রাজধানী ঢাকায় বসন্তের প্রথম দিনই আপনি ইচ্ছা করলে মাধবীর দেখা পেতে পারেন। কারণ, মাঘ মাসের কয়েকটা দিন হাতে থাকতেই রমনা পার্কে মাধবী ফুটতে শুরু করে। ইচ্ছা করলে সেই মাধবীর মধুরিম সুবাস নিতে নিতে চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত উৎসবেও যোগ দিতে পারেন। সেখানে প্রতিবছরই নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আবহমান বাংলার ঋতুগুলোকে উদ্যাপনের একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়। দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করলে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, হাতিরঝিল ও জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে হাতে গোনা শিমুল-পলাশের দেখা পাবেন।
শহরজুড়ে বসন্ত-ফুলের সংখ্যা যাচাইয়ের চেষ্টা করলেও আপনি অবশ্যই সফল হবেন। কারণ, খুব বেশি পরিশ্রম ছাড়াই নগণ্য সংখ্যাটি আপনি বলে দিতে পারবেন। এ অবস্থায় শহরে বসন্ত এল না গ্রীষ্ম এল, তা কী করে বুঝবেন আপনি! নির্দ্বিধায় বলা যায়, এখানে আমাদের প্রিয় ঋতুগুলোর মাধুর্য ও বর্ণাঢ্যতা প্রায় অনুপস্থিত। সব বিবেচনায় আপনি ধরেই নিতে পারেন, এই শহরে কোনো ঋতু আসে না! ঢাকায় ঋতু নিয়ে আমাদের দৌড় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ বা চারুকলার বকুলতলা পর্যন্তই। ছয় ঋতুর এই দেশে এটুকুই?
কিন্তু গ্রামে বর্ণিল প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর শহরে এসে ঋতুবৈচিত্র্যকে ছুঁয়ে দেখতে না পারার যে আকুতি, তা কি নগর কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছায়? বসন্ত এলে গ্রামে দূরদিগন্তে শিমুল-পলাশের ডালে ডালে রক্তিম ফুলের উন্মাদনা দেখে, বদলে যাওয়া বাতাসের গতিপ্রকৃতি অনুভব করে, দক্ষিণের আলুথালু বাতাসে শিহরিত হতে হতে যে জীবনটা আমরা পেরিয়ে আসি, এখানে তার ছিটেফোঁটাও উদ্যাপনের সুযোগ নেই। রাজধানী শহর কি আমাদের ঋতু উদ্যাপনের বা প্রকৃতিকে অনুভব করার মতো একটি আয়োজনও রাখতে পেরেছে?
ছয় ঋতুর একটি দেশের এমন বৃক্ষহীন বিবর্ণ ও হতশ্রী রাজধানী হতে পারে, যা একেবারেই অবিশ্বাস্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত। শহর কতটা নান্দনিক ও প্রকৃতিবান্ধব হবে, তা নির্ভর করে উদ্ভিদের সার্বিক উপস্থিতির ওপর। একটি শহরে সবই আছে, কিন্তু নেই কোনো উদ্ভিদ আয়োজন, তাহলে সেই শহরকে কি মানসম্পন্ন শহর বলা যাবে?
