাঁদেরই খাদ্য? ভারতের অন্য রাজ্যের কেউ খায় না? যদিও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রিয় খাবার এই চিড়া। শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশেরও অন্যতম খাবার এই চিড়া। সেখানে আরও বেশি চলছে চিড়া দিয়ে তৈরি পোহা। এ ছাড়া ভারতের বহু রাজ্য, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের বহু মানুষ এখনো দই–চিড়া খায়। আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, বিহার, ছত্তিশগড় ও উত্তর প্রদেশের বহু এলাকায় চিড়া-মাঠা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। সুতরাং চিড়া অনুপ্রবেশকারীরা খান এ কথা মানছে না ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ। তাই বিজয়বর্গীয়র এই মন্তব্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ঝড় ওঠে। বিতর্ক শুরু হয়। ২৮ জানুয়ারি কলকাতা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমিও চিড়া খাই। চিড়া খেতে ভালোবাসি।’ 

এদিকে চিড়া নিয়ে বিজয়বর্গীয়র মন্তব্য মেনে নেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কলকাতার নেতাজি ইন্দোর স্টেডিয়ামে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এক সমাবেশে সম্প্রতি বলেছেন, ‘দেশে এখন কারা চিড়া খাবে, তা–ও ঠিক করবে বিজেপি? চিড়া খেলে নাকি চেনা যায় মানুষকে। জীবনে এ কথা শুনিনি। পোশাক দেখেও নাকি চেনা যায়! সে কথাও শুনিনি। এ মাটি ভাগাভাগির মাটি নয়। আর আমরাও ক্রীতদাস নই। আমরা ভারতের নাগরিক। তাই তো বলছি, ওরা সিএএ পাস করিয়ে যে “অভিনন্দনযাত্রা” করছে, তা তো অভিনন্দনযাত্রা নয়, বিসর্জনযাত্রা!’

বাঙালিদের প্রিয় খাবার চিড়া। তাই ওই সব রাজ্যে বাঙালিরা কাজ করতে গেলে কি বলা হবে ওরা অনুপ্রবেশকারী? ওদের গায়ে কি লেখা রয়েছে ওরা অনুপ্রবেশকারী। ওরা তো এই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বাইরে কাজ করতে গেলে এবং বাংলা ভাষায় কথা বললেই ওরা হয়ে যায় অনুপ্রবেশকারী? 


অমর সাহা প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি