২০১৩ সালের কম্বোডিয়ার সাধারণ নির্বাচনের আগে, ২০১২ সালে দেশটির দুটি রাজনৈতিক দল হিউম্যান রাইটস পার্টি ও স্যাম রেনজি পার্টি (যেটা পরবর্তী সময়ে ক্যান্ডেললাইট পার্টি হিসেবে নামকরণ করা হয়) একীভূত হয়ে গঠন করে কম্বোডিয়ান ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি (সিএনআরপি)।
২০১৩ সালের নির্বাচনে দলটি অবিশ্বাস্যভাবে চ্যালেঞ্জ করে বসে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টিকে। ১২৩ আসনের পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দলের প্রাপ্ত ৬৮ আসনের বিপরীতে সিএনআরপি পায় ৫৫ আসন। অফটপিক হলেও বলতে চাই, একজন স্বীকৃত স্বৈরশাসকের অধীনেও বেশ ভালো নির্বাচনের নজির শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচনের নামে না হয়েছে সেটাকে স্মরণ করায়।
যা–ই হোক, ২০১৩ সালের নির্বাচন এমন ফলাফলের পর সিএনআরপি হুন সেনের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়ে। দলটির প্রধান কেম সখাকে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং উচ্চ আদালতের রায়ে সিএনআরপিকে নিষিদ্ধ করা হয়। দলটি ভেঙে যাওয়ার পরের নির্বাচনে (২০১৮ সালে) হুন সেনের দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি সংসদে প্রতিটি আসনে জয়লাভ করে। এরপর ২০২৩ সালের নির্বাচনে একটি ছোট দলকে ৫টি আসন ‘দেওয়া হয়’। কম্বোডিয়ার এই ব্যাকগ্রাউন্ডটুকু মনে এল তারেক রহমানের দেশে ফেরার পটভূমিতে।
শেখ হাসিনার পতনের পর তারেক রহমানের বাংলাদেশে ফেরা যৌক্তিক কারণেই খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। সর্বশেষ তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়ার মারাত্মক অসুস্থতার সময় তিনি তাঁর দেশে না ফেরা নিয়ে যে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন, সেটা কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেও তৈরি করেছিল আরও নতুন কিছু প্রশ্ন। কিন্তু ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিন তাঁর দেশে ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে নির্বাচন নিয়ে কারও মনে কিছুটা শঙ্কা যদি তৈরি হয়েও থাকে, সেটা একেবারে দূর করে দিয়েছিল।
এমন এক সময়ে তারেক রহমান বাংলাদেশে আসছেন, যখন ১৯৭৫–এর (১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর) পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। নানা জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তিনি দেশে ফিরছেন। তাঁর এই দেশে ফেরা তাঁর দিক থেকে খুব বেশি উদ্যাপনের সুযোগ নেই। কারণ, তাঁর সামনে আছে অকল্পনীয় বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ যেমন আছে নির্বাচনের আগে বিএনপির ডি ফ্যাক্টো প্রধান হিসেবে, তেমনি এই চ্যালেঞ্জ আছে তিনি যদি বিজয়ী হয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তারপরও।
শেখ হাসিনার মতো একজন ভয়ংকর স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশ যে আবার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে যাচ্ছে, রাজনৈতিক দল হিসেবে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দাবি করতে পারে বিএনপি। শুরুতে কম্বোডিয়ার যে পটভূমি আলোচিত হয়েছে, সেখানে আমরা দেখতে পাই, ওই দেশের স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন তাঁর বিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলকে ভেঙে ফেলতে পেরেছিলেন এবং বিরোধীরা কার্যকর কোনো প্রতিবাদ জারি রাখতে পারেনি। ফলে শেখ হাসিনা যা করতে চেয়েও সফল হননি, হুন সেন সেটা করতে পেরেছেন সফলভাবে—তাঁর পতন তো হয়ইনি; বরং ২০২৩ সালে তিনি অবসর নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন তাঁর ছেলে হুন ম্যানেটকে।
আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপির বিপরীতে জামায়াতে ইসলামের নেতৃত্বে ডান থেকে শুরু করে উগ্র ডান রাজনৈতিক দলের জোট তৈরি হচ্ছে। তাই যাঁরা উদার গণতান্ত্রিক/ মধ্যপন্থী রাজনীতিকেই রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করেন, এই মুহূর্তে কিছু সমালোচনার পরও বিএনপিই একমাত্র অপশন; আর দলটির প্রধান হিসেবে তারেক রহমানও তা–ই। ডানপন্থীরা ক্ষমতায়িত হতে থাকলে কী হতে পারে, ওসমান হাদির মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট আর উদীচীতে তাণ্ডবের পর সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হুন সেনের পদ্ধতিই ব্যবহার করেছিলেন (বস্তুত, সব স্বৈরাচার এটাই করে), চেয়েছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ভেঙে ফেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁর এবং তাঁর পরিবারের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে নির্যাতন, গায়েবি মামলার মতো ভয়ংকর সব নিপীড়ন সহ্য করে দলটি ভেঙে তো পড়েইনি; বরং ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ করে গেছে শেখ হাসিনার (শুরুতে ফ্যাসিস্ট ও পরে মাফিয়া) রেজিমকে।
