চালের দাম

হাতের পাঁচ না থাকলে যা হয়

বাংলা ভাষায় হাতের পাঁচ বাগ্‌ধারাটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। এটা হতে পারে কোনো পণ্য, নগদ টাকা এমনকি কৌশল। বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য হাতের পাঁচ রাখতে হয়। আর সেটা সরকারেরও। কিন্তু কোথায় যেন একটা গোল বাধল। আকস্মিক বাজারে বেড়ে চলছিল চালের দাম। বিশেষ করে মোটা চালের। এখন সরকারের কিছু দৃঢ় পদক্ষেপে তা কমতে শুরু করেছে। স্থিতিশীল হতে একটু সময় নেবে। মাঝখানে ভোগান্তি যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। মাঝখানে কিছু মানুষ অনৈতিকভাবে লাভবান হলো।

এমনটা কীভাবে হলো, তা নিয়ে অনেক লেখালেখি আর আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন সরকারের। সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি করছেন তাঁরা। আর সরকারের তরফ থেকে চালকলের মালিক, ব্যবসায়ী এবং ক্ষেত্রবিশেষে গণমাধ্যমকে দায়ী করা হচ্ছে। বাজারে চালের অভাব নেই। তাহলে এমনটা কেন হয়, সেটা জানার কৌতূহল অনেকের। সংকটের সূচনা গত মার্চের শেষে। ব্যাপক বোরো আবাদ হওয়া হাওর অঞ্চল অকালবন্যায় তলিয়ে যেতেই সংকটের সূচনা। আবার উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশে বোরো ফসলে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে উৎপাদন কিছুটা কমে যায়। সবকিছু মিলিয়ে খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে ২০ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হয়েছে। আমরা চাল উৎপাদনে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বাধীনতার উষালগ্নে সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশে ছিল খাদ্যের ঘাটতি। এখন ষোলো কোটি মানুষের সেই দেশটির এ ক্ষেত্রে সাফল্য উল্লেখ করার মতো। উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০১৬ সালে চালের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন। এর ১ কোটি ৯২ লাখ টনই বোরো। এটাই আমাদের প্রধান ফসল। আর এ সময়ই সরকারের খাদ্যগুদামে বড় ধরনের সংগ্রহ কার্যক্রম চলে।

স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন বিপর্যয়ে এবার ব্যাহত হয় সরকারের খাদ্য সংগ্রহের কার্যক্রম। চালের হিসাবে প্রায় ৯ লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এযাবৎ তা করা গেছে মাত্র ২ লাখ ৬০ হাজার টন। এর কারণ খোলাবাজারে দাম বেড়ে যাওয়া। সরকারের নির্ধারিত ৩২ টাকা কেজিতে মিলাররা চাল দিতে অক্ষম হন। ফুড প্ল্যানিং মনিটরিং ইউনিট নামের একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। তারাই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও দাম নির্ধারণ করে। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে গিয়ে চাহিদা, মজুত পরিস্থিতি ও গুদামের ধারণক্ষমতা থাকে বিবেচনায়। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কিছু প্রণোদনা যুক্ত করে। তবে বাস্তবতা পরিবর্তনশীল। বাজারে সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে ধান ও চালের দাম বেড়ে গেলে চুক্তি অনুসারে পাওয়ার প্রত্যাশা অবাস্তব। এ ক্ষেত্রে সংগ্রহ মূল্য দ্রুত বাস্তবভিত্তিক পুনর্নির্ধারণ করলে সরকারি গুদামে চাল মজুত বেশি হতো। সরকারের যথেষ্ট মজুত থাকলে সুযোগ থাকে বাজারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার। তা না করে সরকার বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। সংকটকালে বিদেশ থেকে সরকারি পর্যায়ে খাদ্য আমদানি বরাবরই দুরূহ বলে দেখা গেছে। ফলে ব্যবসায়ীদের একটি অসাধু মহল যখন একরূপ অকারণে চালের দাম বাড়িয়ে চলছিল, তখন মজুত কম থাকায় বাজারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগও হয়ে পড়ে সীমিত। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, ১৯ সেপ্টেম্বর খাদ্য মজুত ছিল ৩ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল এবং ১ লাখ ১৭ হাজার টন গম। বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে আরও ১ লাখ ১১ হাজার টন চাল।

উল্লেখ্য, সরকারের খাদ্য মজুতের ক্ষমতা ১৯ লাখ টন। রেশন থেকে ত্রাণ—সরকারের সব খাদ্য বণ্টন চলে এই মজুত থেকে। এই মজুত থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছুটা কম দামে ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) নামের একটি ফলপ্রসূ কর্মসূচি চালানো হয়। ব্যাপকভাবে এটা মাসখানেক চালানো গেলে চালের দাম নেমে যাওয়ার কথা। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করা খাদ্যও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বাজারমূল্যের ওপর। তাই সময়ে সময়ে সেই আমদানিকে উৎসাহিত করা হয়। এবারও করা হয়েছে। চাল আমদানির পর্যায়ে শুল্ক ও কর ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ শতাংশ। বিনা মার্জিনে এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে নির্দেশ।

তবে এগুলো করতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ দেরি হয়ে গেছে। মার্চের শেষে অকালবন্যায় হাওর অঞ্চলের ফসল তলিয়ে যেতেই বিবেচনা নেওয়া সংগত ছিল যে ঘাটতি হবে। আবার উত্তরাঞ্চলের কিছু অংশেও বন্যায় ফসলহানি হয়। যারা চাল উৎপাদন করে, এখন তাদেরই ভিজিএফের মাধ্যমে দিতে হচ্ছে চাল। ফলে চাপ বেড়েছে মজুতের ওপর। সোয়া ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্যও এই মজুত থেকেই চাল যাবে। শুল্ক-কর কমানো হয়েছে গত ১ জুলাই থেকে। সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাত আমদানিতে তৎপর হয়। জানা যায়, হালনাগাদ তারা প্রায় ৬ লাখ টন চাল ও ১০ লাখ টন গম আমদানি করেছে। অবশ্য চাল আমদানির ওপর শুল্ক-কর বসানো হয়েছিল কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায়। তবে জুলাইয়ে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো এপ্রিলের শুরুতে নেওয়া হলে সুফল অনেক বেশি হতো। দেশি আমদানিকারকদের থেকেও সরকার টেন্ডারের মাধ্যমে চাল কিনতে পারত। যেমনটা কিনছে রাসায়নিক সার। সেই ব্যবস্থা তো সফল ও টেকসই প্রমাণিত হয়েছে। এখন অবশ্য মজুত কিছুটা বাড়ার দিকে। ওএমএস কার্যক্রম সম্প্রসারণ জরুরি। একশ্রেণির লোক ত্রাণ বা ভিজিএফ নিতে যায় না। আবার অভাবেও আছে। তাদের সংখ্যাও অনেক। এ অবস্থা বিবেচনায় ব্যাপকভাবে ওএমএস কার্যক্রম শুরুর এখনই সময়। জানা যায়, সরকার অচিরেই তা করবে। যা ঘটার ঘটে গেছে। মজুত পর্যাপ্ত থাকলে মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের বড় গলা ছোট হয়ে যেত। তা-ও বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বশেষ উচ্চপর্যায়ের সভার সিদ্ধান্ত সুফল দেবে, এটা নিশ্চিত মনে হয়।

দেখা দরকার, এই পরিস্থিতিতে ভূমিকা কাদের। সরকারের কিছু বিলম্বিত পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এই বিলম্ব ঘটিয়েছে। আলোচিত হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সুযোগ পেলেই কিছু ব্যবসায়ী মুনাফা লুটতে নেমে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপও কিছু দরকার। সরকার নিয়েছেও। ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছেন আইন ভঙ্গ করা ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের। ডিসি-এসপিরাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিলের মজুত তদারক করতে গেছেন। সবই ঠিক আছে। এর দরকারও আছে সময়ে-সময়ে। তবে এই নিবন্ধকারের লম্বা সময় ডিসি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতিতে চালভর্তি ওএমএস ট্রাকের উপস্থিতি ডিসি-এসপির উপস্থিতির চেয়ে বেশি সুফল দেয়। দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভিজিএফের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে চাল বিতরণ খোলাবাজারের ওপর চাপ কমায়।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দেশ শাসন করছে। ১৯৯৮ সালের ব্যাপক বন্যার সময়ও ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগই। তখন রাজধানীসহ দেশের ৭৫ শতাংশ স্থান পানিতে তলিয়ে ছিল মাসাধিককাল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল রেল, সড়ক ও বিমান যোগাযোগ। কোনো কোনো বিদেশি গণমাধ্যম ভবিষ্যদ্বাণী করে ২ কোটি লোক দুর্ভিক্ষপীড়িত হওয়ায়। দুজন মারা গেছে এমন কথাও আমরা শুনিনি। বাড়েনি চালের দাম। সরকারি কার্যক্রম ব্যাপক থাকায় সেই সুযোগই কেউ পায়নি। মনে হয়, শাসক দলটি তাদের আগের অগ্রাধিকার থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এই দল বরাবর নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্তের স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে আসছিল। দেখা যায়, এখন অগ্রাধিকারে আছেন বণিক ও শিল্পোদ্যোক্তারা। হয়তোবা শিল্পোন্নত ধনী দেশ হওয়ার জন্য এর প্রয়োজন আছে! তবে সরকারি পরিসংখ্যান বলে, এখনো দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নিয়োজিত আছে কৃষিতে।

সবশেষে আসে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করায় গণমাধ্যমের ভূমিকা। কোনো কোনো খবর অনেক সময় বাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলে, এতে সন্দেহ নেই। আর সরকারের খাদ্য মজুত পরিস্থিতির নিত্যদিনকার বিবরণ তো সরকারের ওয়েবসাইটেই থাকে। এটার কমতি নিয়ে লেখা তো দোষনীয় হতে পারে না। স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, শক্তিশালী গণমাধ্যম ও গণতন্ত্র কোনো দেশে থাকলে সেখানে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমরা আদৌ দুর্ভিক্ষ অবস্থার ধারেকাছেও ছিলাম না। তবে ঘাটতি ছিল সরকারি মজুতের। এগুলো আলোচনায় এনে তারা তো সরকারকে সহায়তাই করল। সরকার হাতের পাঁচ না রাখায় সংকট হয়েছে, এটা তো অসত্য নয়।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

majumderali1950@gmail.com