মতামত

আরো অনেকের মতো আমিনউদ্দিনের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি

মো. আমিনউদ্দিন পেশায় ছিলেন বিজ্ঞানী। ঢাকা বিজ্ঞান গবেষণাগারের (এখন সায়েন্স ল্যাব নামে সর্বাধিক পরিচিত) উচ্চতর গবেষণা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে, সহায়তা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এসব কারণে পাকিস্তানপন্থী সহকর্মীরা একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল রাজাকার-আলবদরদের হাতে। তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আমিন তাঁকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছিলেন, যা রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য সেই লেখা কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত ড. আমিনউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন বলে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর অন্য অনেক দেশপ্রেমিক বাঙালি বীর সন্তানের মতো হানাদার পাকবাহিনীর দোসর ধর্মোন্মাদ আলবদরদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। শহিদ ড. আমিনউদ্দিন পেশায় ছিলেন বিজ্ঞানী; কর্মরত ছিলেন ঢাকা বিজ্ঞান গবেষণাগারের ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা পদে।

ধীশক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. আমিনউদ্দিন তাঁর অবসর সময় কাটাতেন সাহিত্যচর্চা আর মানবেতিহাস পাঠ করে। তাঁর পাঠানুরাগ ছিল ঈর্ষণীয়। এই অসাধারণ গুণসম্পন্ন বিনয়নম্র মানুষটির গুণমুগ্ধ কয়েকজন সহকর্মী বন্ধু এখনো সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে কর্মরত রয়েছেন।

তরুণ বিজ্ঞানী ড. আমিনউদ্দিন ছিলেন রাজনীতি সচেতন, কিন্তু কোনো বিশেষ দলভুক্ত ছিলেন না। সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে সেই ষাটের দশকে মার্কসীয় মতবাদপুষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে বন্ধুমহলে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে আলোচিত। সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল ড. আমিনউদ্দিন বরাবরই পশ্চিম পাকিস্তানের মার্কিনি লেজুড়বৃত্তি ও বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যের সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন।

ষাটের দশকে মোনেমি সাম্প্রদায়িকতা যখন সমগ্র বাংলাদেশকে এক হানাহানির ঘূর্ণাবর্তে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ করে দিয়েছিল তখনই তিনি তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের বলতেন, বাঙালিদের একদিন পশ্চিমি নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতেই হবে।

পরিতাপের বিষয়, যাঁদের তিনি একথা বলতেন তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন ধর্মাদ্ধ ও জাতিসত্তাহীন। এইসব ধর্মোন্মাদ সহকর্মীর অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের গোপন যোগাযোগের সূত্রেই ড. আমিনউদ্দিনের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর দালাল আলবদরদের তালিকায়। আমরা হারালাম একজন বিজ্ঞানানুরাগী, সাহিত্যসেবী, প্রগতিবাদী উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বাঙালিকে।

ড. আমিনউদ্দিনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৯ই জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউড়িতে, পিতা মোহাম্মদ কাইউম। ভারত বিভাগের পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় তিনি তাঁর চাচার সঙ্গে পাবনার কালাচাঁদ পাড়ায় চলে আসেন। ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড, ঢাকা থেকে ১৯৫৪ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি, ১৯৫৮ সালে বিএসসি (সম্মান) দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং ১৯৬০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি পাস করেন।

এরপর কিছুদিন এডরুক ওষুধ কোম্পানিতে রসায়নবিদ হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রসায়নবিদ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে বিভাগীয় বৃত্তি লাভ করে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন যান; সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব ব্র্যাডফোর্ড থেকে ১৯৬৮ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে উচ্চতর গবেষণা কর্মকর্তা পদে যোগ দেন।

চার বছর বিদেশে অবস্থানকালে দেশের ছয়-দফা আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং ১৯৬৩-৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধের ভূমিকা থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সার্বভৌম সত্তা সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে দেশে ফেরার পর পরই তুমুল গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত।

...বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত সহকর্মীদের ধর্মোন্মাদনা ড. আমিনউদ্দিনের কাছে অনুভূত হয়েছিল প্রগতির বিপরীত স্রোত রূপে। তিনি ল্যাবরেটরির নামেমাত্র গঠিত রিক্রেয়েশন ক্লাবটিকে ঢেলে সাজালেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সংস্কৃতি কর্মে উৎসাহী হলেন।

ল্যাবরেটরির তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের শুভাকাঙ্ক্ষী পরামর্শদাতা হিসেবে তিনি প্রয়োজনের সময়ে মূল্যবান ভূমিকা রাখতেন; বস্তুত, তিনি ছিলেন ইউনিয়নের অঘোষিত প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর এই প্রগতিশীলতা উদারতা বুর্জোয়ামনস্ক কর্মকর্তাদের ঠুনকো আত্মগরিমায় আঘাত করত। প্রশাসনের উঁচু মহলে এজন্যে ড. আমিনউদ্দিনের বিরূপ সমালোচনা করা হতো।

সাহিত্যানুরাগী ড. আমিনউদ্দিন ১৯৭০ সালে ‘প্রত্যয়’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমাকে ‘প্রত্যয়’-এর আরো তিনটি সংখ্যা প্রকাশ করতে হয়। প্রত্যয়ে প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি প্রবন্ধ ‘মিউনিক-উন্মত্ততার ইতিবৃত্ত’ ও ‘সময় সংক্রাম এবং ষাট দশকের বিবর্তন’, এবং বিজ্ঞান সমাজ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান সমাজ পত্রিকা’-য় প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ‘পলিমার বিজ্ঞানের উৎপত্তি ও অগ্রগতি’। সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রাকৃতিক গবেষণা বিভাগে কাজের সূত্রে ‘সায়েন্টিফিক রিসার্চেজ’ বিজ্ঞান বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকায় বেশ কিছু মূল্যবান গবেষণা সন্দর্ভ প্রকাশ করেন।

১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যদানে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সেই মিছিলে তাঁরই রচিত স্লোগান ‘দেশের ডাকে দিল সাড়া প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা’ সংবলিত ব্যানার নিয়ে ঢাকার রাজপথ পরিক্রম করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ল্যাবরেটরির সহকর্মী ও বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতেন, কারণ জামায়াতিদের দৃষ্টি থেকে তিনি চাঁদাদাতাদের নিরাপদে রাখতে চাইতেন। অথচ নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।

১১ই ডিসেম্বর কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্ফু শিথিল করলে তাঁর তিন তরুণ বন্ধু বাসায় এসে কলোনি ছেড়ে অন্য কোথাও কিছুদিনের জন্য চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘পরাজিত সৈন্যরা কখনো শহরের ভিতরে অত্যাচার করার সময় পাবে না।’

স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা-সংক্ষুব্ধ অনিশ্চয়তার নয় মাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতি অগ্রবীক্ষণে তিনি অসাধারণ দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন; কিন্তু ভুল তাঁর হয়েছিল আলবদরদের তৎপরতা সম্বন্ধে তিনি সঠিক আঁচ করতে পারেননি। ১৩ই ডিসেম্বর দুপুরে কার্ফু উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এক ব্যক্তি আমাদের বাসায় এলে সংগৃহীত চাঁদার অর্থ হস্তান্তরের সময় আমি ব্যাপারটা কিছু আঁচ করি।

সুদীর্ঘ নয় মাস তিনি নিজে গিয়ে চাঁদার টাকা দিয়ে আসতেন বলে আমি ততদিন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম। কার্ফুর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী ব্যক্তিটি বাসায় এসে পড়ায় আমার কাছে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু এরপরও আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে এ ব্যক্তির পরিচয় জানতে পারিনি।

১৪ই ডিসেম্বর ভোর থেকেই আমি জরুরি প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস একটি বাক্সে ভরে বারবার তাঁকে বাসা ছেড়ে সপরিবারে অন্য কোথায়ও চলে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম, কিন্তু আমার ভাই মঞ্জু তাঁকে বাধা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমাদের আর সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনি ত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। আমার স্বামীরও অবশ্য বাসা ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে দোদুল্যমানতা ছিল।

ঐদিনই তাঁর সঙ্গে একই সময়ে অপহৃত ড. সিদ্দিক আহমদও আলবদরদের নৃশংসতা সম্বন্ধে আঁচ করতে পারেননি, ঘাতকদের হানা দেওয়ার কিছুক্ষণ আগেও তিনি অন্য সিঁড়ির বাসা থেকে ছাদ-পথে পালিয়ে এসে আমার স্বামীকে বলেছিলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই—আমরা জয়ী হবই।’

এমনই এক ত্রাসের মধ্যে সেদিন ভোর থেকে অনিশ্চিত ও উদ্বেগাকুল সময় অতিবাহিত হচ্ছিল। বাইরে তখন প্রচণ্ড আকাশযুদ্ধ। কার্ফুবন্দি ভীত সন্ত্রস্ত কলোনিবাসীদের অসহায়ের মতো মুহূর্ত গোনা ছাড়া উপায় ছিল না।

সেই দুর্যোগের মধ্যে সকাল সোয়া আটটার দিকে আততায়ীরা কলোনিতে এল একটা জিপে চেপে। হাতে তাদের নামের তালিকা। পাশবিক উল্লাসে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নেকড়ের ক্ষিপ্রতায় খুঁজতে লাগল তারা ড. আমিনউদ্দিন, ড. সিদ্দিক আহমদ ও শামসুল আলমকে। কেউ যে আর একজনকে সতর্ক করে দেবে কার্ফুর জন্য সে সুযোগ ছিল না।

সেই সময় আমার স্বামী আমাদের আড়াই মাসের একমাত্র পুত্রসন্তান আয়নের মুখে দুধের ফিডার ধরে রেখেছিলেন; আমি ছিলাম রান্নাঘরে। সাড়ে আটটার সময় নরপিশাচরা আঘাত করল বাসার প্রবেশ দ্বারে।

মঞ্জু দরজা খুলতে গেলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘মঞ্জু, তুমি যেয়ো না। আমার বাসা থেকে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে দিতে পারি না আমি।’ তিনি নিজেই দরজা খুললেন। কালো মুখোশধারী চারজন যুবক রাইফেল হাতে ড. আমিনউদ্দিনের পরিচয় জেনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর উপর।

আমি স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মঞ্জুর সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হতেই তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কাঁধে আঘাত করল এক মুখোশধারী। তারপর রাইফেলের নলের মুখে আমার স্বামীকে তাঁরই গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে টেনে বের করে নিয়ে গেল নরপিশাচরা।

সে সময় একজন মুখোশধারী আমাকে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই বোন, এক ঘণ্টা পরেই আপনার স্বামীকে ফেরত দিয়ে যাব।’

 আমি এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারিনি। আমার স্বামীকে চোখ বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে রাইফেলের মুখে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

আমার আশঙ্কা অমূলক ছিল না; আমি স্বামীকে আর ফিরে পাইনি। হানাদারদের দ্বারা অপহৃত অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর মতো আমার স্বামীর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

  • সুরাইয়া আমিন ড. মো আমিনউদ্দিনের স্ত্রী