৩০ নভেম্বর ক্যালেণ্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। কারণ এটি এমন একজন মহান শিক্ষকের জন্মদিন যিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা শিক্ষার ইতিহাসের একটি বড় জায়গা দখল করে আছেন।
তিনি অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান। তাঁর হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় স্নাতক কোর্সের সূচনা হয়েছিল।
আসলে তিনি আমাদের কাছে শুধু একজন শিক্ষকই নন, তিনি ‘শান্তির জন্য সাংবাদিকতা’ চর্চার এক আলোকবর্তিকা।
তাঁর প্রজ্ঞা, সত্যান্বেষণ আর মানবিকতার দীপ্ত আলো তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের যোগাযোগ-সাংবাদিকতার পেশাগত জীবনে।
৩০ নভেম্বর ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করা আমাদের এই শিক্ষাগুরু একাধারে সত্যান্বেষী সাংবাদিক, সাহিত্যসাধক, সমাজ-সংগঠক, গবেষক এবং মানবিক ধারার সাংবাদিকতা শিখনচর্চার অগ্রপথিক।
তাঁর ভাষায়, ‘সাংবাদিকতা শুধু পেশা নয়, এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব। যুদ্ধের সময় আমি শিখেছি—সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই সাংবাদিকতার মূল শক্তি।’
নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধনুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা কলেজিয়েট সরকারি হাইস্কুল এবং ঢাকা কলেজ থেকে পর্যায়ক্রমে তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। অধ্যাপক খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান), এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রাবস্থাতেই সাখাওয়াত আলী খান সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি সাংবাদিকতার মূল স্রোতে কাজ করেছেন। প্রতিবেদক থেকে শুরু করে সম্পাদনা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই তাঁর পেশাদারি দক্ষতা তাঁকে অনন্য এক সংবাদসৈনিকের মর্যাদার আসনে আসীন করে।
সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাচর্চার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার সোনালি অধ্যায় থেকে পেশাগত জীবন-দর্শনের মর্ম সন্ধান করা যায়।
স্যারের ভাষায়, ‘দৈনিক বাংলায় কাজ করার সময় আমরা জানতাম, সত্য লিখতে গেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। তবু লিখেছি, কারণ ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের আত্মপ্রকাশকাল থেকেই তিনি এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত।
১৯৬২ সালে বিভাগের পথচলার শুরুতেই এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পাশাপাশি একই বছরে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন।
ডিপ্লোমা পাশের সাত বছর পর ১৯৬৯ সালে বিভাগে এমএ প্রোগ্রাম চালু হলে এমএ শেষ পর্বে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি সাংবাদিকতায় মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যারের নিজ বাড়িটি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পরিণত হলে স্যার গেরিলাযোদ্ধাদের সংগঠক ও পরামর্শক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখার সুযোগ পান।
যুদ্ধ শেষে পরীক্ষার ফল বের হলে সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচ থেকে তিনি কৃতিত্বসহকারে এমএ উত্তীর্ণ হন।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক ডিসিপ্লিনের শিক্ষাগত ভিত্তি তাঁকে গড়ে তোলে এক বহুমাত্রিক চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
বিভাগে স্যারের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের চার বছরের মাথায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ।
দুই দফায় বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগটিকে নানা বাধাবিপত্তির মধ্যে সময়োপযোগী উত্তরণ ঘটিয়ে আপন আলোয় সমৃদ্ধতর বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাঁর হাত ধরে দিন দিন বিভাগটি সম্প্রসারিত হতে থাকে।
প্রথমবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিভাগে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। বিভাগের নাম সাংবাদিকতা থেকে পরিবর্তিত হয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা হয়।
স্যারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে সন্ধ্যার ক্লাস চালু হয় দিনে। আর ১৩ বছর ধরে চলার পর এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স বন্ধ হয়ে বিভাগে স্যারের হাত ধরে চালু হলো তিন বছর মেয়াদি বিএ (অনার্স) কোর্স, যা অনেক পরে এসে হয়েছে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ‘সম্মান’ প্রোগ্রাম।
স্যারের ক্লাস ছিল তাঁর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছে এক একটি আনন্দপাঠ। শ্রেণিকক্ষ স্যারের কাছে কেবল বক্তৃতা দেওয়ার জায়গা নয়, এটি তাঁর কাছে আনন্দচিত্তে বুদ্ধিমত্তা ও মূল্যবোধ শেখানোর পাশাপাশি প্রজ্ঞা ও জীবনদক্ষতা জাগ্রত করার অনুকূলে স্বাধীন চিন্তার চর্চা করানোরও এক উম্মুক্ত মঞ্চ।
শ্রেণিকক্ষে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানবিক রসবোধাসম্পন্ন ধী-শক্তির অধিকারী মানুষটি গবেষণাতেও একইভাবে মানবিক ও ধৈর্যশীল।
তিনি তাঁর শিষ্যকে শুধু গবেষণার তত্ত্ব শেখান না, তিনি গবেষকের চরিত্র গঠনেও অপার ভূমিকা রাখেন। জ্ঞান, নৈতিকতা আর মানবিকতার এক ত্রিবেণী-সংযোগ ঘটেছে আমাদের সবার প্রিয় ’সাখাওয়াত স্যারের’ চুম্বকীয় ব্যক্তিত্বে।
