ভোলা সাইক্লোন, ১৯৭০
ভোলা সাইক্লোন, ১৯৭০

মতামত

’৭০–এর সাইক্লোনের ভয়াবহতা কেন আমরা ভুলে গেলাম

‘মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই; জল থই থই তীরে কিছু নেই নেই; ভাঙনের যে নেই পারাপার; তুমি আমি সব একাকার; মেঘ থম থম করে কেউ নেই নেই।’

১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সীমানা পেরিয়ে’ নামক বাংলাদেশি একটি চলচ্চিত্রে গাওয়া ভূপেন হাজারিকার গানের অংশবিশেষ। চলচ্চিত্রটি একই বছরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতাসহ মোট চারটি বিভাগে এবং দুটি বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেছিল। এ ছাড়া ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থানও লাভ করেছিল ছবিটি।

১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল; তৎকালীন ঢাকার সংবাদপত্রে এমন খবর প্রকাশিত হয়।

চরে একজোড়া নারী-পুরুষের বেঁচে থাকা ও বসবাসের বিষয়টি পরিচালক আলমগীর কবিরের দৃষ্টিতে সবার থেকে আলাদা মনে হয়। সেই থেকে তিনি এ ঘটনাটি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কথা ভাবেন এবং ১৯৭৫ সালে তিনি এটির নির্মাণকাজ শুরু করেন।

আজ চলচ্চিত্রটি একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের পেছনে রয়েছে নির্মম আরেক ইতিহাস। সেটি ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, শুক্রবার। উপকূলের জীবন ইতিহাসের এক ভয়াবহ কালরাত। এদিন প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য লাশ আর এক কোটি মৃত গবাদিপশু। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখো মানুষ। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরান জনপদে পরিণত হয়।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত মনপুরা ঘুরে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে ২৮ ফুট লম্বা ‘মনপুরা ৭০’ নামে একটি শিল্পকর্ম চিত্রিত করেন। জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘মনপুরায় আমরা যখন থার্ড ডেতে নামলাম, সি-প্লেনে আমি আর আমার বন্ধু একা ঘুরতাছি সারা দিন। কয়টা লোক বাঁইচা আছে দেখলাম। দৌড়ায় আসল। দেখলাম জখমওয়ালা। তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম। আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার পেছনে...সমুদ্র...ঠিক সমুদ্র না সমুদ্রের খাঁড়ি, যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’

সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য মৃতদেহ। এসব মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখো মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার কথা শুনলে আজও অনেকে শিউরে ওঠেন। প্রবীণেরা বর্ণনা দিতে গিয়ে জয়নুল আবেদিনের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠেন। এ রকম হাজারো মর্মস্পর্শী ইতিহাস রয়েছে উপকূলের এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ঘিরে। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এই ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে।

সাগর-নদী-খাল-বিলে ভেসে ছিল অসংখ্য মৃতদেহ। এসব মৃতদেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখো মানুষ। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার কথা শুনলে আজও অনেকে শিউরে ওঠেন। প্রবীণেরা বর্ণনা দিতে গিয়ে জয়নুল আবেদিনের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠেন। এ রকম হাজারো মর্মস্পর্শী ইতিহাস রয়েছে উপকূলের এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ঘিরে। জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এই ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে।

উপকূলে যে ভয়াবহতা হয়েছে, তা এই প্রজন্মের মানুষ জানে না। এই দিন দিবস হিসেবে পালন করলে হয়তো এ প্রজন্মের মানুষ মনে রাখত। প্রাথমিকভাবে উপকূল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’-এর দাবি ওঠে। আমরা চাই একটি দিবস, যার নাম হবে ‘উপকূল দিবস’। বাংলাদেশে ‘উপকূল দিবস’ শুরু হলে বিশ্বে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি দিবস পালন করা হবে। বর্তমান সময়; আগামী দিনের ইতিহাস। আর বিশেষ কোনো ‘দিবস’ মানেই যার মাধ্যমে প্রতিবছর আগের ইতিহাসকে স্মরণ করা। তেমনি একটি দিবস হোক ‘উপকূল দিবস’।

পত্রিকার পাতায় ভোলা সাইক্লোনে ক্ষয়ক্ষতির খবর

উপকূল দিবসের প্রাসঙ্গিকতাই–বা কেন? দেশের ৭১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ঝড়ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই ‘উপকূল’। উপকূলীয় অঞ্চলে ১৯টি জেলা ও ১৪৭টি উপজেলায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। তাদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। বন্যা, খরা, ঝড় ও তাপপ্রবাহের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের (প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা) আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। খাদ্যচাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশই বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে দেশে; যার সিংহভাগই উপকূলে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সমুদ্রের মৎস্য সেক্টর পুরোপুরি উপকূলকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের কলকারখানার পাশাপাশি উপকূলের মৎস্য সেক্টর এবং উপকূলের জনশক্তি দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে।

গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে উপকূলীয় অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষদের ভূমিকাও কম নয়। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষদের কথা বিবেচনা করে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা, এনজিও, গণমাধ্যমসহ সবাই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রত্যাশা করবেন নিশ্চয়ই। উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা ও জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ ও ‘বিশ্ব উপকূল দিবস’ দাবি প্রতিষ্ঠিত হলে আরও একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হব আমরা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

ভূপেন হাজারিকার ‘দূরের আর্তনাদের নদীর, ক্রন্দন কোনো ঘাটের, ভ্রুক্ষেপ নেই, পেয়েছি আমি, আলিঙ্গনের সাগর। সেই সাগরের স্রোতেই আছে, নিশ্বাসেরই ছোঁয়া, আছে ভালোবাসা, আদর।’ উপকূলের অবস্থা ঠিক তা–ই। সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। ’৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় স্রোতের নিশ্বাসের ছোঁয়া, ভালোবাসা ও আদর যুগ যুগ ধরে অবহেলিত। গত ২০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই প্রভাব মোকাবিলা না করা হলে, জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ কমে যেতে পারে এবং কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। ৫৬ বছর পর এই দিনটিকেই ‘উপকূল দিবস’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন সূচনা হোক।

  • এম আমিরুল হক পারভেজ চৌধুরী উপকূল গবেষক এবং চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন। ই-মেইল: ahcparvezdu@gmail.com