Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের অসম বণ্টন

এএফপি প্রতীকী ছবি।

মিলন (ছদ্মনাম) একটি নিয়োগ পরীক্ষার ভাইবা দিতে গেল। সে নড়াইলের ছেলে। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে রাজধানী ঢাকা জেলা থেকে ৬৩তম জেলা নড়াইল কত বছর পিছিয়ে? মিলন কী উত্তর দেবেন? 

আসুন আমরা উত্তর খুঁজি।  

২. 
তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ছিল ইন্টারনেট দিয়ে। ইদানীং আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলোচনা করছি, বিভিন্ন পরীক্ষা এবং ভাইবাতে এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হট টপিক! আর একটা খুব সাধারণ কথা আমরা বলি তা হচ্ছে, আমরা আমেরিকা থেকে ১০০ বছর পিছিয়ে। এই ১০০ বছর কিন্তু সম্পূর্ণ বাংলাদেশ পিছিয়ে না। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব শুরু ১৯৬৯ সালে। বাংলাদেশে ভিস্যাট দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু ১৯৯৬ সালে। তার মানে বাংলাদেশ তৃতীয় শিল্পবিপ্লব বা ইন্টারনেটের সুযোগ থেকে কমবেশি মাত্র ২৭ বছর পেছনে। এখন প্রত্যেকে যার যার জেলা শহরে কত সালে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এসেছে, হিসাব করুন আর বের করুন আপনার শহর তৃতীয় শিল্পবিপ্লব থেকে কত বছর পিছিয়ে। পেশাদার কাজে মোবাইল ইন্টারনেটকে আমি আলোচনার বাইরে রাখছি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রামের বাইরে খুব কম জেলা শহরেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছেছে, ইউনিয়ন বা গ্রাম আরও দূরে। ঢাকা জেলার সবগুলো গ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গিয়েছে কি? না, যায়নি। যাঁরা ঢাকার আশপাশে বেড়াতে যান বা সেখানে থাকেন, তাঁরা ব্যাপারটি জানেন। 

শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের লভ্যতার এই তারতম্য খুব বেশি চোখে পড়ার মতো। বাংলা লায়ন এবং কিউবি ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবা ঢাকার বাইরে বেশ কিছু শহরে নিয়ে গেলেও এখন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে প্রায়। অন্যদিকে সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার টেনে নেওয়ার প্রকল্প খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। প্রোগ্রামিং ছাড়াও অসংখ্য ইন্টারনেটভিত্তিক চাকরির সুযোগ আছে, যা দেশের যেকোনো প্রান্তে বসে যে কেউ করতে পারে। তার জন্য দরকার দ্রুতগতির ইন্টারনেট। আর এই সেবা দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছানো খুবই জরুরি। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রযুক্তির অসম বণ্টন আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে অনেক বেশি। আগামী দিনগুলোতে প্রযুক্তি পণ্য (সফটওয়্যার) এবং প্রযুক্তিভিত্তিক ভার্চু্যয়াল সেবাই হবে রপ্তানি বাণিজ্যের মূল হাতিয়ার আর তার জন্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দ্রুত পৌঁছানো খুবই জরুরি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একটা গ্রামে পাকা রাস্তা আর দ্রুতগতির ইন্টারনেট সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত। 

