রস রচনা

লুডুলুডু ছক্কা: গুডুগুডু অক্কা!

যেই রাজ্যের জাতীয় খেলা লুডু;

সেই রাজ্যের সারমর্ম ছক্কা গুডুগুডু।

মানে সেখানে টিগিটিগি টিগিটিগি হাত ঝাঁকিয়ে চাল চাললে যে গুটিটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তার ছয়টা পাশেই ছয়। সেখানে সবকিছুতেই ছক্কা-এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ-ফাঁচ এক্কেবারে নিষিদ্ধ। এসব সংখ্যা মুখে এলেই ঘ্যাচাং! একদম গর্দান পার। একবার এক অতিসাধারণ অতিথি পিঁপড়া চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে ক্লান্ত হয়ে যখনই বলল, এক গ্লাস পানি দেবেন কেউ, প্লিজ...। ঘ্যাচাং! অমনি তার গর্দান গেল চলে।

তারপর বেশ কদিন কেটে গেলে সেই রাজ্যের কোনো এক বিগ বসের ক্ষমতাশালী বন্ধু ঘটনাটা শুনেই বলল, ফানি ফানি...। আর যায় কই, ওই গর্দান যাওয়া পিঁপড়াটার ভূত এসে তার পশ্চাদ্দেশে দিল এক কামড়। ওরে বাপ রে, বাপ! কী সে কামড়! ক্ষমতাশালীর হু হু করে জ্বর চলে এল এবং সেই জ্বরের নাম নাকি মোটাগুনিয়া। অল্প কদিনের মধ্যেই সেই মোটাগুনিয়া জ্বর ছোঁয়াচে রোগ হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভীষণ ধারালো আর ভয়াবহ অসুখ। ছোঁয়াছুঁয়ি লাগে না, জাস্ট কোনোভাবে চোখে চোখ পড়লেই হলো। নিমেষেই জ্বর ট্রান্সফার। তবে এতে অবশ্য কিছু কিছু অতি কৌতূহলীর একটু সুবিধেই হলো। কারণ, মোটাগুনিয়া জ্বরের প্রচণ্ড
ঘোরে রোগীরা সবাই দিবারাত্রি রাজ্যময় হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিল। অবশ্য না হেঁটে উপায়ই বা কী তাদের? সব রোগীর পশ্চাদ্দেশে যে টনটনে ব্যথা। এক মুহূর্ত বসে থাকার কোনো উপায় নেই। ওরে বাপ রে, ওরে মা রে বলে এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তাদের দামি দামি গাড়ি সব অসহায় শামুকের মতো লেজ গুটিয়ে গ্যারেজে পড়ে থাকে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই। যা আছে জ্বরাক্রান্তদের দলবদ্ধ প্রলাপ, লুডুলুডু ছক্কা, গুডুগুডু অক্কা! লুডুলুডু ছক্কা, গুডুগুডু অক্কা! আর এলোমেলো হাঁটাহাঁটি।

সেই রাজ্যের বিগ বসদের বাড়ি;

দেয়ালগুলো চকচকে নোট টাকাই কাঁড়ি কাঁড়ি!