সুদীর্ঘ তিন যুগ পূর্ণকালীন শিক্ষকতা করে ২০০৮ সালে বিভাগের সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপক পদ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করলেও বিভাগের শিক্ষকতার দায়িত্ব ও মায়ার বাঁধন থেকে তিনি নিজেকে আজও গুটিয়ে নিতে পারেননি।
বিভাগে পাঁচ বছর সুপারনিউমারারি প্রফেসর থাকার পর অদ্যাবধি ‘অনারারি প্রফেসর’ তথা বিভাগটির আলোর বাতিঘররূপে প্রফেসর খানের অবদান ‘একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি’র মুক্তাঙ্গনে যেন নক্ষত্রের আলোয় দীপ্তমান।
পেশাগত ও সামাজিক উন্নয়ন সহায়ক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ড. সাখাওয়াত আলী খান গণমাধ্যমজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম।
একজন সফল শিক্ষক, প্রশিক্ষক, গবেষক ও লেখক হিসেবে তিনি সর্বমহলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিজিটিং স্কলার ছিলেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে গণযোগাযোগে শিক্ষকতা করেছেন প্রায় ১২ বছর। অধ্যাপক খান তাঁর নিয়মিত শিক্ষকতা পেশা ছাড়াও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, একাডেমি এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমবিষয়ক পাঠ দিয়ে থাকেন।
তাঁর তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন অনেক গুণীজন। সাংবাদিকতার শিক্ষক হলেও সাখাওয়াত আলী খানের অধীনে পরিচালিত হয় ‘তথ্যক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের তথ্য অভিগম্যতা : তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন-পূর্ব ও পরবর্তী পরিস্থিতির বিশ্লেষণ’ শীর্ষক তথ্য অধিকার আইনের ওপর দেশের প্রথম পিএইচডি গবেষণা।
বেশ কয়েক বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষককের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দেশি-বিদেশি গবেষণা জার্নাল ও বইয়ে তাঁর প্রকাশিত ৩০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক খান দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমবিষয়ক বহু সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন এবং এ প্রক্রিয়ায় ৫টি মহাদেশের অন্তত ১৫টি দেশ তিনি সফর করেছেন।
তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান এবং সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গ্রিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম যোগাযোগ বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তাঁর রয়েছে অনন্য অবদান। তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা গণযোগাযোগ বিভাগের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়া মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (সামা) সহসভাপতি এবং বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।
তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে প্রকাশিত ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য এবং বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস জার্নালের সম্পাদকীয় বোর্ডের উপদেষ্টা ছিলেন।
অধ্যাপক খান উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে শহীদ আসাদের স্মৃতি রক্ষায় গঠিত আসাদ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর লেখা তাঁর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস-এর অষ্টম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গৌরব ও সৌরভ ছড়িয়ে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মহান শিক্ষাগুরু তথা অগ্রদূত তিনি।
তিনি বাংলাদেশের প্রেস ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতির সদস্য তিনি।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা।
অধ্যাপক খান উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে শহীদ আসাদের স্মৃতি রক্ষায় গঠিত আসাদ পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে গণহত্যা ও নির্যাতনের ওপর লেখা তাঁর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস-এর অষ্টম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের গৌরব ও সৌরভ ছড়িয়ে দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের মহান শিক্ষাগুরু তথা অগ্রদূত তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে মন্ত্রী, সচিব, সম্পাদক, বিচারকসহ রাষ্ট্রের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদে এই মহান শিক্ষাগুরুর কৃতী শিক্ষার্থীরা তথা সফল শিষ্যরা রেখে চলেছেন অব্যাহত অবদান।
আজ ৩০ নভেম্বর ২০২৫ আমাদের শিক্ষাগুরু চির তারুণ্যের প্রতিনিধি অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খান স্যারের ৮৫তম জন্মদিন।
সাংবাদিকতার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম মায়ার বাঁধনে আমাদের প্রিয় সাখাওয়াত স্যারকে আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল দেখতে চাই আরও বহুকাল, অনাগত যুগ ধরে।
আপনার শুভ এই জন্মদিনে আপনি সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, আরও বহু বছর আমাদের পথ দেখান—এই কামনা সবার পক্ষ থেকে।
আপনি আমাদের সবার স্যার। আপনি আমাদের সাংবাদিকতা শিখন-আলোর বাতিঘর! জন্মদিন শুভ হোক, প্রিয় সাখাওয়াত স্যার।
ড. মো. অলিউর রহমান, তথ্য অধিকার ও গণমাধ্যম গবেষক; সহযোগী অধ্যাপক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
ইমেইল: draliur@gmail.com