বাংলাদেশ

রাত্রির তপস্যা দিন আনবে না?

শহীদ রুমী, শহীদ জুয়েল, শহীদ আজাদ
শহীদ রুমী, শহীদ জুয়েল, শহীদ আজাদ

আজ ৩১ আগস্ট। শরৎকাল। ৩৩ বছর আগে এমনই এক শরৎকালের বিকেলে, ৩১ আগস্ট ১৯৮৫ সালে, শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগম মারা যান। পরের দিন সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে জুরাইনে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সমাহিত করেন। রুমীর আম্মা জাহানারা ইমাম তখন গাড়িতে গোরস্থানের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে বলেছেন, দুপুরবেলা যখন আজাদের মাকে কবরে শোয়ানো হয়, তখন হঠাৎ রোদের মধ্যে বৃষ্টি পড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের কারও কারও মনে হয় যে শহীদ রুমী, শহীদ বদি, শহীদ জুয়েল, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ আজাদ—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ এই বীর মায়ের জন্য পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছেন।

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে, আর আজাদের মায়ের মৃত্যুর ১৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট দিবাগত রাতে, মানে ৩১ আগস্টের প্রথম প্রহরেই আজাদকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। একই সময়ে ঢাকা শহরের ২২টা মুক্তিযোদ্ধা-শেল্টার ঘেরাও করে পাকিস্তানি বাহিনী।

ধরে নিয়ে যায় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদকে। ধরে নিয়ে যায় রুমীকে, তাঁর ভাই জামী আর তাঁর বাবা শরীফ সাহেবকে। ধরে নিয়ে যায় জুয়েলকে, ধরে নিয়ে যায় বদিকে। ধরে নিয়ে যায় শহীদ বাকের, শহীদ আশফাকুজ্জামান, শহীদ আবুল বাশারকে—কী বিষণ্ন থোকা থোকা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো এক গোছা নাম।

আজাদ ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন ভীষণ বড়লোক, বাড়িতে হরিণ ছিল, সরোবর ছিল, মসলার বাগান ছিল। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আজাদ যখন পড়েন ক্লাস সিক্সে, তাঁর বাবা আরেকটা বিয়ে করলে মা প্রতিবাদস্বরূপ আজাদকে নিয়ে স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে বস্তিঘরে আশ্রয় নেন। অনেক কষ্টে আজাদকে লেখাপড়া শেখান। আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৭১ সাল। আজাদের বন্ধু ছিল জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, ক্রিকেটার জুয়েল, বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামাল প্রমুখ। বন্ধুরা সবাই আগরতলায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। ঢাকায় তাঁরা গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। ফার্মগেট অপারেশন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন—পাকিস্তানি সৈন্যদের ত্রস্ত করে তুলেছেন তাঁরা। তাঁরা আজাদকে বললেন, তুইও আমাদের সঙ্গে চল, অপারেশনে যাই। তোর বাবার বন্দুক ছিল, তুই তো বন্দুক চালাতে জানিসই। আজাদ মায়ের কাছে অনুমতি নেন। আজাদদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেন। আজাদ বন্ধুদের সঙ্গে একটি-দুটি অপারেশনে গিয়েওছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে আজাদদের মগবাজারের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আজাদ, কাজী কামাল, জুয়েল, বাশারেরা তখন খালি গায়ে ক্যারম খেলছিলেন। ভীষণ গরম পড়েছিল সেই রাতে। কাজী কামাল একজন সৈন্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করতে করতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ধরা পড়েন বাকিরা।

ধরা পড়েন জুয়েল। আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। ’৭১ সালে বয়স ছিল ২১ বছর। তিনি ছিলেন মারকুটে ক্রিকেটার। আজাদ বয়েজ আর মোহামেডান ক্লাবে খেলতেন। ধরা পড়ার আগে একটা অপারেশনে গুলিতে তাঁর হাতের একটা আঙুল জখম হয়েছিল। ভীষণ হাসিখুশি এক তরুণ ছিলেন জুয়েল। সবাইকে হাসাতে পারতেন। উইকেট কিপিংও করতেন মাঠে।

এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে ধরা পড়েন শাফী ইমাম রুমী। তাঁর বয়স ছিল কুড়ি বছর। তিনি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও তিনি ভর্তি হন। তিনি যুদ্ধে যেতে চান, মা তাঁকে যেতে দেবেন না। কিন্তু রুমী নাছোড়। এটা কেমন স্বার্থপরতা যে দেশের মানুষ যখন মুক্তির জন্য লড়ছে আর মরছে, তখন তিনি যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে? শেষে মা বললেন, যা, তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম। এই একটা কথা চিরকাল জাহানারা ইমামকে দগ্ধ করেছে, আহা, সেদিন যদি বলতাম, যা, বিজয়ী হয়ে ফিরে আয়।

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের বাড়ি থেকে ধরা পড়েন বদিউল আলম। ভীষণ ভালো ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় বোর্ডে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শেষ বর্ষে। এনএসএফ করতেন বলে বন্ধুরা তাঁকে নিতে চাননি আগরতলা যাত্রীদলে। তিনি পকেট থেকে ব্লেড বের করে নিজের আর ছাত্র ইউনিয়ন করা শহীদুল্লাহ খান বাদলের আঙুল কেটে রক্ত মিশিয়ে নেন। বলেন, যা, আজ থেকে আমরা রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদার্স। ভীষণ সাহসী যোদ্ধা ছিলেন বদি।

আলতাফ মাহমুদ ছিলেন ওই সময়ে দুই পাকিস্তান মিলেই একজন ভীষণ শক্তিশালী সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুরকার। একাত্তর সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গান রেকর্ড করে পাঠাতেন ভারতের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। নিজের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারি হানা দেন ভোরবেলা। মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায়। তাঁকে দিয়ে কোদাল চালিয়ে নেয় তারা, উঠান খুঁড়ে অস্ত্র বের করায়। তাঁর কপালে বেয়নেট চালালে চোখের ওপরের চামড়া খুলে ঝুলে পড়ে চোখের ওপরে।

আজাদকে ধরে প্রথমে নেওয়া হয় রমনা থানায়। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান থানায়। পাকিস্তানিদের দালালেরা বলে, আপনার ছেলেকে সবকিছু স্বীকার করতে বলেন, ওকে আমরা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছি। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করে বলেন, শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না। ছেলে বলেন, মা, কদিন ভাত খাই না, ভীষণ ভাত খেতে ইচ্ছা করছে, আমার জন্য ভাত এনো তো। মা ভাত রেঁধে টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে সাজিয়ে নিয়ে থানায় আসেন। এসে দেখেন ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি। আর এই মা পরবর্তী ১৪টা বছর আর কোনো দিনও ভাত খাননি। তিনি বিছানায়ও শুতেন না। সব সময় মেঝেতে শুতেন। কারণ তিনি দেখেছিলেন, তাঁর ছেলে আজাদ রমনা থানায় শোয়ার জন্য বিছানা পাননি।

জুরাইনে তাঁর কবরটা এখনো আছে। গত বছরও আমি আর আজাদের খালাতো ভাই ফেরদৌস আহমেদ জায়েদ কবরে গিয়েছিলাম। সেখানে লেখা আছে: মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা। 

বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যায়, নানা দিকে, তখন খুব আশাবাদী হই। যখন অমর্ত্য সেন বলেন, মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে, যখন দেখি, আমাদের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে ভালো, তখন আশায় আশায় বুক ফুলে ওঠে। আবার যখন শুনি, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস–অযোগ্য শহর, তখন মনটা দমে যায়। যখন বাক্‌স্বাধীনতা, কিংবা মানবাধিকারের মতো মৌলিক প্রত্যয়ও টলে ওঠে, তখন ভাবি: বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা

এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই লাইন দুটোর আগে-পরে বারবার পড়ি:

বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা

এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

 স্বর্গ কি হবে না কেনা।

 বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না

 এত ঋণ?

 রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।

রাত্রির তপস্যা দিন আনবে না?

পাদটীকা:

সরকারকে দুটো পরামর্শ দিই। এক. কোটা সংস্কারের দাবির সুন্দর গ্রহণযোগ্য একটা সমাধান অনতিবিলম্বে দিন। দুই. স্কুল-কলেজগুলোয় একটা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ কর্মসূচি হাতে নিন। এ কর্মসূচি হবে—ট্রাফিক পুলিশ, শিল্পীসমাজ, অভিভাবক, শিক্ষক, স্কাউট মিলে সচেতনতা সৃষ্টির একটা ইতিবাচক আনন্দপূর্ণ কর্মসূচি।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক