'নতুন স্বাভাবিক' কতটা স্বাভাবিক
গত মাস ছয়েক বিশ্ব সাংবাদমাধ্যমের বড় অংশই দখল করে রেখেছে করোনাভাইরাস। এই এক ভাইরাসকে কেন্দ্র করে কত বিচিত্র ধরনের লেখা, মতামত, বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ হয়েছে ও হচ্ছে, তার তল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো, এর চিকিৎসা, টিকা-ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা—এটা একটি দিক। আর এর বাইরে মানবজীবনের এমন কোনো দিক সম্ভবত বাদ যায়নি যার সঙ্গে করোনাকে যুক্ত করে কোনো আলোচনা বা বিশ্লেষণ হয়নি।
এই করোনাকালে বর্ণবাদবিরোধী এক বড় আন্দোলন শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। এই আন্দোলন নিয়ে বিশ্লেষণ বা পর্যবেক্ষণেও কি করোনা প্রসঙ্গ জায়গা করে নেয়নি? যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের হার কত? আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুহার কত? তারা ঠিকঠাক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে কি না—সবই আলোচনায় উঠে আসছে। ভারত-চীন সীমান্তে এক ভয়াবহ সংঘাতে ২০ ভারতীয় সৈন্যের প্রাণ গেল। দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ নতুন কিছু নয়, কিন্তু তারা সংঘাত এড়িয়ে চলছিল। করোনাকালে কেন এমন একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটল? এখানেও করোনা এসে হানা দিয়েছে। চীন ভারতের ওপর হঠাৎ কেন এতটা ক্ষুব্ধ হলো, তার অনেক কারণের মধ্যে করোনাও একটি প্রসঙ্গ। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চীনের দায় কতটুকু, তা তদন্তে ডব্লিউএইচও-কে যে দেশগুলো চাপ দিয়ে আসছে, তার মধ্যে ভারত রয়েছে। ভারতের এই অবস্থান চীনকে ক্ষুব্ধ করেছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে চীন।
আসলে করোনারকে বাদ দিয়ে এখন আমরা রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও সম্পর্ক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন, জীবিকা, পেশা, মনোজগৎ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি—কোনো আলোচনাই করতে পারছি না। বিশ্ববাসীর কাছে করোনাভাইরাস এবং এর সংক্রমণ এক অভাবিত ঘটনা। মাসের পর মাস লোকজনকে ঘরে থাকতে হবে, পৃথিবীর দেশগুলো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, আর পৃথিবীর সবচেয়ে জমজমাট নগরীগুলো এমনকি দিনের বেলাও মৃত শহরের মতো স্থবির হয়ে থাকবে, এমনটা কে কবে কল্পনা করেছিল!
‘নতুন স্বাভাবিক’-এর গ্রহণ-বর্জন
বলা হচ্ছে, করোনার আগের বিশ্ব আর পরের বিশ্ব এক থাকবে না। নতুন যে পরিস্থিতি হবে একে বলা হচ্ছে নিউ নরমাল। বাংলা করলে দাঁড়ায় নতুন স্বাভাবিক। তার মানে, করোনার আগের অনেক ‘স্বাভাবিক’ আর সামনে থাকবে না। নতুন অনেক কিছুই আমরা করব বা ঘটবে, যেগুলো করোনার আগে স্বাভাবিক ছিল না। সেগুলোই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে। সেগুলোই হবে ‘নতুন স্বাভাবিক’।
বিশ্লেষকদের বিভিন্ন লেখায় নতুন স্বাভাবিক নিয়ে নানা ধারণার কথা কথা পড়ছি। এর কতটা সত্যি হবে তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু এই নতুন স্বাভাবিকের সবকিছুই কি আমাদের গ্রহণ করতে হবে? যেসব বলা হচ্ছে সেগুলোকে কি আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নেব?
নতুন স্বাভাবিক হিসেবে এমন অনেক বিষয় উঠে আসছে যেগুলোকে তো স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন। ইতিহাসবিদ ইয়োভাল নোয়া হারারিসহ আরও অনেকের ধারণা, মহামারি-পরবর্তী বিশ্বে জনগণের ওপর রাষ্ট্রের নজরদারি চরমে পৌঁছাতে পারে, রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে আরও স্বৈরাচারী। মাথাচাড়া দিতে পারে জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে বাড়তে পারে বিচ্ছিন্নতা। এমন আরও অনেক পূর্বাভাস ও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। কোনো রাষ্ট্র বা এর শাসকগোষ্ঠী আরও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার পথ ধরতেই পারে। কট্টর জাতীয়তাবাদীরাও করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে করোনা-পরবর্তী বিশ্বে তাদের চাওয়া পূরণের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব চাওয়াকে আমরা নতুন স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ বা মেনে নেবে কি না? নাকি এগুলোকে আমাদের শুরু থেকেই অস্বীকার করে যেতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে নতুন স্বাভাবিকের নামে এসব মানা যাবে না!
এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক স্লাভো জিজেক তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘প্যানডেমিক’-এ লিখেছেন, ভাইরাস সংক্রমণের হুমকি আমাদের নতুন ধরনের সংহতির সুযোগ করে দিয়েছে। এবং ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করেছে।
পরে ‘ইসরায়েল টাইম’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, জার্মান চ্যান্সেলর বা ফরাসি প্রেসিডেন্ট এই মহামারির সময়ে যেসব সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা নিয়েছেন, তা যদি বছরখানেক আগে নিতেন তবে কমিউনিস্ট হিসেবে তাঁদের গালি শুনতে হতো। এমনকি ডেনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোককেও জনগণের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালতে হয়েছে। সরকার যখন ভেন্টিলেটর কেনে, বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ করে এবং জনগণের মধ্যে বিলিয়ন বিলয়ন ডলার বিতরণ করে, তখন তা অবশ্যই এক নতুন পরিস্থিতি। এটা সবাই জানে যে এই অর্থ আর কখনো সরকারের কাছে ফেরত যাবে না। সরকারগুলো বুঝতে পারছে তারা তাদের জনগণকে উপেক্ষা করতে পারে না।
এই মহামারি থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব, সেটাই সম্ভবত আসল কথা। অমর্ত্য সেন তো ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এ তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, লকডাউন থেকে আরও উন্নত সমাজ তৈরি হতে পারে।
মানুষ কতটা বদলাবে?
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মূল যে কৌশল তা হচ্ছে মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি। চীন যা শুরু করেছিল তা বিশ্বের সব দেশকেই কম-বেশি করতে হয়েছে বা হচ্ছে। সংক্রমণ কেটে গেলে এই বিচ্ছিন্নতার প্রভাব কী থেকে যাবে? এখন মানুষ যেভাবে ঘরবন্দী থাকছে বা সামাজিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলছে, তাকে মেনে নেওয়া বা এই পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। ফেসবুকে এক বন্ধু মন্তব্য করেছেন তাঁর পাঁচ/ছয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে। স্কুল বন্ধ, ঘরের মধ্যেই জীবন। তিনি লিখেছেন, ‘মেয়ের যে স্কুল আছে, ঘরের বাইরে যে একটি জীবন আছে, তা সম্ভবত সে ভুলেই গেছে। ঘরের মধ্যে সে দিব্যি আছে।’
পরিস্থিতি শিশুটিকে তার ঘরকেই জগৎ মানতে বাধ্য করেছে। এই পরিবর্তন যদি ‘নতুন স্বাভাবিক’ হয়ে থাকে, তবে এটা খুবই সাময়িক। বাধ্য হয়ে এখন আমরা যা করছি তা কি অভ্যাসে পরিণত হবে? আমরা তো এ থেকে মুক্তি চাইছি। পরিস্থিতি বদলে গেলে আমরা যা এখন করতে পারছি না, তা বহু গুণে করার চেষ্টা করব—এটাই তো স্বাভাবিক। সবকিছু আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব মুক্তির আনন্দে।
এখন আমরা যে জীবন যাপন করছি, তা সামাজিক নয়। অসামাজিকতাকে আমরা ‘নতুন স্বাভাবিক’ হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছি কি? যে সন্তান মা-বাবাকে সংক্রমিত করতে পারে, এই ভয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করছে না, যে ভাই-বোনেরা দূরত্ব বজায় রাখছেন, আদরের ভাগনে-ভাগনি বা ভাতিজা-ভাতিজিকে দেখার জন্য যাদের মন পুড়ছে, যে প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা নেই, সংক্রমণ কেটে গেলে তাঁরা কী করবেন? প্রিয়জনদের দ্বিগুণ শক্তিতে জড়িয়ে ধরবেন না? নাকি সামাজিক-শারীরিক দূরত্ব তাঁর মাথায় ঢুকে যাবে! সেটা হলে তো মানুষ আর মানুষ থাকবে না। এ রকম কোনো নতুন স্বাভাবিককে নিশ্চয়ই আমরা গ্রহণ করতে চাইব না।
আবার হাত ধোয়া বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধারণা যদি আমাদের মধ্যে ঢুকে যায়, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠি, তবে সেই নতুন স্বাভাবিককে স্বাগত জানাতে তো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
গৃহবন্দিত্বের নতুন স্বাভাবিক
করোনার সময় নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে এমন পরিসংখ্যান ও তথ্য পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের কণ্ঠেও এ নিয়ে উদ্বেগ শোনা গেছে। বিবৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই সময়ে দুনিয়াজুড়ে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। অনেক নারী ও তরুণী তাঁদের নিজ বাড়িতে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার হুমকির মুখে পড়েছেন। দেখা গেল, ঘরে থাকাকে করোনা থেকে মুক্তির পথ ভাবা হলেও নারীর জন্য তা ভিন্ন বিপদ ডেকে এনেছে। পুরুষ যত ঘরে থাকবে, নারী নির্যাতন তত বাড়বে—এটাই কি তবে করোনাকালের শিক্ষা?
কিন্তু এর উল্টো চিত্রও তো কম জোরালো নয়। যে পুরুষ কোনো দিন ঘরের কাজ করেননি, তিনিও গৃহকর্মে হাত লাগিয়েছেন। ঘর-গৃহস্থালি সামলানো যে কতটা কঠিন কাজ, এমন বোধোদয়ও নিশ্চয়ই অনেক সংবেদনশীল স্বামী, সন্তান ও ভাইয়ের হয়েছে। পারিবারিকভাবে একসঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর যে সুযোগ করে দিয়েছে হোম কোয়ারেন্টিন, সেটা পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ়ও তো করেছে।
যুক্তরাজ্যে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল ২ হাজার পরিবারের মধ্যে। প্রতি পাঁচজন পিতামাতার মধ্যে চারজনই বলেছেন সন্তানদের সঙ্গে লকডাউনের সময় বেশি সময় কাটানোর ফলে তাঁদের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। আর ১০ জনের মধ্যে ৬ জন বলেছেন, করোনার সময়ে তাঁরা তাঁদের স্বামী, স্ত্রী বা পার্টনারদের সঙ্গে সুখী সময় কাটিয়েছেন।
করোনাকালের গৃহবন্দিত্বের কোন অংশকে গ্রহণ করব আমরা? কোনটিকে নতুন স্বাভাবিক বলে মনে নেব, আর কোনটিকে সেই স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব তো আমাদেরই।
সামাজিক ঐক্য না বিচ্ছিন্নতা?
আমাদের সভ্যতা যেভাবে গড়ে উঠছে তার ইতিহাসে হিংসা-বিদ্বেষ বা হানাহানি এসব যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে যাওয়া। এটা গোড়া থেকেই আছে। যেকোনো দুর্যোগে আমাদের দেশে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এবারের করোনা দুর্যোগে মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই রোগটির উচ্চ সংক্রমণ চরিত্র। শুরুতে মানুষ হোঁচট খেয়েছিল। নেতিবাচক অনেক খবর আমার পেয়েছি। শুনেছি করোনা সংক্রমিতদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা-বিদ্বেষ বা স্টিগমার কথা। কিন্তু সেটা কাটতে কি খুব বেশি সময় লেগেছে?
বন্যা বা মঙ্গাদুর্গতের সাহায্যে যত সহজে নেমে পড়া যায়, করোনা দুর্যোগে সেই কাজটি সহজ নয়। এখানে সংক্রমণের ভয় আছে। বলা হয়, সাহস হচ্ছে মানুষের মহত্তম গুণ। সেই মহত্তম গুণের ওপর ভর করে এই করোনাকালে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কত মানুষের কত ধরনের উদ্যোগের কথাই না আমরা জানছি।
অনেকে বলছেন, করোনা পরবর্তী বিশ্বে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বাড়বে। আসলেই কি তাই। সংক্রমণের ভয়কে জয় করে মানুষ যখন মানুষের পাশে দাঁড়ায় তখন তা কি মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেয়? নাকি সামাজিক ঐক্য আরও জোরালো হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে?
কোনটিকে আমরা নতুন স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করব, সেই সিদ্ধান্ত আসলে আমাদের।
দেশে-দেশে সহযোগিতা, নাকি বিচ্ছিন্নতা
সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছে। করোনার কারণে সীমান্ত ও আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এর আয়ু কত দিন? অতিমারির যুগ শেষ হলেও কি তা টিকে থাকবে বা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হবে? অনেকেই বলছেন, করোনা বিশ্বায়নের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জাতীয়তাবাদী ও জনতুষ্টিবাদীদের জন্য করোনা আশীর্বাদ হিসেবে হাজির হয়েছে। পণ্য ও শ্রমের অবাধ চলাচলের বিরোধীরা দেশে দেশে আরও শক্তিশালী হবে। বলা হচ্ছে, বর্তমান অতিমারিকালে যে ধরনের সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেটা করোনা-পরবর্তী সময়ে টিকে যেতে পারে।
কিন্তু কোনো দেশের পক্ষে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে আলাদা হয়ে টিকে থাকা কতটা সম্ভব? বিশ্ব এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে এমন কিছু কার্যত অসম্ভব। করোনার প্রভাবে ভবিষ্যতে দেশগুলো বিচ্ছিন্নতার দিকে যাবে, এমন ভাবনা তাই খুব যৌক্তিক নয়। সীমান্ত আটকে রাখার নীতি করোনার আগে থেকেই অনেক দেশ গ্রহণ করেছে। এখন সংক্রমণ ঠেকানোর নামে সীমান্তকে যেসব দেশ আরও ফাঁক-ফোকরহীন করেছে, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সংক্রমণ মোকাবিলার চেয়ে রাজনীতিটাই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই রাজনীতি আগে থেকেই ছিল, তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে মাত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে তাদের সফল হওয়ার সুযোগ কতটুকু?
