পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে মানুষের মানসিকতায়। একসময় বেবি বুমার (জন্ম: ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪) প্রজন্মের মানুষেরা মনে করতেন, অফিসে বেশি সময় কাজ করা ও বাড়তি টাকা উপার্জন করা মর্যাদার প্রতীক; কিন্তু সেই দিন আর নেই। পশ্চিমা দেশে এই প্রবণতা আগেই শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বিমা কোম্পানি মেটলাইফের এক জরিপেও দেখা গেল, দেশের মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কর্মীদের বড় অংশ (৭৮ শতাংশ) বর্তমানে নিজেদের চাকরিতে সন্তুষ্ট; কিন্তু তারপরও বড় একটি ফাঁক রয়ে গেছে। সেটি হলো চাকরিতে সন্তুষ্ট হলেও নিয়োগদাতাকে অনুমোদন বা সুপারিশ করার বেলায় তারা পিছপা হচ্ছেন। মাত্র ৪২ শতাংশ কর্মী সক্রিয়ভাবে তাঁদের নিয়োগকর্তার বিষয়ে সুপারিশ করবেন। অর্থাৎ আনুগত্যের ক্ষেত্রে বড় ফাঁক আছে। বোঝা যায়, কোম্পানির বিদ্যমান সুবিধা ও আধুনিক কর্মিসমাজের পরিবর্তনশীল প্রত্যাশার মধ্যে বড় অসংগতি আছে।
এই বৈপরীত্য থেকে বোঝা যায়, সন্তুষ্টি কেবল মৌলিক শর্ত মাত্র। আরও গভীরভাবে সামগ্রিক চাহিদা পূরণ হলেই কেবল কর্মীরা কোম্পানির বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে।
জরিপে তৈরি পোশাক, ব্যাংকিং, এফএমসিজি, টেলিযোগাযোগ, এনজিওসহ বিভিন্ন খাত থেকে ৫৭১ জন কর্মী এবং ১৪২টি নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের মতামত নেওয়া হয়েছে। কর্মীদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন তাদের কর্মীদের জন্য আর্থিক ও অনার্থিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আরও ভালোভাবে সাজাতে পারে, সেই লক্ষ্যেই দেশে এই প্রথম এমন গবেষণা করা হয়েছে।
মেটলাইফ ২০২৫ এমপ্লয়ি বেনিফিট ট্রান্ড স্টাডির তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ব্যবধান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে কী আশা করেন—যেমন যত্ন, সুস্থতা, সুবিধা ও যোগাযোগ, তার সুস্পষ্ট ও প্রমাণভিত্তিক ধারণা পাওয়া যায় এই জরিপে। তাঁদের এই প্রত্যাশা বুঝতে পারলে প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল কর্মীদের সন্তুষ্ট করতে পারবে তা নয়; বরং কর্মীদের কোম্পানির প্রতি আরও নিবেদিতপ্রাণ করে তুলতে পারে।
নিছক ভালো বেতন দেওয়ার মধ্য দিয়ে এখনকার কোনো কোম্পানি দায়িত্ব সারতে পারে না, যদিও বেশির ভাগ কোম্পানি ভালো বেতনও দেয় না। তার সঙ্গে আরও যেসব ঘাটতি আছে, তাতে কর্মীদের সঙ্গে কোম্পানির দূরত্ব কেবল বেড়েই যায়।
জরিপে দেখা যাচ্ছে, কর্মীর প্রতি কোম্পানির নজর রাখা এখন আর নিছক বাড়তি বিষয় নয়; বরং ব্যবসায়িক সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে তা বড় চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কর্মীরা যখন মনে করছেন, কোম্পানি তাঁদের খেয়াল রাখছে, তখন কর্মীদের মধ্যে সন্তুষ্টি আসছে। তখন তাঁরা কোম্পানির জন্য বড়গলায় কথা বলেন বা তখন তাঁদের সামগ্রিক কল্যাণে প্রভাব পড়ে। যেসব কোম্পানি প্রতিভা ধরে রাখতে চায় বা কর্মীদের কর্মনৈপুণ্য বৃদ্ধি করতে চায়, তাদের পক্ষে কর্মীদের খেয়াল রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। যে কর্মীরা মনে করেন, কোম্পানি তাদের খেয়াল রাখছে এবং যাঁরা মনে করেন, তাঁদের কোম্পানি সেটি করছে না—এই দুই কোম্পানির কর্মীদের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকেও বড় পার্থক্য দেখা যায়।