বছরের পর বছর শেখ হাসিনার স্বৈরাচারকে চাপে ফেলে ক্রমাগত দুর্বল করে ফেলার জন্য বিএনপিকে প্রধান কৃতিত্ব দিতে হবেই। এই দুর্বল অবস্থায়ই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবার সম্মিলিত চাপের মুখে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে হাসিনা-রেজিম। এই পুরো সময়ে দেশ থেকে অনেক দূরে থেকেও শুরুর দিকে মায়ের সঙ্গে যৌথভাবে, এরপর এককভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারেক রহমান।
শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতে পলায়নের পর আওয়ামী লীগের সমর্থন রাতারাতি উবে যায়নি, এটা ঠিক। কিন্তু এমনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দলটি যদি দোষী সাব্যস্ত না–ও হয়, তবু দলটি তার নেতৃত্ব পুনর্গঠন করে সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রমে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে বিএনপি প্রায় একক শক্তি হিসেবে বিরাজ করবে।
বলে রাখা ভালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন এবং শক্তি বৃদ্ধির একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছে অনেক সোশ্যাল মিডিয়া বাবলে; কিন্তু বাস্তবে তাদের সমর্থন বাড়লেও সেটা বিএনপির সমর্থনের ক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশই; অর্থাৎ আগামীর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বেশ লম্বা সময় বিএনপিই প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ে থাকবে। তাই ক্ষমতায় আসার পর সরকার পরিচালনায় এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে মাঠে কেমন করবে বিএনপি, সেটার সঙ্গে আসলে জড়িয়ে গেছে দেশের এবং জনগণের ভাগ্যও। দলটির প্রধান তারেক রহমান কীভাবে সরকার ও দেশ পরিচালনা করবেন এবং সেটা করতে গিয়ে কতটা সফল হবেন, তার ওপর স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও জনকল্যাণ নির্ভর করবে।
সবকিছুর আগে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনো কিছু ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর অনিশ্চয়তা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র আছে, সেটাকেও নস্যাৎ করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা এবং তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি বিএনপিরই আছে। এখানেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে তারেক রহমানের।
দেশের সব মানুষকে বিএনপি করতে হবে না; সত্যি বলতে, সেটা দেশের গণতন্ত্রের জন্য ভালো কিছুও নয়। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনেও একের পর এক মেয়াদ বিএনপির ক্ষমতায় থাকা যদি আগে থেকেই বোঝা যায় (এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত হওয়া যায়), তাহলে সেটা রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য খুব ভালো খবর নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে বিজয়ের অনিশ্চয়তা থাকলে ক্ষমতাসীন দল যেভাবে জনগণের স্বার্থের পক্ষে থাকে, সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ের মোটামুটি নিশ্চয়তা থাকলে সেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আরেকটি উদার গণতান্ত্রিক দল তৈরি হওয়ার আগে এই দলের সঙ্গেই আমাদের ভাগ্য বাঁধা পড়ে গেছে। দলটি যদি সঠিক পথে না থাকে, দলটি যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তাই এমনকি যাঁরা বিএনপি সমর্থন করেন না, বিএনপিকে ভোট দেবেন না, তাঁদেরও উচিত দলটির প্রতি শুভকামনা জানানো এবং অবশ্যই উচিত তারেক রহমানের মঙ্গল কামনা করা। তাঁর দল এবং তিনি নিজে নিশ্চয়ই অতীতে ভুল করেছেন; ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাই তাঁর সাফল্যের জন্য জন্য শুধু শুভকামনা রইল। তারেক রহমান এবং তাঁর দলের ওপর ক্রমাগত চাপও জারি রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপির বিপরীতে জামায়াতে ইসলামের নেতৃত্বে ডান থেকে শুরু করে উগ্র ডান রাজনৈতিক দলের জোট তৈরি হচ্ছে। তাই যাঁরা উদার গণতান্ত্রিক/ মধ্যপন্থী রাজনীতিকেই রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর বলে মনে করেন, এই মুহূর্তে কিছু সমালোচনার পরও বিএনপিই একমাত্র অপশন; আর দলটির প্রধান হিসেবে তারেক রহমানও তা–ই। ডানপন্থীরা ক্ষমতায়িত হতে থাকলে কী হতে পারে, ওসমান হাদির মৃত্যুর পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট আর উদীচীতে তাণ্ডবের পর সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
জাহেদ উর রহমান শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব