সৃষ্টির সময়কাল থেকে চলে আসছে—নারী সন্তান গর্ভধারণ করবেন, নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম দেবেন। শারীরিক গঠনপ্রণালির মধ্যেই সেই রহস্য রয়ে গেছে, অর্থাৎ কীভাবে সন্তানের জন্ম হবে। দেশ-কাল-পাত্রভেদে যুগে যুগে এই ধারাকে বহন করে নারী তাঁর এই মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন অথবা নানা রকমের জটিলতা নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের নারীর শারীরিক গঠন এক রকমের নয়, সেই কারণে সব দেশের জটিলতাও এক রকমের নয়। তবু জটিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাভাবিক প্রসবের বাইরে বিজ্ঞান একটি অন্য পথ বের করতে সক্ষম হয়েছে। এটি নারীকে জীবনের জটিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য, তাঁকে জটিলতায় ফেলার জন্য নয়।
স্বাভাবিক জন্ম দেওয়ার জন্য আমরা তিনটি জিনিসের ওপর খুবই নজর দিয়ে থাকি। বলা হয়, তিনটি পি অর্থাৎ জরায়ুর ক্ষমতা (পাওয়ার), যাত্রীর প্রবস্থান (প্যাসেঞ্জার), তিনি কীভাবে আছেন এবং শেষ পর্যন্ত কোন অবস্থায় বেরোবেন (পেলভিস), যাত্রাপথ কেমন হবে, পথটি স্বাভাবিক না সংকীর্ণ ইত্যাদি—এসবের ওপর নির্ভর করে স্বাভাবিক জন্মদানের প্রক্রিয়া। এ ছাড়া দীর্ঘ এ সময় তাঁর অবস্থা কেমন থাকবে, যেমন রক্তশূন্যতা, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত রক্তচাপ ও অন্যান্য অসুবিধা আছে কি না—এসবও স্বাভাবিক জন্মদানের শর্ত। এ জন্যই ভ্রূণ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যত দ্রুত সম্ভব একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। পৃথিবীর সব দেশেই প্রথম থেকে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাই নারীকে দেখেন। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু অন্য রকম। প্রত্যেকেই চান তাঁকে একজন ডাক্তার দেখবেন, তিনিই সব পরামর্শ দেবেন এবং নিজ হাতে ডেলিভারি করাবেন।
আমাদের দেশেও নার্সিং মিডওয়াইফরা প্রসব করাতেন। তাঁরা বিভিন্ন হাসপাতালে শুধু ডেলিভারির জন্যই থাকতেন। বাংলাবাজার রেডক্রিসেন্ট মাতৃসদন, আজিমপুর মাতৃসদনসহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মাতৃসদনে তাঁরাই ডেলিভারির কাজটা করাতেন, কিন্তু বর্তমানে নার্সের সংখ্যা কমতে কমতে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে মিডওয়াইফারি নার্সিং বলতে কিছু নেই এবং নার্সিং ট্রেনিংয়ের সময় মিডওয়াইফারি ট্রেনিংপ্রাপ্ত নার্সরাও প্রাতিষ্ঠানিক অন্য কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। বর্তমান সরকার আবার মিডওয়াইফারির জন্য তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স খুলেছে, তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তাও আছে। কিন্তু এখনো সেই পরিমাণে মিডওয়াইফ তৈরি হচ্ছে না।
পাশ্চাত্য দেশগুলোতেও ‘মা’ ব্যথা সহ্য করতে চান না, জরায়ুর মুখ খোলার একটা পর্যায়ে ইপিডুরাল ইনজেকশন পিঠে বসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মা ব্যথা না বুঝতে পারলেও বাচ্চা নিচের দিকে পথে আসছে কি না নার্স তাঁকে পরীক্ষা করে বলেন এবং চাপ দিতে বলেন, মুশকিলটা এখানেই। এই সময়ে চাপটা ভালো আসে না। কারণ, ব্যথা নেই সেই কারণে সময়টা প্রলম্বিত হয় এবং যন্ত্র দ্বারা বাচ্চা বের করা হয়। পাশ্চাত্যের মায়েরা এখন ভাবছেন তাঁরা ব্যথাসহ বাচ্চা চান। কারণ, ব্যথার সঙ্গে মাতৃত্বের একটা স্বাদ এখন তাঁরা নিতে চান। তাহলে নাকি সন্তানের বন্ধনটা আরও দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশে আমরা ব্যথামুক্ত ডেলিভারি খুব ভালোভাবে চালু করতে পারিনি। দু-একজন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। প্রথমত, ব্যাপারটি ‘ব্যয়বহুল’। একজন সচেতন নারীকে ইনজেকশন দিয়ে বাচ্চা বের হওয়ার সময় পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে; একজন সংবেদনশীলের ওপর। তিনি পুরো বারো ঘণ্টাই তাঁকে পর্যবেক্ষণ করবেন।
বাচ্চার অবস্থা মনিটর করার জন্য অত্যাধুনিক মেশিন, অর্থাৎ সিটিজি সব ক্ষেত্রে থাকতে হবে। একজন মিডওয়াইফ/নার্সকে সার্বক্ষণিক সেখানে বসে থাকতে হবে। শেষ মুহূর্তে যন্ত্রের ব্যবহার অনেক সময় শিশুর মাথার ওপর চাপ পড়ে, সেটি নিয়ে রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেটিও তাদের গ্রহণ করতে হবে। কাজেই প্রসববেদনা মাকে খুব একটা কষ্ট না দেয়, সে ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে ভিজিটগুলোর সময়ের শেষ সপ্তাহে তাঁকে এ ব্যাপারে কিছুটা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ, তিনি যদি তখন থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন যে ব্যথাটা প্রথমে আস্তে হয়ে ধীরে ধীরে বাড়বে।
কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট অন্য রকম, সিজারের মূল একটা কারণ মা কিছুতেই ব্যথা সহ্য করতে চান না। তাঁর সঙ্গে অন্যান্য আত্মীয়স্বজন যাঁরা থাকেন, নিজেদেরও নরমাল হয়েছে, তাঁরাও নিরুৎসাহিত করেন।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মা ও তাঁর আত্মীয়দের আগেই বোঝাতে হবে। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ হলেও স্বাস্থ্যকর্মীদের এ ব্যাপারে বিশাল ভূমিকা রাখতে হবে। অনেকেই মনে করেন, নরমাল হতে গিয়ে হয়তো-বা যোনিপথে কোনো রকম আঘাত তাঁর পরবর্তী স্বামীসহবাসে অসুবিধা হতে পারে, এটি ঠিক নয়। যেমন কোনো সময় পথটি ঠিক রাখার জন্য একটু প্রশস্ত করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবেই সেটিকে সেলাই করে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য সেবিকা/চিকিৎসকেরা যদি পার্টোগ্রাফসহ ১২ ঘণ্টা একটি ডেলিভারি পর্যবেক্ষণ করেন, তবেই এটি সুষ্ঠুভাবে হবে। আমরা চাই বাংলাদেশেও সর্বত্র ব্যথামুক্ত ডেলিভারির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এ ব্যাপারে অবেদনবিদদের সঙ্গে বসে একটি পথ বের করতে হবে।
সিজার করার আগেও সিজারের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিস্তারিত বলা অবশ্যই প্রয়োজন। সিজার কোন প্রয়োজনে হচ্ছে, বাচ্চা-মায়ের কী অবস্থা, কী ধরনের ব্যবস্থা আছে অথবা নেওয়া হবে, অবচেতন কেমন করে হবে, রক্তের প্রয়োজন কতটুকু, করার সময় কী ধরনের জটিলতা হতে পারে, বাচ্চার কোনো ডাক্তার আছে কি না, প্রয়োজনে বাচ্চার আর কোনো ব্যবস্থা লাগবে কি না ইত্যাদি সবকিছু বলা
এবং লিখিত হওয়া প্রয়োজন। সিজার একবার হলে বারবার লাগবে কি না, পরবর্তী সিজারের সময় কেমন হবে বা হতে পারে, সে বিষয়েরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
আমরা সবাই এ ব্যাপারগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিই না। এটা আমি সব চিকিৎসকের পক্ষ থেকেই দায় নিয়ে বলছি। কারণ, খুব স্বল্পসংখ্যকই পারেন ব্যাপারগুলো বুঝিয়ে বলতে।
পৃথিবীর সর্বত্র এ বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলেন স্বাস্থ্যকর্মী/মিডওয়াইফ/নার্সিং কর্মী। যে দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো দূরের কথা সাধারণ চিকিৎসক/রোগীর অনুপাত অস্বাভাবিক, সেখানে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। এখনো আমাদের দেশে ৬৩ শতাংশ ডেলিভারি বাড়িতে হচ্ছে, নানা রকম জটিলতাও হচ্ছে। আমরা চাই রাতারাতি না পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বাড়াতে এবং নরমাল ডেলিভারি হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে।
ক্লিনিক মালিক/ডাক্তারদের মানসিকতা নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য হচ্ছে, সেটিরও পরিসংখ্যান দরকার। শহর পর্যায়ে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা নিজেরাই যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসকদের ওপর চাপ দেন, তখন ব্যাপারটি অন্য রকম হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসক/রোগী উভয়েরই দায়িত্ব নিতে হবে। মৌখিক আলোচনা ছাড়াও লিখিতভাবে জিনিসগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রয়োজন ছাড়া কখনোই সিজার হবে না, এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মী/নার্স/মিডওয়াইফ, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিক মালিক—সবার সঙ্গে যৌথভাবে বসতে হবে।
আমরা চাই সারা জীবনের নিরাপত্তা, একটি সুস্থ মা, সুস্থ নবজাতক, স্বাভাবিক পরিবেশ। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সংগঠন, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, নার্সিং, মিডওয়াইফদের সংগঠন—সবাই মিলে আসুন আমরা এই অবস্থার অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আসি এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অপারেশনকে ‘না’ বলি।
রওশন আরা বেগম: অধ্যাপক, প্রসূতি রোগ বিভাগ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।