দেখা গেছে, যাঁরা কোম্পানির যত্ন–আত্তিতে খুশি, তাঁদের মধ্যে ৫০ ভাগ কোম্পানির পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। যাঁরা সন্তুষ্ট নয়, তাঁদের মধ্যে মাত্র আট ভাগ তা করেন। সন্তুষ্টি সূচকেও বড় ব্যবধান দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ বনাম ৪৫ শতাংশ। কল্যাণের ক্ষেত্রে ৫৮ ভাগ বনাম ২২ ভাগ। কর্মীদের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবধান দেখা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে, চরম অসন্তুষ্ট কর্মীরাও কাজের সঙ্গে একাত্ম থাকেন; কিন্তু তাঁরা কোম্পানির পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন না। মেটলাইফের জরিপে দেখা গেছে, কোম্পানির স্বাস্থ্যের জন্য এটি বড় ঝুঁকি।
বাংলাদেশের বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, চাকরির কঠিন প্রতিযোগিতা ও মানসিক চাপ কর্মীদের জীবনে প্রভাব ফেলছে। এমন সময়ে কর্মীরা শুধু বেতন নয়, তাদের সার্বিক ভালো থাকার নিশ্চয়তাও চান।
জরিপের শানে নজুল হলো কর্মীদের কাছে কোম্পানির পক্ষ থেকে এই খেয়াল রাখার বিষয়টি বিমূর্ত বিষয় নয়; বরং জীবনের বিশেষ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখন কোম্পানির কাছ থেকে সহায়তা চান, এমন প্রশ্নের জবাবে ৪৩ শতাংশ কর্মীর উত্তর হলো, বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সময় আর্থিক সহায়তা। আরও যে চারটি ক্ষেত্রকে তাঁরা বেছে নিয়েছেন, সেগুলো হলো ১. কর্মী যখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হয়ে যান তখন; ২. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি যেমন অবসাদ ও উদ্বেগের সময়; ৩. যখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের যত্নআত্তির প্রয়োজন হয়; ৪. গুরুতর শারীরিক রোগের সময়।
৭৫ শতাংশ কর্মী আশা করেন, অনাকাঙ্ক্ষিত আর্থিক চাপ বা ব্যয়ের সময় কোম্পানি তাঁদের পাশে থাকবে।
এ সময় কর্মীরা প্রত্যাশা করেন, কোম্পানি এ সময় ছুটির বিষয়ে আরও নমনীয় হবে। সেই সঙ্গে কর্মীর কাজের চাপ কমাবে; বিভিন্ন ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাবে; প্রাপ্য সুবিধা সম্পর্কে নানা তথ্য দেবে; কাজের সূচি বিষয়ক আরও স্বাধীনতা দেবে; কর্মীর যখন প্রয়োজন হবে, তখন তাঁকে কাজ না করার অবকাশ দেবে।
দেখা গেছে, করোনা মহামারির সময় চালু হওয়া হোম অফিস শেষ হওয়ার পর যখন স্বশরীরে কাজের রীতি আবার চালু হলো, তখন অনেকেই কাজ ছেড়ে দেন। পশ্চিমা পৃথিবীতে মানুষ তখন গণহারে চাকরি ছেড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে সেই সুযোগ না থাকলেও মন আর এখন সারাক্ষণ অফিস নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। এই চিন্তা মাথায় রেখে দেশের একটি প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে চারদিনের কর্মসংস্কৃতি চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এই বাস্তবতা যত বুঝবে, ততই মঙ্গল।
দেখা গেছে, কর্মীরা কাজের ক্ষেত্রে নমনীয়তা, কাজের চাপ মোকাবিলায় সহায়তা ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আরও পরিষ্কার ধারণা চান। বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের কাছে নমনীয়তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জেন–জি (জন্ম: ১৯৯৭-২০১২) প্রজন্মের ৮৩ শতাংশ কর্মী কর্মক্ষেত্রে নমনীয়তা প্রত্যাশা করেন, যেখানে মিলেনিয়াল (১৯৮১-১৯৯৬) প্রজন্মের কর্মীদের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ এই চাওয়ার কথা বলেছেন।
কর্মীরা এখন শুধু বেতন-ভাতা বা আর্থিক সুবিধা প্রত্যাশা করেন তা নয়; বরং তাঁদের প্রত্যাশা হলো কোম্পানিতে সমর্থনমূলক সংস্কৃতি ও উচ্চমানের সুবিধা থাকা। কোন বিষয়গুলো ‘অবশ্যই থাকা উচিত’ আর কোনগুলো ‘থাকলে ভালো’—নিয়োগকর্তাদের এখন এই বিষয় বুঝতে হবে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, কর্মীরা যে বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন, অর্থাৎ কোন বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে তার মূল্যায়ন মূলত সাংস্কৃতিক। এগুলো মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই সঙ্গে আরও কিছু আকাঙ্ক্ষার বিষয় থাকে, যেমন কল্যাণের বিষয়গুলো। এসব মূল বিবেচনা নয়; বরং আনুষঙ্গিক বিবেচনা হিসেবে কাজ করে। কর্মীদের মতে যে তিনটি বিষয় অবশ্যই থাকা উচিত, সেগুলো হলো:
• কর্মীদের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের যথেষ্ট সুযোগ (৫০ শতাংশ)
• সহমর্মিতামূলক ও সমর্থনমূলক কর্মসংস্কৃতি (৪৮ শতাংশ)
• কোম্পানির উদ্দেশ্য ও প্রভাব সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব (৪৫ শতাংশ)
কর্মসংস্কৃতি মূলত কাজের মঞ্চ তৈরি করে দেয় ঠিক; কিন্তু কর্মীর আনুগত্য সৃষ্টির জন্য যথাযথ বেতন দেওয়া জরুরি। যাঁরা তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট, তাঁদের আনুগত্য নাটকীয়ভাবে বেশি। কাজের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততাও বেশি। উদাহরণস্বরূপ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট কর্মীদের আনুগত্য যেখানে ৮৭ শতাংশ; অসন্তুষ্ট কর্মীদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৫৮ শতাংশ। এই গ্রুপের ৯৫ শতাংশ কর্মীও তাঁদের সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট। এ বিষয় থেকে প্রমাণিত হয়, ভালো সুযোগ-সুবিধা ও ইতিবাচক কর্মী মনোভাবের মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, জেন জি প্রজন্মের কাছে নমনীয়তা ও সহযোগিতামূলক সংস্কৃতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আধুনিক কর্মপরিবেশে শুধু মৌলিক সুবিধা দেওয়া যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন হলো কর্মীদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহায়তা, নমনীয়তা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাধ্যমে গভীর বিশ্বাস ও সম্পৃক্ততা গড়ে তোলা। এটি শুধু কর্মী ধরে রাখার কৌশল নয়, বরং কোম্পানির ব্যবসায়িক সফলতার ভিত্তি।
এই বাস্তবতা এখন সারা পৃথিবীতেই। ইয়াহু ফাইন্যান্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের প্রজন্মের সঙ্গে এখানে জেন-জিদের বড় ধরনের ব্যবধান দেখা যায়। তাঁরা নিজেই নিজের বস বা কর্তা হতে চান। অথচ মিলেনিয়ালদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল ৫৭ শতাংশ। জেনারেশন এক্সের মধ্যে ৩৬ শতাংশ ও বেবি বুমারদের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ।
আরেকটি বিষয় হলো, মহামারির ধাক্কায় মানুষের মননে বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করার চেয়ে তাঁরা এখন পরিবারেই বেশি সময় দিতে চান। এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই ধারণা।
দেখা গেছে, হোম অফিস শেষ হওয়ার পর যখন স্বশরীরে কাজের রীতি আবার চালু হলো, তখন অনেকেই কাজ ছেড়ে দেন। পশ্চিমা পৃথিবীতে মানুষ তখন গণহারে চাকরি ছেড়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে সেই সুযোগ না থাকলেও মন আর এখন সারাক্ষণ অফিস নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। এই চিন্তা মাথায় রেখে দেশের একটি প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে চারদিনের কর্মসংস্কৃতি চালু করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এই বাস্তবতা যত বুঝবে, ততই মঙ্গল।
অন্যদিকে জেন-জিদের এই মনোভাবের মূল কারণ হলো, পেশা ও পেশাগত বিকাশের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ। আরেকটি বিষয় হলো, নীতিনৈতিকতাসংক্রান্ত পুরোনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন। জেন-জিরা পুরোনো নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন কর্তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবেন না বা কর্তাদের পছন্দের আলোকে ক্যারিয়ার গড়বেন না। সে কারণে তাঁরা ৯টা-৫টার প্রথাগত চাকরি ছুড়ে ফেলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক
*মতামত লেখকের নিজস্ব