দুই মেয়রকেই ঢাকায় পরিকল্পিত সবুজায়নের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম। পাশাপাশি রাজধানী শহরকে ছয় ঋতুর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আসলে তাঁদের ঘিরে রেখেছে একটি শক্ত বলয়, যা ভেদ করে আমাদের আর্তনাদগুলো তাঁদের কানে পৌঁছায় না। তবু আমরা আশা জিইয়ে রাখতে চাই। ভাবতে চাই, প্রাণের ঢাকা অচিরেই সবুজ-শ্যামল ঋতুবান্ধব একটি রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে উঠবে।
সম্প্রতি ঢাকা শহরের এই উদ্ভিদহীনতার বিষয়টি সামনে এসেছে আবার। ২১ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘সবুজহীন নগর হচ্ছে ঢাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরে যতটা সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, আছে তার অর্ধেকের কম। আবার যেটুকু সবুজ আছে, সেটুকু এলাকাও সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নগরবাসী এর সুবিধা পায় না।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ আয়োজিত ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক সেমিনারে অতিথিরা এসব কথা বলেন। গবেষণা বলছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ ভাগের কম।
এ ক্ষেত্রে সবুজ বা উন্মুক্ত জায়গায় বাণিজ্যিক কার্যক্রমও একটি বাধা। গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা গোচরে আনা হয়। তাতে বলা হয়, রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও বিএফডি ঢাকার সবুজ জায়গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
তবে সবুজ জায়গা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে রাজউকের বিরোধ রয়েছে। আবার সিটি করপোরেশন অনেক ক্ষেত্রে মুনাফা করার জন্য সবুজ জায়গায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকার সবুজায়নের ক্ষেত্রে এমন একাধিক সংস্থার টানাপোড়েন আদতে একটি গুরুতর সমস্যা। অচিরেই সংস্থাগুলোর মধ্যে আন্তসমন্বয় তৈরি হওয়া জরুরি।
২৩ মার্চ প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগেও ‘রাজউক ও দুই সিটি করপোরেশন কী করছে’ শিরোনামে ঢাকায় বৃক্ষায়নের বিষয়ে পত্রিকাটির নিজস্ব মতামত তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে Ñসঠিক পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন সম্ভব হলে সবুজ আচ্ছাদন বাড়ানো যাবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে বড় উদাহরণ হাতিরঝিল।
বর্তমান সময়ে বুয়েটের গবেষণায় বৃক্ষহীন ঢাকার যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, নিসর্গী ও উদ্ভিদবিদেরা তাঁদের আগাম পর্যবেক্ষণে অনেক আগেই এমন দুর্যোগের আশঙ্কা করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা তুলে ধরেছিলেন। দুই সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। ২০১৬ সালে ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বৃক্ষায়নের কাজটি শুরু করেছিলেন।
কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে মোটাদাগে একটি উদ্ভিদ তালিকাও তৈরি করে দিয়েছিলাম। উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তুতি সভাও হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নানান সমস্যার আবর্তে পড়ে উদ্যোগটি থেমে যায়। তার কিছুদিন পরই আরেকটি সুযোগ তৈরি হয়। দুই সিটি করপোরেশনের পার্কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু এই সংস্কার কার্যক্রমের সিংহভাগজুড়েই ছিল অবকাঠামো নির্মাণের তোড়জোড়। যেখানে পার্কের প্রধান অনুষঙ্গই উদ্ভিদ, সেখানে উদ্ভিদের বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়। বিপুল অর্থ ব্যয়ের এই আয়োজন দেখে মনে হয়েছে মানুষ পার্কে গিয়ে শুধু দালানকোঠাই দেখবে! সিটি করপোরেশন এই কর্মপরিকল্পনায় কোনো অভিজ্ঞ বৃক্ষবিদ বা প্রাণিবিদকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন মনে করেনি। প্রহসন আর কাকে বলে!
দুই মেয়রকেই ঢাকায় পরিকল্পিত সবুজায়নের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম। পাশাপাশি রাজধানী শহরকে ছয় ঋতুর শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও প্রস্তাব রেখেছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। আসলে তাঁদের ঘিরে রেখেছে একটি শক্ত বলয়, যা ভেদ করে আমাদের আর্তনাদগুলো তাঁদের কানে পৌঁছায় না। তবু আমরা আশা জিইয়ে রাখতে চাই। ভাবতে চাই, প্রাণের ঢাকা অচিরেই সবুজ-শ্যামল ঋতুবান্ধব একটি রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে উঠবে।
● মোকারম হোসেন প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক-তরুপল্লব
tarupallab@gmail.com