মতামত

জাতীয় নেতাদের স্থায়ী স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা দিয়েই ইতিহাসের সংস্কার হোক

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা সবাই বৈষম্যমুক্ত, সংস্কারমুখী এক বাংলাদেশ কল্পনা করছি। সেই সংস্কারের প্রথম ধাপ আসলে হওয়া উচিত আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন যেখানে আমরা আমাদের জাতীয় নেতাদের জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মান করব, দলীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং নিহত চার নেতা—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান, এরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনে অবদান রেখেছিলেন। তাঁরা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক, নির্দলীয় স্বীকৃতির যোগ্য।

আমাদের বর্তমান প্রবণতা হচ্ছে সরকার বদলালেই স্মৃতিচর্চা বা ইতিহাস বদলে যায়। এখানে স্থানের নাম পরিবর্তন করা হয়, পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনা করা হয়, ফলক অপসারণ করা হয়, জাদুঘরগুলোর বর্ণনা বদল করা হয়, রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার সুর রাতারাতি উল্টে দেওয়া হয়। এমনকি এই ২০২৫ সালেও আমরা একই চক্র দেখতে পাই। সেই চক্রের কাজ হলো ‘আমাদের’ বীরদের উন্নত করা, ‘তাদের’ ছোট করা।

এটি ইতিহাস নয়; এটি পক্ষপাত। আর এতে তিনটি ক্ষতি হয় ১. তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। এতে তারা ইতিহাসকে স্থির জ্ঞানের বদলে দলীয় মতামত মনে করে; ২. প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ভাঙে; এতে রাষ্ট্রের বার্তা অনিশ্চিত হয়; ৩. জাতীয় ঐক্য ক্ষীণ হয়; এতে আমরা ‘আমাদের’ ও ‘তাদের’ নায়ক বানাতে ব্যস্ত থাকি। অথচ পরিণত জাতিগুলো নিজের দেশের ইতিহাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করে মহত্ত্ব ও ভুলত্রুটি পাশাপাশি স্বীকার করার সক্ষমতা রাখে।

একটি জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জার যে স্বাধীন হওয়ার অর্ধশত বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পরও আমাদের জাতীয় নেতাদের নিয়ে আমরা আমাদের নীতিগত অবস্থান ঠিক করতে পারিনি। আমাদের নেতারা ‘বাংলাদেশ’ চেয়েছিলেন। তাঁরা কখনোই নিজেদের ‘দেবতুল্য’ বানানোর জন্য সংগ্রাম করেননি। তাই নেতাদের দেবদূত বানানোর দরকার নেই, তাঁদের মানুষ হিসেবেই দেখা দরকার—যেখানে সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা পাশাপাশি থাকে। সমালোচনার অধিকার অক্ষুণ্ন রেখে রাষ্ট্র যেন তাঁদের সম্মান ও স্মরণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে, সেই ভারসাম্যটাই পরিণত গণতন্ত্রের লক্ষণ।

দক্ষিণ আফ্রিকা ১৬ ডিসেম্বর ‘ডে অব রিকনসিলিয়েশন’কে আইনি ও নীতিগতভাবে এমনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাতে ভিন্ন ঐতিহাসিক স্মৃতি একই দিনে মিলিত হয়। উদ্দেশ্য—জয়োল্লাস নয়, পুনর্মিলন। আয়ারল্যান্ড ‘ডেকেড অব সেন্টেনারিজ’-এর জন্য সরকারিভাবে গাইডলাইন দিয়েছে, যেখানে স্মরণ করা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ভারসাম্যপূর্ণ, অদলীয়। ঘানা একাধিক প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিত্বকে একসঙ্গে স্বীকৃতি দিতে সংসদীয় প্রক্রিয়ায় ছুটির দিন পুনর্বিন্যাস করে ‘ফাউন্ডারস ডে’ চালু করেছে। কেনিয়া ‘ন্যাশনাল হিরোস অ্যাক্ট ২০১৪’ করে একটি স্বাধীন জাতীয় বীর পরিষদ গড়ে জাতীয় নেতা নির্বাচনে প্রকাশ্য মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের আইন করে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ডে জাতীয় ছুটি হিসাবে ঘোষণা করে। সময়ের সঙ্গে তা ‘ডে অব সার্ভিস’ বা সেবামূলক দিনে পরিণত হয়েছে। আবার প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিস অ্যাক্ট (১৯৫৫) নেতাদের আর্কাইভকে জাতীয় আর্কাইভের অধীন এনে দলীয় কার্যালয় থেকে ইতিহাসকে আলাদা করেছে।

এই উদাহরণগুলো দেখায়, একটি দেশের নিজস্ব ইতিহাসকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে তুলতে আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠান-তিনটিই দরকার।

এসবের আলোকে কিছু প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে:

১. ‘জাতীয় নেতা ও শহীদ সম্মান আইন’: ‘জাতীয় নেতা ও শহীদ সম্মান আইন’ নামে একটি আইন করা যেতে পারে। এই আইনে ‘জাতীয় নেতা’ হিসেবে কে যোগ্য তা নির্ধারণ করতে একটি আইনগত, নির্দলীয় কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। তাঁদের প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান (জাতীয় দিবস, রাষ্ট্রীয় শোক, সংরক্ষিত স্মারক) দেওয়া এবং সরকারি পরিবেশে জাতীয় নেতাদের পক্ষপাতদুষ্ট অপব্যবহারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট নিয়ম তৈরি করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা দলের মতামতে নয়; বরং আইন অনুযায়ী ‘জাতীয় নেতা’-দের উপযুক্ত সম্মান এবং প্রাপ্য আনুষ্ঠানিকতা চিরদিনের জন্য সুরক্ষিত হবে।

২. স্বাধীন সম্মাননা কাউন্সিল: কেনিয়ার পরিষদের আদলে ইতিহাসবিদ, আর্কাইভবিদ, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, সব বড় দল ও নাগরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাউন্সিল তৈরি করা যেতে পারে। কাউন্সিলের সিদ্ধান্তগুলোকে দলীয় সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য মানদণ্ড, কার্যবিবরণী এবং বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করা যেতে পারে।

৩. স্মারক সনদ: আয়ারল্যান্ডের মতো মন্ত্রিসভা অনুমোদিত নির্দেশিকা জারি করা যেতে পারে, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষা, একাধিক অবদানের স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় স্মারক অনুষ্ঠানে কোনো দলীয় লোগো না থাকা, ভারসাম্যপূর্ণ পাঠ্যক্রম, উন্মুক্ত আর্কাইভ এবং প্রদর্শনী, পাঠ্যপুস্তক এবং জনসাধারণের শিল্পকর্মের নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৪. সংরক্ষণাগারের অবকাঠামো: রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের সময় সংরক্ষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য জাতীয় আর্কাইভের অধীন নেতাদের দলিল-দস্তাবেজ, ছবি, অডিও-ভিডিও ও মৌখিক ইতিহাসের ডিজিটাল এবং স্থায়ী সংরক্ষণাগার স্থাপন করা যেতে পারে।

৫. ঐকমত্য অনুসারে ক্যালেন্ডার: সরকার পরিবর্তনের সময় সুযোগসন্ধানী পরিবর্তনকে নিরুৎসাহিত করার জন্য, নেতা এবং মাইলফলকগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত জাতীয় দিবসগুলো নির্ধারণ বা সংশোধন করার জন্য সংসদীয় আইন (যেমন ঘানায়) ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে ‘সুপারমেজরিটি’ শর্ত নির্ধারণ থাকবে।

৬. ব্যবহারের কোড: সরকারি ভবনে প্রতিকৃতি, নামকরণ, ওয়েব বা মিডিয়ায় উপস্থাপন—সবখানে নিরপেক্ষ বর্ণনা, সমান গুরুত্ব, ও রোটেশন; নেতাদের নাম বা চিত্রের বাণিজ্যিকীকরণে স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে।

৭. শিক্ষা ও নাগরিক সেবা: স্মরণসভাগুলোকে নাগরিক-শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। রক্তদান, সাক্ষরতা ক্যাম্প, দুর্যোগ প্রস্তুতি, শিশু-সুরক্ষা প্রচারকে এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে। এতে ‘জাতীয় নেতা’দের প্রতি শ্রদ্ধা জনকল্যাণমুখী কাজের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে, স্লোগানের ভিত্তিতে নয়।

‘ইতিহাস রাজনীতিমুক্ত হতে পারে না’ এ কথা সত্য; কিন্তু স্মরণ নির্দলীয় হতে পারে। এখানে লক্ষ্য স্বাধীন চিন্তা কিংবা মতামত দেওয়ার অধিকার খর্ব করা নয়; বরং তাকে তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক করা।

প্রশ্ন হলো, এতে কি কোনো নেতার সমালোচনা নিষিদ্ধ হবে? উত্তর হলো—না। সমালোচনা থাকবে; কেবল রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্মারককে দলীয় টানাটানি থেকে মুক্ত করা হবে।

ভাসানী, ফজলুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, ওসমানী এবং জাতীয় চার নেতা—তাঁরা সবাই বাংলাদেশের নির্মাণে ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভূমিকায় অবদান রেখেছেন। সরকার বদলালেই তাঁদের স্মৃতি বদলে দেওয়া হয়। এটি রাষ্ট্রের চরিত্রকে অস্পষ্ট করে।

আমরা যদি দক্ষতা, ন্যায্যতা ও মর্যাদায় নির্মিত বাংলাদেশ চাই, তাহলে সেটি আমাদের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমে শুরু করতে হবে।

‘সংস্কার’ শুরু হোক অতীতকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে। আমাদের নেতাদের তাদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে। তাঁরা কোনো দলের সম্পত্তি নন; তাঁরা আমাদের জাতীয় নেতা—এই স্বীকৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করলেই আমরা প্রমাণ করতে পারব, বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে।

  • শাকিল ফয়জুল্লাহ জনসংযোগ গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব জর্জিয়া, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র।

ই–মেইল: sakilfz@gmail.com

*মতামত লেখকের নিজস্ব