৩. 
ইন্টারনেট হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম, যা ব্যবহার করে পেশাদার কাজ করার জন্য বড় কারখানা লাগে না বা অনেক লোকবলও লাগে না। একটা কম্পিউটার বা ল্যাপটপ হলেই চলে। কিন্তু আমরা দেখছি ঢাকায় থাকার কারণে একজন যে সুবিধা পাচ্ছেন, গ্রামে বসে আরেকজন সেই একই সুবিধা পাচ্ছেন না। আসলে কিছুই তিনি পাচ্ছেন না। আমরা নিয়োগপ্রত্যাশী মিলনের শহর নড়াইলের কথা বিবেচনা করতে পারি। নড়াইলের আশপাশে গোপালগঞ্জ এবং যশোরে একটি করে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। মিলনের চার বন্ধু যদি গোপালগঞ্জ বা যশোরের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ইন্টারনেটভিত্তিক কাজ নড়াইলে বসে করতে চান, তাহলে তাঁরা সেটি পারবেন না। কিন্তু মিলনের অন্য চার বন্ধু ঢাকায় এসে বা ঢাকায় থেকে কাজটি করতে পারছেন। তার মানে মিলনের নড়াইলের চার বন্ধু শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছেন। আরও সহজভাবে চিন্তা করলে ঢাকার বাইরে গোপালগঞ্জ বা যশোরের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করলেও পড়া শেষে সবাই আবার ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে! আমরা গ্রামে ডাক্তার পাঠাতে চাই ‘জোর’ করে, কিন্তু গ্রামে আমরা ইঞ্জিনিয়ার পাঠাতে চাই না কেন? 

৪. 
মিলন ইন্টারনেট ব্যবহার শিখেছেন ২০০২ সালে, তখন তিনি ইন্টারনেটে যা দেখতেন, তা–ই বিশ্বাস করতেন। দীর্ঘদিন ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে তিনি শিখেছেন এখন ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্য অবশ্যই যাচাই করে নেওয়া উচিত। মিলনের শাশুড়ি থাকেন নড়াইল জেলা শহরে, তিনি সম্প্রতি স্মার্টফোন ব্যবহার করা শিখেছেন এবং ইন্টারনেটে (মোবাইল ইন্টারনেটে ফেসবুক) যা দেখেন তা–ই বিশ্বাস করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের পাশাপাশি নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার শিখতে মিলনের প্রায় এক দশক চলে গেছে, মিলন আশাবাদী যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এক দশক পার হলে তাঁর শাশুড়িও নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে শিখে যাবেন! মিলনের ছোট চাচা থাকেন গ্রামে। তিনি মাঝেমধ্যে মিলনের কাছ থেকে কীভাবে ইন্টারনেটে ফেসবুক চালাবেন, সেই বিষয়ে পরামর্শ নেন। মিলনের চাচাতো ভাই গ্রামে বসে ইউটিউব থেকে ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে ওয়েব ডিজাইন শেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মোবাইল ইন্টারনেটের অনেক দাম আর দ্রুত মেগাবাইট শেষ হয়ে যায়। মিলন ঢাকাতে দ্রুত গতির আনলিমিটেড ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করেন আর তাঁর চাচাতো ভাই প্রতিদিন মেগাবাইট কেনেন! মিলন তাঁর চাচাতো ভাইকে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত, গ্রামে বসে মোবাইল ইন্টারনেটের এমবি দিয়ে কিছু হবে না। 

৫. 
একদিন আমাদের পদ্মা সেতু হবে। প্রতিবার নড়াইল থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকায় ফেরার সময় মিলন চিন্তা করেন, সেতুটা শেষ হলেই চার ঘণ্টায় তিনি ঢাকা থেকে নড়াইল যেতে পারবেন। চাকরিটা যদি না হয় আর ২০২০ সালে যদি নড়াইলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়, তাহলে তিনি নড়াইলে ফিরে যাবেন। সেখানে বসে ইন্টারনেটভিত্তিক ফ্রিল্যান্স কাজ করবেন আর তাঁর স্বপ্নের প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নড়াইলেই শুরু করবেন। 

মিলন কি পারবে গ্রামের বাড়িতে জানালার পাশে বসে পাখির ডাক শুনতে শুনতে ল্যাপটপ দিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেট মার্কেটিংয়ের কাজ করতে? আর তাঁর চাচা তাঁদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁক দেবে, ‘কি বাবা গ্রামে বসে ভালোই তো ডলার কামাচ্ছ, এবার বিয়েশাদিটা সাইরে ফেলো!’

সবুজ কুন্ডু তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা কোড বক্সার