শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: বুদ্ধিজীবীর কাজ কী?

অভিভাবকের সঙ্গে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে ছোট্ট শিশুটি। ছবি: আবদুস সালাম
অভিভাবকের সঙ্গে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে ছোট্ট শিশুটি। ছবি: আবদুস সালাম

গত শতকের ১৯৬০-এর দশক পুরোটাই আমাদের কেটেছে প্রবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন থেকে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত সব আন্দোলনেই আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে পরিচালিত সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ যখন বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল, তখন তাদের প্রথম শিকার হয়েছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্বে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় যখন আসন্ন, তখনো তারা আরও এক দফা বুদ্ধিজীবী নিধনে মেতে উঠেছিল।
এক অর্থে বলা চলে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও সমাপ্তি ঘটেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে।
প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানি শাসকেরা কেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, সংগীতশিল্পী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী—এসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত মানুষকে কেন তারা লক্ষ্যবস্তু করেছিল? এবং চূড়ান্ত পরাজয়ের মুহূর্তে কেন তারা নিজেদের সব জিঘাংসা চরিতার্থ করতে আবারও বেছে নিয়েছিল সেই বুদ্ধিজীবী সমাজকেই?
কারণ, তারা বুঝেছিল, একটা জাতির মনন গড়ে ওঠে তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের দেখানো পথ ধরে। যে বাঙালি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল, গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল, স্বাভাবিক রাজনৈতিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তার চিন্তা ও কল্পনার রূপায়ণে বুদ্ধিজীবীদের গভীর প্রভাব ছিল। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অবদানে।
পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা এটা বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই তারা প্রথম আঘাতটাই হেনেছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ওপর। তাদের শেষ আঘাতের লক্ষ্যবস্তুও ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। এই নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকেরা একদিকে জিঘাংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছে, অন্যদিকে ভেবেছে বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে ফেললে তাদের জাতি গঠনের কাজ দুরূহ হবে।
সম্ভবত, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের সেই ইচ্ছা অংশত কাজে লেগেছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে আমাদের জাতি গঠনের কাজ অত্যন্ত দুরূহ হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরের কয়েক বছর জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অভাবের ফলে শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ক্রমেই এককেন্দ্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। যেসব গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে আমরা ১৯৬০-এর দশকজুড়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশেও তা আমরা অর্জন করতে পারি না। শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাতে হারাতে অবশেষে যখন একদলীয় ও স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, তখন আমরা বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাই। মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, রক্ত দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে যখন একদলীয় বাকশালের শাসন কায়েম করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম দূরে থাক, কোনো প্রতিবাদও উচ্চারিত হলো না।
সম্ভবত এর কারণ ছিল আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব। রাষ্ট্রীয় শাসনক্ষমতা যখন সর্বময় হয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ অনুভব করে বুদ্ধিজীবীর মন। সেই বিদ্রোহ হয়তো রাজপথে প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে না, কিন্তু অন্যদের মননে সঞ্চারিত হয় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখায়, গানে, কবিতায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে। কিন্তু আমাদের দেশে তা ঘটেনি।
আমাদের রাজনীতি ক্রমেই সংকীর্ণ ও অদূরদর্শী পথে এগিয়েছে। অবশেষে তা আটকটা পড়েছে সংকীর্ণতার কানাগলিতে। সেখানে সে হয়ে উঠেছে হিংস্র; নিজের অস্তিত্ব রক্ষার উপায় সে দেখে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার মধ্যে। এই পরিস্থিতির পেছনেও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার ভূমিকা আছে বলেই ধারণা করি। চিন্তা ও মননের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনার অভাবে আমাদের রাজনীতি গণতান্ত্রিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। সবার সব ধরনের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এই রাজনীতি স্বীকার করতে চায় না; অন্যের মতের প্রতি সে চরমভাবে অসহিষ্ণু। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সে ভিন্নমত ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে চায়। এ রকম অগণতান্ত্রিক ও অন্যায্য পরিবেশ যখন সৃষ্টি হয়, তখন এর বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর বেজে ওঠার কথা।
বুদ্ধিজীবীর স্বাধীন কণ্ঠস্বর। কিন্তু স্বাধীন বুদ্ধিজীবী কথাটা আমাদের দেশে আজ সোনার পাথরবাটির মতো। এ হয় না। এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখযোগ্য অংশ চিন্তা ও মনন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন কী, তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার কাছে ষাষ্টাঙ্গে বশীভূত হয়ে নানা রকমের বৈষয়িক সাধ পূরণের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আইনজীবী ইত্যাদি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার সমিতি-সংগঠনগুলো দলীয় রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত। তারা বস্তুত রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে। জনসাধারণের কাছে যে সাংবাদিক সমাজের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কাম্য, তাঁরাও দলীয় রাজনৈতিক লাইনে বিভক্ত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বাংলাদেশে বিরল হয়ে উঠেছে। তাই যখন স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল আইন প্রণয়ন করা হয়, তখন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদ এমন প্রবল হয় না, যা সে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে পারে।
বুদ্ধিজীবীর সেই প্রবল স্বাধীন কণ্ঠস্বর নেই বলে বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের এমন রুগ্‌ণ দশা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদ্‌যাপনের মুহূর্তে আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া উচিত। তাঁদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, বুদ্ধিজীবীর স্বরূপ কী। জাতির প্রতি তাঁদের দায়িত্ব কী। তাঁদের আরও ভেবে দেখা উচিত: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদানের তাৎপর্য তাঁরা উপলব্ধি করেন কি না।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com