
পোড়া মাটিতে বসতি গড়া যায়, কিন্তু ফসল ফলানো যায় না। তেমনি উন্নয়নের অবকাঠামোয় দেশের চেহারায় দৃশ্যমান বদল ঘটানো গেলেও ভেতরের ঘুণ মেরামতে দরকার রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় ‘শুদ্ধিকরণ’। মানুষ প্রথমেই ভাবে খাবারের কথা, তারপর করে শোয়ার চিন্তা। পেটে খিদে থাকলে আলো ঝলমল শহরের অট্টালিকার শানশওকত কিংবা কৃষিজমি ভেদ করে, খাল-বিল বুজিয়ে, বনভূমি উজাড় করে চলে যাওয়া ঝা চকচকে হাইওয়ের দেখনদারি—সবই ‘গরুর রচনা’। মানে চোখের দেখা মনে পশে না, খিদের আগুনই একমাত্র ‘সত্য’ হয়ে থাকে তার কাছে। অনাহারী মানুষের এই করুণ দশা উন্নয়নের খতিয়ানে চাপা দেওয়া যায় না, ধাঁ ধাঁ করে বাড়তে থাকা মাথাপিছু আয়ের অঙ্কেও মেলানো সম্ভব নয়।
২.
বেড়া পোক্ত না করে ফসলের ঘাটতির দায় গরুর ওপর চাপানোও সেই ঘুরেফিরে ‘গরুর রচনা’। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সেই মহতী উচ্চারণ ‘চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না’ দেশের মানুষের কানে এখনো বাজে! এরপরও যদি খেলাপি ঋণের রেকর্ড না হয়, দু-চারজন পি কে হালদার, শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুল বা মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের জন্ম না হয়, সাহেদ-মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুদের সিন্ডিকেট তৈরি না হয়, পাপিয়া-সম্রাটদের গং গড়ে না ওঠে, এনু-রুপন বা রুবেল-বরকত ভ্রাতৃদ্বয়দের উত্থান না ঘটে, তাহলে তা রাজনৈতিক রেওয়াজের ‘বরখেলাপ’, লুটেরা সংস্কৃতির ওপর আঘাত! আবুল মাল আবদুল মুহিতের উত্তরসূরি আ হ ম মুস্তফা কামালেরও তাই জানার কথা নয়, কীভাবে দেশ থেকে লোপাট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
গত বুধবার নটর ডেমের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর আবার সড়কে শিক্ষার্থীরা। এর কয়েক দিন আগে থেকে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে সরব ছিল তারা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় ভাড়া বেশি বাড়ানোর পরও বাসমালিকেরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে নারাজ। এখানেও সেই ‘গরুর রচনা’। দাবিদাওয়া ন্যায্য, সরকারও ‘আন্তরিক’, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় সেই হচ্ছে-হবে।
অথচ জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড, ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) ইত্যাদি সংস্থা জানে। গত বছরের মার্চে প্রকাশিত জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবার সুইস ব্যাংকে গর্বিত কিছু বাংলাদেশির লাখো কোটি ডলার রাখার বিষয়টি সামনে আসে। কানাডার ‘বেগম পাড়া’সহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে-শহরে কত শত ধনকুবের দ্বিতীয় আবাস গড়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সঞ্চয় গোছাচ্ছেন, তা দেশের অক্ষরজ্ঞানহীন জনগোষ্ঠীরও তা আর অজানা নয়। জানে না কেবল সরকার, সরকারের মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
বেড়ায় ফাঁকফোকর রেখে ফসল উৎপাদনের রেকর্ড হয় না, ফসল লোপাটের বসন্তকাল জারি থাকে। নতুন করে তাই গরিব হবে লাখো মানুষ, খিদে পেটে ক্লান্ত গতরে রাত পার করবে তারা, কিন্তু তাদের ‘দিন’ কখনো আসবে না।
৩.
দুই সতীর্থকে হারিয়ে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের মূল দাবি ছিল, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে চালকের মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রণয়ন করা। সরকার তড়িঘড়ি ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। এর প্রায় এক বছর পর তা কার্যকরের ঘোষণা আসে। অগ্রগতি বলতে এটুকুই। এরপর পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের ধর্মঘটে অচল দেশ। সরকারের তরফে আইন সংশোধনের আশ্বাস। এই সংশোধনের ব্যাপ্তি এতটাই যে ২৯টি ধারা ঘষামাজার সুপারিশ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি ছিল আরও বেশি, ৩৪টি ধারার সংশোধন।
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৩০ দফা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে, তার খোঁজ কেউ না জানলেও সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও হতাহতের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আমাদের সামনে। পুলিশের হিসাবেই চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৩ হাজার ৭০১টি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৩ হাজার ৫০২। গত বছর করোনা পরিস্থিতিতে গাড়িঘোড়া সীমিত সংখ্যায় চললেও চালকদের বেপরোয়া গাড়িচালনা ‘লাগামহীন’ ছিল। এ বছরও ৪ হাজার ১৯৮টি দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণ যায় ৩ হাজার ৯১৮ জনের। এর আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৯ ও ২০১৮ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪ হাজার ১৪৭ ও ৪ হাজার ১৩৮ এবং ২ হাজার ৬২৯ ও ২ হাজার ৬৩৫।
গত বুধবার নটর ডেমের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর আবার সড়কে শিক্ষার্থীরা। এর কয়েক দিন আগে থেকে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে সরব ছিল তারা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় ভাড়া বেশি বাড়ানোর পরও বাসমালিকেরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে নারাজ। এখানেও সেই ‘গরুর রচনা’। দাবিদাওয়া ন্যায্য, সরকারও ‘আন্তরিক’, কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় সেই হচ্ছে-হবে। হররোজ সড়কের কালো পিচ ‘রাঙা’ হচ্ছে সাধারণ মানুষের রক্তে, অথচ কারও কোনো বিকার নেই! এভাবে দিনের পর দিন প্রাণহানি ঘটতে দেওয়া কি ব্যবস্থাগত অনুমোদনের শামিল নয়? অনেকেই একে ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেন।
সংসদে বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা শিক্ষার্থীদের বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবি কার্যকর চান। তিনি বলেন, সরকার বলে বেসরকারি গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের নেই। কথাটি সঠিক বা সত্য নয়। জবাবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে একটি সত্য কথা বলতে চাই। এখানে অনেক সমস্যা আছে। যখন চেয়ারে বসবেন, অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হবে। একটা চ্যালেঞ্জিং জব। এখানে আমরা কিছু কিছু বিষয় অ্যাডজাস্ট করি।’ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মহান সংসদে দাঁড়িয়ে কার বা কাদের সঙ্গে ‘অ্যাডজাস্ট’ করার কথা বললেন, তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন, কিন্তু একবারের জন্যও কি তাঁর মনে হলো না জনগণের জন্যই তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে? ‘অ্যাডজাস্ট’ যা করা দরকার, তা কেবল জনগণের সঙ্গেই করতে পারেন একজন জনপ্রতিনিধি, কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে নয়।
কোনো কিছুর ভেতর ফোঁপরা থাকলে খোসা বদলে সাময়িক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতে পারে, জিনিসটির গুণমানের কোনো উন্নতি হয় না। এভাবে একের পর এক ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে থাকলে উন্নয়নও যখন-তখন ধসে পড়তে পারে!
হাসান ইমাম সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com