করোনার কারণে বিশ্ব এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে, তাতে উল্টো এটা পরিষ্কার হয়েছে যে শুধু নিজের শক্তি ও সামর্থ্যে এই ভাইরাস মোকাবিলা কঠিন। সেই বিবেচনায় বিশ্বায়নের ধারায় যে ছেদ পড়েছিল, তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাই বরং সামনে চলে এসেছে।
‘ইসরায়েল টাইমস’-এর সঙ্গে স্লাভো জিজেকের সাক্ষাৎকারের কথা আগেও উল্লেখ করেছি। সেই একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সংহতিকে বাঁচার পথ হিসেবে দেখতে হবে। এমনকি আমেরিকারও রক্ষা পাওয়ার পথ হচ্ছে বাকি দুনিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করা। আমি শুনেছি গাজায় একটি টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি মাস্কের বিপুল উৎপাদন শুরু করেছে, যার একটি অংশ ইসরায়েলে বিক্রি হচ্ছে। এটা দুপক্ষের জন্যই উইন-উইন পরিস্থিতি।’
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক মার্ক লিওনার্ড তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘কোভিড-১৯ এমন এক দীর্ঘমেয়াদি সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে কোনো একক দেশের পক্ষে একঘরে হয়ে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাকে ভবিষ্যতে অন্যের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হবে। সেই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিশ্বায়ন ঠিক কোন আদলে করলে ভালো হবে, তা নিয়েই এখন সবাইকে ভাবতে হবে।’
এই যে বিশ্বের দেশে দেশে এখন করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে বিশ্ববাসীর চাওয়া শুধু যত দ্রুত সম্ভব একটি প্রতিষেধক পাওয়া। কোন দেশ বা কোন দেশের কোম্পানি সেটি আবিষ্কার করল, তা নিয়ে কি আমাদের আদৌ কোনো দুশ্চিন্তা আছে? আমরা জানি, বিশ্বের যেখানেই এর প্রতিষেধক মিলুক, দুদিন আগে আর পরে আমরা তা পেয়ে যাব। আমাদের এই মনোজগৎ কিন্তু বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত দেয় না।
এই মহামারি ও সংক্রমণ আপাতভাবে কট্টর জাতীয়তাবাদী, জনতুষ্টিবাদী ও রক্ষণশীলদের জন্য বিচ্ছিন্নতার পক্ষে একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু উদারনৈতিক ও আন্তর্জাতিকতাবাদীদের জন্য বরং আরও বড় সুযোগ হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ, এই ধারায় ক্ষয় শুরু হয়েছিল। করোনা তা সারানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। নতুন স্বাভাবিক হিসেবে কোনটিকে আমরা স্বাগত জানাব, সেই দায় তো জনগণের।
অর্থনৈতিক মন্দা, মানা না-মানার ব্যাপার নেই
করোনার কারণে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে, তা নিয়ে অর্থনীতির পণ্ডিতেরা একমত। দুনিয়াজুড়ে একদিকে যেমন মাথাপিছু আয় কমছে, তেমনি বাড়ছে বেকারত্ব। বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরতে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে।
আমাদের মতো দেশ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। এর পরও দেশে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি। বিআইডিএস বলছে, করোনার কারণে এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও ১ কোটি ৬৪ লাখ। মানুষ চাকরি ও কাজ হারাচ্ছেন, অনেকে সামাল দিতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন। শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে ফেরা শুরু করেছে। এটা আমাদের জন্য এমন এক ‘নতুন স্বাভাবিক’ হিসেবে হাজির হচ্ছে, যা আমাদের মানা বা না মানার ওপর নির্ভর করে না। এই অবস্থা থেকে মানুষের জীবন আগের জায়গায় আসতে কত সময় লাগবে, তার হিসাব অর্থনীতিবিদেরা করবেন। সরকারও কতটা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে, সেই শর্তও এর সঙ্গে রয়েছে। এর আগ পর্যন্ত দারিদ্র্য ও অভাব-অনটনের এক নতুন স্বাভাবিক আমাদের ওপর চেপে থাকবেই।
এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপ সম্পাদক।
akm.zakaria@prothomalo.com