
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা শুরু করা বা শুরু হলে তা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি না, চালিয়ে নেওয়া হলে সেই আলোচনা থেকে ভালো ফল পাওয়া যাবে কি না, এর সবই উভয়ের বর্তমান সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে।
দুঃখজনকভাবে আজ এই তিন ক্ষেত্রেই অবস্থা খুব হতাশাজনক। কারণ, দুই দেশের শাসকগোষ্ঠীর কেউই বড় সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিক সংলাপে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। পাকিস্তান যেহেতু তুলনামূলক ছোট দেশ, তাই তার উচিত ছিল উত্তেজনা কমানোর জন্য আরও উদ্যোগী হওয়া। কিন্তু সাম্প্রতিক চার দিনের সীমান্ত সংঘাতের পর দুই দেশই সংলাপের ব্যাপারে আরও অনাগ্রহী এখন।
জনগণ বা বিরোধী দলগুলোর তরফ থেকেও সংলাপ চাওয়ার মতো তেমন কোনো চাপ নেই। এখন দ্বিতীয় দফায় আবার সংঘাত হবে কি না, সেই প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে। ফের সংঘাত হলে তার ফলাফল কী হতে পারে? এটি এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। কারণ, দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী এবং সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে সেটি কেবল সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রযুক্তিগত চমক বা নতুন যুদ্ধকৌশল যেকোনো সময় পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে। এই কারণেই সংলাপের সব সম্ভাবনা খুঁজে দেখা উচিত।
কিন্তু বাস্তবে এমনকি অভিজ্ঞ কূটনীতিকদের মাঝেও এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায় না। কারণ, দুই দেশের রাজনৈতিক ভাষ্য এতটাই পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠেছে, বর্তমান অচলাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার খরচও কম মনে হয়, সংলাপ শুরু করার রাজনৈতিক ঝুঁকির চেয়ে।
সম্প্রতি এক সাবেক পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক ভারতীয় সাংবাদিকের সাক্ষাৎকারে আমরা দেখি—সাংবাদিকের প্রশ্ন ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছে, আর মন্ত্রীর উত্তরে ছিল পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি। কোনো পক্ষই গঠনমূলক আলোচনায় আগ্রহী নয়।
ভারতের অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা ধরে রাখে, কারণ এটি তাদের দেশীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আবার পাকিস্তানিরাও বলে, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদ, পাকিস্তানবিরোধিতা, কাশ্মীর নিয়ে আপস না করার মনোভাব এবং পানির প্রবাহ থামিয়ে দেওয়ার হুমকি সম্পর্ক উন্নয়নে বড় বাধা।
দুই দেশেই অনেক বড় বড় সমস্যা আছে। যেমন পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা রোধ, জলবায়ু সমস্যার ভয়াবহতা থেকে বাঁচা, সুশাসন, মানবাধিকার, উন্নয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়াকে বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত করা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তন এবং সার্কের পুনরুজ্জীবন জরুরি। কিন্তু উভয়ের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গিই বদলাতে হবে।
ভারত মনে করে, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র যার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রাখা অর্থহীন। অন্যদিকে পাকিস্তান মনে করে, ভারত একটি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আগমন ভারতকে অস্থির করে তুলেছে (যেহেতু ভারতকে চীন মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র)।
এই বাস্তবতায় দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধ্বংসাত্মক কাজ করছে। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতা, নীতিনির্ধারক, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী, কবি, লেখকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা। তাঁদের বুঝতে হবে, দুই দেশের টিকে থাকার স্বার্থেই পারস্পরিক নীতিকে মানবিকভাবে পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। এখন এর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, দুই দেশের রাজনীতি জনকল্যাণের বদলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখার দিকে বেশি ঝুঁকে আছে। উভয় দেশই অতীতে অনেক ‘আস্থা তৈরির উদ্যোগ’ নিয়েছে। তার কিছুর বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছুর হয়নি।
ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের পরস্পরের দেশে সফর করা উচিত। সফরের উদ্দেশ্য হবে বিশ্বাস তৈরি, পারস্পরিক উদ্বেগ নিয়ে খোলামেলা আলোচনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার বাস্তব সুযোগ চিহ্নিত করা। এটি দুই দেশের জনগণের মধ্যে একটি ইতিবাচক ও স্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি গড়তে সহায়ক হবে।
আমলারা, কূটনীতিকেরা এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা পরিবর্তন আনতে পারবেন না। ভারতের অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা ধরে রাখে, কারণ এটি তাদের দেশীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আবার পাকিস্তানিরাও বলে, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদ, পাকিস্তানবিরোধিতা, কাশ্মীর নিয়ে আপস না করার মনোভাব এবং পানির প্রবাহ থামিয়ে দেওয়ার হুমকি সম্পর্ক উন্নয়নে বড় বাধা।
ভারত ও পাকিস্তানে সব পেশার কিছু ভালো মানুষ আছেন, যাঁরা শত্রুতা বন্ধ দেখতে চান। কিন্তু তাঁরা সম্মিলিতভাবে তেমন শক্তি নন যে তাঁরা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারবেন।
আশরাফ জাহাঙ্গীর কাজী যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত