Thank you for trying Sticky AMP!!

মাহাথির: দেশপ্রেমিক না ক্ষমতাপ্রেমী

মাহাথির মোহাম্মদ। ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধ ও ভালোবাসায় নাকি সবই সিদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধই তো কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। যুদ্ধ ও ভালোবাসায় যে সবকিছুই বৈধ অনেকেই বলে থাকেন, এর সারবত্তা কী? হতে পারে যুদ্ধ যখন অবশ্যম্ভাবী হয় বা ভালোবাসা যখন সর্বগ্রাসী হয়, তখন তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ জন্যই বোধ করি কবি-সাহিত্যিকেরা বলেছেন, যুদ্ধ ও ভালোবাসায় কোনো যুক্তি কাজ করে না। এখানে এক পক্ষকে সব মেনে নিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কে মেনে নেবে আর কে মানাবে। এই মানা ও মানানোর এক জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছে মালয়েশিয়ার রাজনীতি। এখন দেখা যাক, মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে কে কী মেনে নিচ্ছে আর কে সবাইকে মেনে নিতে বাধ্য করছে।

এখানে বলে রাখা ভালো, রাজনীতিতে এমন সব কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, যা অনেক সময়ই গ্রহণযোগ্য না। কিন্তু এক পক্ষকে মেনে নিতে হয়। যেমন মাহাথির মোহাম্মদ হুট করেই প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেন। কথা ছিল, তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাহাথির ও আনোয়ারের জোট পাকাতান হারাপান (আশার জোট) সরকার গঠনের পর এমনটাই কথা ছিল। মাহাথির মোহাম্মদ পদত্যাগ করলেন বটে, কিন্তু কথা রাখলেন না। কথা তিনি রাখবেন না—এমন আভাস কিছুদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। তিনি শুধু পদত্যাগই করেননি; তাঁর দল সরকার থেকেও পদত্যাগ করেছে।

এতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বিপাকে পড়ে গেলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। ধারণা করা হচ্ছে, আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকাতেই মাহাথির এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে নির্বাচন হতে পারে। অথবা মাহাথিরের এই পদত্যাগ ২০১৮ সালে নির্বাচনে পরাজিত নাজিব রাজাকের দলকে আবারও ক্ষমতায় নিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাহাথিরের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করতে পারে নাজিবের অনুসারীরা। মূলত, আনোয়ারের বিরোধীরা একজোট হয়ে একটি ঝুলন্ত সরকার গঠন করতে পারে। এই সরকারে কোনো দলেরই একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এ ক্ষেত্রে শিগগির আবার মালয়েশিয়ায় নির্বাচন হতে পারে। তবে অনেকেই ভিন্নদিক থেকে চিন্তা করছেন। ঝুলন্ত পার্লামেন্টের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরই পুনরায় ফিরে আসবেন। যেহেতু পার্লামেন্টে এককভাবে শক্তিশালী কোনো দল থাকবে না, সে ক্ষেত্রে মাহাথিরের প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ দীর্ঘ হবে। কৌশলে মাহাথির নিজের ক্ষমতাকে আরও সংহত করতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, মাহাথিরের দল প্রিবুমি বেরসাতুর মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহিদ্দিন ইয়াসিন প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারেন। তবে এটাও নির্ভর করছে মাহাথিরের ইশারার ওপর। মাহাথির যদি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হতে অনিচ্ছুক হন, তবেই মুহিদ্দিনের কপাল খুলতে পারে।

মাহাথিরকে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর জন্য শাসক মডেল বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একহাতে মালয়েশিয়া শাসন করেছেন। ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসরে চলে যান। তাঁর আমলে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি আমূল বদলে যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। তবে মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জঞ্জাল সাফ করতে গিয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না তিনি। রাজনীতির পথে যাকেই কাঁটা মনে করেছেন, শক্ত হাতে সরিয়ে দিয়েছেন। মাহাথির দীর্ঘ সময়ের সহযোদ্ধা আনোয়ার ইব্রাহিমকে জেলে পুরেছেন দুর্নীতির অভিযোগে। আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগও আনা হয়েছিল। আনোয়ারের পতনের পর নাজিব রাজাক রাজনীতির সামনের কাতারে চলে আসেন। প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন নাজিব। নাজিব রাজাককে হারাতেই মাহাথির আবার আনোয়ারের সঙ্গে জোট করেন। রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ায় মাহাথির ৯৪ বছর বয়সে রাজনীতিতে ফিরে আসেন নিজের দলের বিরুদ্ধেই নির্বাচন করতে। দীর্ঘ দিনের বন্ধু বা সহচর এবং শেষ দিকের শত্রু আনোয়ারের সঙ্গে নির্বাচনী মৈত্রী করেন।

মাহাথির মোহাম্মদ যদি মালয়েশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে চতুর খেলোয়াড় হন, তবে ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক হচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। দীর্ঘ সময় মাহাথিরের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, মাহাথিরের পর আনোয়ারই মালয়েশিয়ার হাল ধরবেন। কিন্তু শেষ দিকে মাহাথিরের সঙ্গে আনোয়ারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত জেলেও যেতে হয়েছিল। এবারও আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে মাহাথির প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছেন।

শুরুতে বলেছিলাম, যুদ্ধ ও ভালোবাসায় সবই সিদ্ধ। তেমনি রাজনীতিতে কৌশলের খেলায় সবই সিদ্ধ। মাহাথির যে কৌশলে আনোয়ারকে বঞ্চিত করলেন, তা অনৈতিক হতে পারে বটে, কিন্তু মেনে নিতে হবে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, অনৈতিক সিদ্ধান্ত কি চুপচাপ মেনে নেওয়া অনৈতিক? প্রশ্নটা ছিল, কেন মানবে আর কে মানাবে। এখন আনোয়ার ইব্রাহিম যদি মালয়েশিয়ার জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে মাহাথিরের ওপর যথাযথ চাপ প্রয়োগ করতে পারে, তবে মাহাথির দাবি মেনে নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে দেবে। অথবা আনোয়ার ইব্রাহিমসহ সবাইকে মাহাথিরের কৌশল ও সিদ্ধান্ত মিনে নিতে হবে। মাহাথির সংবিধান অনুসারেরই কাজ করেছেন। তিনি এমন কিছু করেননি, যাতে তাকে জেল-জরিমানা করা যাবে। কিন্তু মাহাথির নিজের ভাবমূর্তি ও অবস্থান হারাচ্ছেন। মালয়েশিয়ার সুশীল সমাজ ইতিমধ্যে তাঁর পদত্যাগের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, প্রতিশ্রুতি অনুসারে আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। এত কিছুর পরও সবাইকে মাহাথিরের সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতে হচ্ছে। বরং বলা চলে মাহাথির সবাইকে তাঁর রাজনৈতিক চাল মানতে বাধ্য করছেন। ৯৪ বছর বয়সেও মাহাথিরই মালয়েশিয়ার রাজনীতির মাঠের কুশলী খেলোয়াড়। নাজিব রাজাক ক্ষমতার ফিরবেন কি না অথবা আনোয়ার ইব্রাহিম আদৌ ক্ষমতায় আসবেন কি না, তা এখনো নির্ভর করছে তাঁর ওপর।

ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক