গত মে মাসে রিয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মোহাম্মদ বিন সালমান
গত মে মাসে রিয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মোহাম্মদ বিন সালমান

মতামত

ফিলিস্তিন নিয়ে সৌদি আরব এবার সাহস দেখাবে কি

গত মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ যখন ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তখন ট্রাম্প বিষয়টিকে তুচ্ছ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর ব্রিটেনও একই পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। ট্রাম্প সেটিকেও গুরুত্ব দেননি। জার্মানি সম্প্রতি ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। ট্রাম্প সেই সিদ্ধান্তকেও আমলে নেননি।

বরং তিনি গত সপ্তাহে নেতানিয়াহুকে এবং নিজেকেও যুদ্ধাপরাধী নয়, বরং যুদ্ধনায়ক হিসেবে আখ্যা দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে মতবিরোধ আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন। একই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আলাস্কা সফরের সময় তাঁকে ‘লালগালিচা’ সংবর্ধনা জানিয়ে তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট সদয় আচরণ করেছেন।

ইউরোপীয় নেতারা যতই প্রশংসা বা চাটুকারিতার মাধ্যমে এসব বিরোধ আড়াল করার চেষ্টা করুন না কেন, তা প্রায়ই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুর ক্ষেত্রে সমস্যাটি ভিন্ন ধরনের। কারণ, এই বিরোধ আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই প্রকাশ্যে আসবে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে ৯ সেপ্টেম্বর। সেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যদি এর আগে ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে না পারে এবং ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি না দেয়, তবে তারা পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হলেও বর্তমান ইসরায়েলি সরকার যে দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি দেবে, তার সম্ভাবনা নেই। মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির জন্য যে আলোচনা চলছে, তা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে বলা হচ্ছে, এটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে এটি শেষ পর্যন্ত নির্ভর করছে ইসরায়েলের শর্তের ওপর, যা অনুযায়ী হামাসকে অস্ত্র জমা দিতে হবে।

যুদ্ধবিরতি আলোচনা নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলো, হামাস হয়তো ১৯৯০-এর দশকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি বা আইআরএর মতো পথ বেছে নিতে পারে। হামাস নামটি আরবি একটি সংক্ষিপ্ত রূপ, যার পূর্ণরূপ ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স মুভমেন্ট।

গাজায় যুদ্ধ এবং দুই রাষ্ট্র সমাধান নিয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থান বদলানোর একমাত্র উপায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সরাসরি নিন্দা। কিন্তু এর কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্পকে মনোযোগী করতে পারবে কেবল আরব দেশগুলোর নেতাদের প্রতিনিধিদল, যার নেতৃত্ব দিতে হবে সৌদি আরবকে। তাই আগামী মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন অত্যন্ত সরব এবং বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আইআরএ সেই সময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই ছেড়ে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়েছিল। ইসরায়েলও হামাসের কাছ থেকে একই রকম পদক্ষেপ আশা করছে। যদি হামাস এ শর্ত মেনে নেয়, তবে তাদের পুরস্কার হিসেবে প্যালেস্টাইনি ন্যাশনাল কাউন্সিলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এটি চলতি বছরের শেষ নাগাদ হতে পারে।

তবে আইরিশ পরিস্থিতির সঙ্গে হামাসের তুলনা পুরোপুরি সঠিক নয়। ১৯৯৮ সালে আইআরএ শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে অস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে সম্মত হয়েছিল। তবে তারা শর্ত দিয়েছিল, এটি হবে কেবল চুক্তির অন্যান্য অংশ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের পর। বাস্তবে আইআরএর অস্ত্র ধ্বংস বা জমা দিতে সাত বছরের বেশি সময় লেগেছিল এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে এখনো অনেকে বিশ্বাস করে না, আইআরএ বা তাদের প্রোটেস্ট্যান্ট প্রতিদ্বন্দ্বীরা সব অস্ত্র ত্যাগ করেছিল। এ কারণেই ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস যুদ্ধবিরতির আগে অস্ত্র জমা দিক, পরে নয়।

এখন মূল প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলি সরকার গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কত দিন আগ্রহী। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে পুতিনের মতোই নেতানিয়াহুরও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে বলে মনে হয়।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সরকার পশ্চিম তীরে নতুন একটি বসতি স্থাপন পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে। এটি ওই অঞ্চলকে দুই ভাগে ভাগ করে দেবে। এই সিদ্ধান্ত দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি তাদের অবজ্ঞাকে স্পষ্ট করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন এটি দুই রাষ্ট্র সমাধানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। জার্মানিও এই নিন্দায় যোগ দিয়েছে।

গাজায় যুদ্ধ এবং দুই রাষ্ট্র সমাধান নিয়ে নেতানিয়াহুর অবস্থান বদলানোর একমাত্র উপায় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সরাসরি নিন্দা। কিন্তু এর কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্পকে মনোযোগী করতে পারবে কেবল আরব দেশগুলোর নেতাদের প্রতিনিধিদল, যার নেতৃত্ব দিতে হবে সৌদি আরবকে।

তাই আগামী মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন অত্যন্ত সরব এবং বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশ যদি চায়, তাদের ফিলিস্তিন স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত আরব রাষ্ট্রগুলোকে প্রভাবিত করুক, তবে তাদের জোরালো অবস্থান নিতে হবে।

সাধারণত আরব দেশগুলোর কূটনৈতিক ধরন সংযত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি আরব রাষ্ট্রগুলো সাহস দেখিয়ে ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা না করে, তবে গাজার যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠবে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি কার্যকর সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন চিরতরে দাফন হয়ে যাবে।

  • বিল এমট দ্য ইকোনমিস্ট–এর সাবেক সম্পাদক

    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