একজন অতি কৌতূহলী কোনো এক তেমন বিগ বসের বাড়ির জানালার পর্দার সামান্য ফাঁকে দুরবিন লাগাল। দেখে, বেজায় লুডু খেলার পার্টি চলছে ভেতরে। হয়তো ওই বাড়িটা তখনো একটু-আধটু মোটাগুনিয়া প্রোটেক্টেড। একটু পরপর টিগিটিগিটিগি আওয়াজের সঙ্গে ছক্কা গুডুগুডু, ছক্কা গুডুগুডু চিৎকার শোনা যায়। যে-ই ছক্কা পায় সে-ই হয়ে যায় ক্ষমতাধর, পায় দখল করার ফ্রি লাইসেন্স। জমি, ব্যাংক, দোকান, ব্যবসা-বাণিজ্য, নদী-নালা, খাল-বিল, জঙ্গল-পাহাড়-যা ইচ্ছা। দখলটাই সেই রাজ্যের কালচারের এক নম্বর ফুর্তি। সারি সারি বিশাল বিশাল সব বিল্ডিং সেখানে দখল করা জমির ওপর, গায়ে গায়ে লাগানো, কেউ কোনো জায়গা ছাড়ে না। রাস্তাগুলো সব যেন কোনোভাবে ভয়ে ভয়ে সরু হয়ে মাঝখান দিয়ে চুপচাপ এগিয়ে গেছে। তবে স্বাভাবিক সময়ে অবশ্য সেই রাস্তাগুলো গাড়িতে ঠাসা থাকে। জ্যামের ভেতর ড্রাইভারদের তেমন নড়াচড়া করার সুযোগও থাকে না বলে সবাই গুডুগুডু ছক্কা আইটেম গান শোনে আর ইউটিউবে হিটের সংখ্যা গুনে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখে। সেসব স্ট্যাটাসে লাইক দেওয়া অলমোস্ট কম্পালসারি, আর তা না করলে নানা ধরনের নতুন নতুন ট্যাক্সের বোঝা সামাল দিতে হয়।

সেই রাজ্যের রাজত্বতে পাস;

করবে তারাই যারা নিজের লেখাপড়ায় লাশ!

এটা অবশ্য সেই রাজ্যের খুব স্পেশাল বিষয়। যেমন মাস্টারি করতে হলে ফেল করা ছাত্র হতেই হবে। প্রধানতম হাসপাতালের হেড, জল্লাদ একজন। খাদ্য বিভাগের প্রধান হওয়ার যোগ্যতা, ভেজালকে শিল্পকলা হিসেবে গণ্য করতে হবে। গোটা কয়েক খুন-ধর্ষণ না করতে পারলে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বড় বড় ঋণখেলাপি হতে পারলে তারাই হতে পারে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী নাগরিক। সেই রাজ্যের শিল্পী-সাহিত্যিক-বিবেকবানদের বৈশিষ্ট্য, তাঁরা যেকোনো পরিস্থিতিতে বিগ বসদের পা চাটতে জানে
এবং চাটতে চাটতে যাদের জিব বেশ বড় হয়ে যায়, তারাও বিশেষ সুবিধাভোগীদের দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। এখানে প্রধান বিনোদন হিসেবে চব্বিশ ঘণ্টাই চলে দখলের ধারাবর্ণনা।

বেশ! তো, এই আনন্দে এই লুডুগুডু ছক্কা রাজ্যকে বহন করে পৃথিবীটা নেচে নেচে ঘোরাঘুরি করছিল সৌরজগৎময়। কিন্তু গতকাল রাত থেকে কী এক বিপত্তি! সব টেলিভিশনে ২৪/৭ লাইভ চলছে, টক শো, রিপোর্টিং যা যা হতে পারে। আসলে এই মোটাগুনিয়া রোগের জীবাণুর ভারে পৃথিবী-পিঠের যে জায়গাটুকুতে ওই রাজ্যের ছবিটা আঁকা, সেটুকু বেশ হুট করেই বেয়াদবের মতো ফুলে উঠেছে এবং সেই অতিরিক্ত ওজনের ভারে পৃথিবীটা আর ঠিক নিয়মমতো ঘুরে দিনরাতের শৃঙ্খলা দিতে পারছে না। সেই যে রাতের ঘন আঁধার, কিছুতেই কাটে না। জেনারেটরের যৌবন শেষ, পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সদর দপ্তর পড়েছে দখলদারদের খপ্পরে। সেটা নাকি আপাতত আধুনিক কাঁচাবাজার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার কথা। চলছে দেনদরবার, দামাদামি, ব্যক্তিদের আলোচনা। বিশেষ কোনো একটা উপায়ে রাজ্যকে আলোকিত করা ছাড়া আর উপায় কী?

সুতরাং কৌতূহল যতই থাকুক, আমাদের আসলে সেই সকাল বা কোনো একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পর্যন্তই অপেক্ষা করতেই হবে।

এনামুল করিম নির্ঝর: স্থপতি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা