১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা হামলা, লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো কার্যালয়ে দুর্বৃত্তরা হামলা, লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আগুন নেভাতে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা

মতামত

পরের আগুন হয়তো শুধু সংবাদমাধ্যমেই থামবে না

১৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে কারওয়ান বাজার থেকে যে ধোঁয়া উঠেছিল, তার শুরুটা আগুন দিয়ে হয়নি। শুরুটা হয়েছিল শোক দিয়ে। তরুণ নেতা ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যু অনেক মানুষকে নাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে তরুণদের, যারা আগে থেকেই মনে করে, তাদের কথা কেউ শোনে না এবং তারা নিরাপদ নয়।

এই মৃত্যুর পর ক্ষোভ, বিভ্রান্তি আর কাউকে দায়ী করার তাড়না তৈরি হয়। সমাজের সামনে বড় প্রশ্ন—এখন আইনের পথে ন্যায়বিচার চাওয়া হবে, নাকি রাগের রাজনীতিতে প্রতীক ভাঙা ও পোড়ানো শুরু হবে। ১৮ তারিখ রাতের ঘটনাগুলো বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার–এর অফিসে হামলা, আর নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে ঘিরে বিশৃঙ্খলা—এগুলো কোনো হঠাৎ শোকের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এগুলো এমন এক পরিবেশের ফল, যেখানে রাগ ছড়াতে দেওয়া হয়; কিন্তু তার দায় কেউ নেয় না, আর সহিংসতাকে নীরবে ঠিক বলে মেনে নেওয়া হয়। হাদির মৃত্যু ছিল আবেগের সূত্রপাত; কিন্তু আঘাতের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল গণমাধ্যম। এতে বোঝা যায়, আজ শোক, ভিন্নমত আর ক্ষমতাকে কীভাবে ভুল পথে চালানো হচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের আগুন শুধু দুটি পত্রিকা ভবনের ক্ষতি করেনি। এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত ছিল। এটি একটি সতর্কসংকেত। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, রাগ কত দ্রুত ভুল পথে নেওয়া যায়, অরাষ্ট্রীয় শক্তি কত সহজে রাজনীতি প্রভাবিত করতে পারে, আর রাষ্ট্র ও মিডিয়া যদি দৃঢ় না হয়, তাহলে গণতন্ত্র কতটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এ সময়কে গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে, পরের সংকট আরও ভয়াবহ হবে। আর পরের আগুন হয়তো শুধু সংবাদমাধ্যমেই থামবে না।

রাষ্ট্র যখন পরিষ্কারভাবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তখন একটি ভয়ংকর বার্তা যায়—কিছু সহিংসতা নাকি সহ্য করা যায়। গণতন্ত্র এক দিনে ভেঙে পড়ে না। এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়, যখন রাষ্ট্র দ্বিধায় থাকে আর সেই ফাঁকা জায়গায় অন্য শক্তি ঢুকে পড়ে।

এই হামলাগুলোর সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো এগুলো করেছে এমন এক গোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রের অংশ নয়; কিন্তু নিজেদের বড় নৈতিক রক্ষক বলে দাবি করে। তারা বলে—তারা দেশ, ধর্ম বা মানুষের অনুভূতি রক্ষা করছে। বাস্তবে তারা আইনের বাইরে কাজ করে এবং দেশপ্রেমের কথা বলে সহিংসতা চালায়। দুর্বল গণতন্ত্রে এমন দৃশ্য নতুন নয়। যখন কিছু দল ঠিক করতে শুরু করে কে দেশপ্রেমী আর কে বিশ্বাসঘাতক, তখন আইনের শাসন ভেঙে পড়ে।

শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যু এই পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তোলে। তাঁর মৃত্যু তরুণদের মনে গভীর আবেগ তৈরি করে। কারণ, অনেকেই আগে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ভরসা হারিয়েছে। এই শোককে ন্যায়বিচার, তদন্ত আর জবাবদিহির দাবিতে পরিণত না করে কিছু প্রভাবশালী মহল সেটিকে ঘুরিয়ে নেয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। পত্রিকাগুলোকে বলা হয় পক্ষপাতদুষ্ট বা ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যম। অভিযোগ ঠিক না ভুল, তা তখন আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই যে গণমাধ্যম একধরনের প্রতীকে পরিণত হয় আর প্রতীক পোড়ানো সহজ।

এ পরিস্থিতি নিজে থেকেই হয়নি। দেশের বাইরে থাকা কিছু অনলাইন প্রভাবক এতে বড় ভূমিকা রাখে। তারা দূরে বসে কথা বলে; কিন্তু কোনো ঝুঁকি নেয় না। ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকা থেকে তারা উত্তেজনা ছড়ায়; কিন্তু কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার বা হামলার মুখে পড়ে না। সেই ঝুঁকি নেয় দেশের রাস্তায় থাকা তরুণেরা। যারা ভাবে তারা ঠিক কাজই করছে। তাই সংবাদমাধ্যমে হামলা শুধু স্থানীয় রাগ নয়, বাইরের উসকানির ফলও।

এখানে গণমাধ্যমের ক্ষমতা নিয়ে একটি বড় ভুল ধারণা কাজ করছে। অনেকেই মনে করে, পত্রিকা একাই মানুষের চিন্তা বদলে দিতে পারে। বাস্তবে তা নয়। আজ মানুষ কী পড়বে বা দেখবে, তা নিজেই ঠিক করে। বন্ধু, পরিবার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর ব্যক্তিগত বিশ্বাস—সব মিলিয়ে মত তৈরি হয়। পত্রিকার প্রভাব সীমিত।

আজকের বাংলাদেশে পত্রিকা আর প্রধান তথ্যের উৎস নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে; কিন্তু অনেক কম দায়িত্ব নিয়ে। গুজব সত্যের চেয়ে দ্রুত ছড়ায় আর রাগ প্রমাণের চেয়ে

অনেক দূরে অবস্থান করে। যদি সত্যিই মানুষকে বিভ্রান্ত করার ভয় থাকত, তাহলে এই অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন জায়গাগুলোর দিকে নজর দেওয়া হতো। পত্রিকার

অফিস পোড়ালে সেই সমস্যা মেটে না; বরং ভয় আর নীরবতা তৈরি হয়।

তবে গণমাধ্যমকে রক্ষা মানে তার ভুলগুলো অস্বীকার করা নয়। বাংলাদেশের বড় সংবাদমাধ্যমগুলো মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে তরুণদের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলতে পারেনি। তারা অনেক সময় দূরে থাকে, কঠিন ভাষায় কথা বলে, আর ধরে নেয় সবাই তাদের বিশ্বাস করে। বিভক্ত সমাজে এই ভাবনা বিপজ্জনক। যখন ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ অভিযোগ ছড়াতে থাকে, তখন সংবাদমাধ্যম দেরিতে ও রক্ষণাত্মকভাবে সাড়া দেয়। তারা খবর কীভাবে তৈরি হয়, তা বোঝায়নি। সাংবাদিকদের মানুষ হিসেবে সামনে আনেনি। অনলাইনে যে ক্ষোভ বাড়ছিল, সেখানে সক্রিয় হয়নি।

ডেইলি স্টার কার্যালয়েও হামলাকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়

এই নীরবতার সুযোগে অন্যরা সংবাদমাধ্যমের পরিচয় ঠিক করে দেয়। নীরবতাকে অহংকার বা দোষ স্বীকার বলে ধরা হয়। আজকের দিনে, যেখানে ধারণা খুব দ্রুত ছড়ায়, এই নীরবতা বড় ঝুঁকি।

এ ঘটনাগুলো বুঝতে অরাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে হামলার একটি সহজ ধারা দেখা যায়। প্রথমে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটে। এরপর আবেগময় গল্প দ্রুত ছড়ায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা আরও বাড়ে। তারপর মিডিয়াকে শত্রু বানানো হয়। এরপর শক্তি দেখাতে মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। শেষে ভয় তৈরি হয়, সাংবাদিকেরা নিজেরাই চুপ থাকতে শুরু করেন আর জবাবদিহি দুর্বল হয়।

এ কারণে এসব হামলা আলাদা ঘটনা নয়। এগুলো গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। বাংলাদেশে এখন এমন অরাষ্ট্রীয় শক্তি দেখা যাচ্ছে, যারা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ভয় দেখিয়ে দমন করতে চায়।

এ সময় রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু নিন্দা করলেই চলবে না, কাজ দেখাতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিষ্কার বলতে হবে—সংবাদমাধ্যমের ওপর সহিংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। দোষীদের গ্রেপ্তার, বিচার আর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, তারা যে পরিচয়ের দাবিই করুক না কেন। আইনহীনতার সামনে চুপ থাকা মানে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।

একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমকেও বদলাতে হবে। সংবাদমাধ্যম আর দূরের এলিট হয়ে থাকতে পারে না। মানুষকে বোঝাতে হবে সাংবাদিকতা কেন দরকার, খবর কীভাবে যাচাই হয়, ভুল হলে কীভাবে তা ঠিক করা হয়। বিশ্বাস ধরে নেওয়া যায় না। ধীরে ধীরে খোলাখুলিভাবে তা গড়ে তুলতে হয়।

হাদির মৃত্যু দেশকে ভাবার সুযোগ দিতে পারত। প্রতিষ্ঠানগত সংস্কারের পথ খুলতে পারত। তার বদলে

এই মৃত্যুকে ব্যবহার করা হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলার অজুহাত হিসেবে, যারা সত্য বের করতে আর ন্যায়বিচারের দাবি তুলতে পারত। এখানেই

সবচেয়ে বড় দুঃখ। যখন শোক সহিংসতায় বদলে যায় আর সাংবাদিকতাকে শত্রু বানানো হয়, তখন গণতন্ত্র খুব দুর্বল হয়ে পড়ে।

কারওয়ান বাজারের আগুন শুধু দুটি পত্রিকা ভবনের ক্ষতি করেনি। এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত ছিল। এটি একটি সতর্কসংকেত। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, রাগ কত দ্রুত ভুল পথে নেওয়া যায়, অরাষ্ট্রীয় শক্তি কত সহজে রাজনীতি প্রভাবিত করতে পারে, আর রাষ্ট্র ও মিডিয়া যদি দৃঢ় না হয়, তাহলে গণতন্ত্র কতটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এ সময়কে গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে, পরের সংকট আরও ভয়াবহ হবে। আর পরের আগুন হয়তো শুধু সংবাদমাধ্যমেই থামবে না।

  • এস এম রিজওয়ান-উল-আলম সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, কমিউনিকেশন ও জার্নালিজম, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

    *মতামত লেখকের নিজস্ব