Thank you for trying Sticky AMP!!

মানবাধিকার ক্রমেই রাষ্ট্রীয় বিবেচনার বাইরে যাচ্ছে

মানবাধিকার পরিস্থিতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দিন, ক্ষণ, সপ্তাহ, মাস বা বছর হিসাবে মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিমাপ করা তাই কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতেই পারে। মানবাধিকার এমন কোনো বিষয় নয়, যা ১ জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করেই মৌলিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। তবু একটি বছর শেষ হলে যখন নতুন বছরে পদার্পণ করি, অন্য অনেক কিছুর মতো মানবাধিকার পরিস্থিতি সবেমাত্র বিগত হয়ে যাওয়া বছরে কেমন ছিল—তা নিয়ে কথা বলতে আমরা পছন্দ করি। অনেকটা ৩৬৫ দিনের মানবাধিকার খতিয়ান। শুধু সেই দৃষ্টিতেই এই খতিয়ানের অবতারণা।

২০১৯ সালটি শুরুই হয়েছিল আশা–নিরাশার দোলাচলে—একদিকে আকার অপরিবর্তিত থাকার ফলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যেমন জনসাধারণের মনে একপ্রকার ‘নিশ্চয়তার’ জন্ম দেয়, ঠিক তেমনি ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’—এই প্রত্যয়টি দারুণ হোঁচট খায় বলে জনসাধারণের বিশাল এক অংশের ধারণা এবং তা বিদ্যমান গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের’ পোশাকি পরিচয়টুকুও খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। তবু সরকারপ্রধানের ওপর অবিচল আস্থা রেখে মানুষ আশায় বুক বাঁধে।

কিন্তু ওই যে বলেছি মানবাধিকার পরিস্থিতি তো আর রাতারাতি পাল্টায় না—আগের বছরের চেয়ে নতুন বছরেও তাই সমান্তরালিকভাবে তা চলতে থাকে রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিশাল কর্মযজ্ঞ এবং তারই সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে নাগরিকের মানবাধিকারের লঙ্ঘনের নানা ঘটনা। ধর্ষণ (সাড়া জাগানো সুবর্ণচরের ঘটনা), বিনা বিচারে বেআইনি আটক (জাহালমের ঘটনা), স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড (নুসরাত জাহান রাফি, রিফাত হত্যাকাণ্ড), সুশাসনের অভাবে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন নষ্ট ইত্যাদি চলতেই থাকে। আমি এখানে কোনো সংখ্যার আশ্রয় নিতে চাই না—কয়টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, কয়টি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে রাষ্ট্র নির্লিপ্ত থেকেছে, কজন নাগরিককে বিনা বিচারে আটক করা হয়েছে, প্রশাসনের অবহেলায় কজন মানুষকে অগ্নিকাণ্ডে বা লঞ্চডুবিতে প্রাণ দিতে হয়েছে—এই সংখ্যাটি আমার কাছে প্রধান বিবেচ্য নয়, এ ধরনের ঘটনা যে ঘটে চলেছে, সেটিই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ।

‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’–এর মতো ২০১৯ সালেও সংঘটিত হয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো জঘন্যতম অপরাধ। মাদক নির্মূল অভিযানের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট দৃশ্যমান ছিল—বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকারকে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে দেখানো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিষ্টাচারে পরিণত হয়েছে। কোন মৃতের বিরুদ্ধে কতগুলো ফৌজদারি মামলা হয়েছে, তার ফিরিস্তি দেওয়া রেওয়াজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি মামলা থাকে, তার ‘প্রাণ হরণ’ করাটা (বিনা বিচারে) যেন আপনা-আপনি রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত হয়ে যায় এবং এ জন্য কারও কোনো জবাবদিহির ধার ধারতে হয় না। আর ‘গুমের ব্যাপারে তো অবস্থা অধিক শোচনীয়—রাষ্ট্রের বক্তব্য।’ এটি অবশ্য অবশ্যই অপরাধী চক্রের কাজ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এতে কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই।

এটি এ রকম হতে পারে। তবে এটি যে ‘অপরাধীর কাজ’—সেটি যে রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হবে এবং এটি স্মরণ রাখতে হবে যে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সব দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে।

জনসাধারণের মনে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বুঝিবা একধরনের ‘দায়মুক্তি’ ভোগ করেন! তাঁরা এতটাই ‘ক্ষমতাবান’ ও ‘প্রভাবশালী’ যে আইন তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। আইনের শাসন তাই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে সাধারণ নাগরিকের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণে—অন্যরা ‘অসাধারণ’—ভিআইপি এবং আইনের ঊর্ধ্বে! এর ফল যে কখনো শুভ হতে পারে না, তা টের পেতে আমাদের খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০১৯ সালে তাই দেখেছি জনসাধারণের মধ্যে তাৎক্ষণিক বিচারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে—ব্যাপারটি যেন Now বা Never–এর মতো। পারলে এখনি বিচার করো ও দণ্ড দাও, তা না হলে কোনো দিন বিচার হবে না। তাই অধিক হারে মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণপিটুনির ঘটনা বৃদ্ধি পেতে পেতে এক আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর অর্থ কি এই নয় যে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার ক্রমাবনতি ঘটছে? এটি কি রাষ্ট্রের জন্য সুখের সংবাদ?

তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ‘ব্যক্তি শেখ হাসিনা’—যেকোনো সংকটকালে ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। পুলিশের উদ্দেশে তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন যে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের অবশ্যই মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড যখন শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে; সর্বোচ্চ নেতৃত্বকেও বিদায় করে দিতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েট যখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তপ্ত, ব্যক্তি শেখ হাসিনা, দৃঢ়চেতা রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং দায়ী ছাত্রদের আইনের আওতায় নিয়ে এসেছেন।

ঠিক একইভাবে ডাকসু ভিপির ওপর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামধারী ছাত্রদের হামলার ব্যাপারে তাঁর ‘অসন্তোষ’ ব্যক্ত করতে বিলম্ব করেননি এবং এ ক্ষেত্রেও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এসবের মাধ্যমে যদিও ব্যক্তি শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—যদি সবকিছুর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাহলে প্রশাসনের অন্যদের ভূমিকা কী এবং তাদের প্রয়োজনই বা কী? ব্যক্তিনির্ভর শাসন কি সুশাসনের পরিচায়ক হতে পারে?

২০১৯-এ এসে মানবাধিকারের পরিমাপক হিসেবে যে ধারণাটিকে রাষ্ট্র প্রথম কাতারে নিয়ে এসেছে, তা হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন। বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। উন্নয়নমূলক মেগা প্রজেক্টসমূহে নাগরিকের ভাগ্য-উন্নয়নের সোপান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের ঈর্ষার কারণ হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও মানবাধিকারকে পরিপূরক হিসেবে না দেখে সম্পূরক হিসেবে দেখা হচ্ছে। অগ্রাধিকারের শীর্ষে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যা মূলত ভৌত-কাঠামোগত উন্নয়ন। এবং এটি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে প্রথমত, প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবাধিকার যদি কিছুটা বিসর্জন দিয়ে হয় তাহলেও!

শুধু তা–ই নয়, এসডিজির মূলমন্ত্র কাউকেই পেছনে রেখে নয়-এর ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূল স্থান দখল করেছে কিন্তু যার জন্য ‘উন্নয়ন’ সেই ‘মানুষ’কে (নাগরিক) পর্দার অন্তরালে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানবিক উন্নয়ন ব্যতিরেকে কোনো উন্নয়ন কি টেকসই হতে পারে? আর সুরক্ষিত মানবাধিকার ছাড়া কি মানবিক উন্নয়ন সম্ভব?

এরূপ নানাবিধ প্রশ্ন যখন নাগরিকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন বছরের শেষ দিকে এসে ‘শুদ্ধি অভিযান’ সূচনা করে ব্যক্তি শেখ হাসিনা আবারও সবার প্রশংসায় অভিষিক্ত হয়েছেন। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে—মানুষের মনে যেন অনুরণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন বারংবার ধ্বনিত হওয়া গান— ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।’

কিন্তু শুরু না হতেই বন্ধ হয়ে যাওয়া এই অভিযান হাজারো প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। আগামী বছর কি দেবে এসব প্রশ্নের উত্তর?

বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশাল স্বপ্ন দেখে—মধ্যম আয়ের দেশ, আর তারপরই উন্নত দেশের কাতারে আসন নেবে বাংলাদেশ। বছরের শেষে যখন শুনি ১ জানুয়ারি ৩৮ কোটি পুস্তক বিতরণ করা হবে বিনা মূল্যে, তখন নাগরিক হিসেবে উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। যখন শুনি প্রত্যেক নাগরিকের স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করা হবে, তখন বাঙালি হিসেবে গর্বই বোধ করি। যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার অপূর্ব নিদর্শন স্থাপন করে বাংলাদেশ, তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!’

কিন্তু সহসাই লক্ষ করি মানুষের মধ্যে কী এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে, কেন যেন অনেকেই মনে করছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে; আইনের শাসনকে (রুল অব ল) দূরে ঠেলে দিয়ে আইন দ্বারা শাসন (রুল বাই ল) পাকাপোক্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে, যে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’—সেই রাষ্ট্রেই ক্ষমতা থেকে জনগণের দূরত্ব যেন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে মানবাধিকারের সংগ্রামের ফসল হিসেবে, সেই বাংলাদেশেই মানবাধিকার ক্রমেই রাষ্ট্রীয় বিবেচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। অসীম শক্তিধর রাষ্ট্রের বিপরীতে দুর্বল, একাকী, নাগরিক যেন অধিকতর দুর্বল হচ্ছে!

পরক্ষণেই সব দ্বন্দ্ব ত্যাগ করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় প্রতীক্ষা করি নতুন বছরের, নতুন সময়ের, নতুন দৃঢ়তায় পথচলার প্রত্যয়ে।

ড. মিজানুর রহমান: মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক