
থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে যে প্রাণঘাতী সংঘাত চলছে, তাতে একপাশে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ও কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী। আর অপরপাশে রয়েছে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা কম্বোডিয়ার তুলনামূলকভাবে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সামরিক শক্তি।
ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এক শতাব্দীরও আগে যখন তাদের সীমান্ত ভাগ করে দিয়েছিল, তখন থেকেই ব্যাংকক ও নমপেন নিজেদের সীমান্তে একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড নিয়ে লড়াই করে আসছে।
গত বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত, কয়েক ডজন আহত এবং দেড় লাখেরও বেশি বেসামরিক নাগরিককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই সংঘাতের পেছনে দুই পক্ষের সামরিক ইতিহাস ও সক্ষমতার দিকে নজর দেওয়া যাক।
থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার চেয়ে জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রে অনেক বড়। থাইল্যান্ডের মোট ৩ লাখ ৬১ হাজার সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে, যা কম্বোডিয়ার তিন গুণ। আর এই সেনাদের হাতে এমন সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা কম্বোডিয়ার সেনারা কেবল স্বপ্নই দেখতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) ২০২৫ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘থাইল্যান্ডের বিপুল অর্থ বরাদ্দপ্রাপ্ত একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে এবং এর বিমানবাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত বিমানবাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
অন্যদিকে, লোয়ি ইনস্টিটিউটের ২০২৪ সালের ২৭টি আঞ্চলিক দেশের সামরিক সক্ষমতার র্যাঙ্কিংয়ে থাইল্যান্ড ১৪তম স্থানে রয়েছে, যেখানে কম্বোডিয়া ২৩তম স্থানে। এই বৈষম্য হয়তো স্বাভাবিক, কারণ থাইল্যান্ডের জনসংখ্যা কম্বোডিয়ার চার গুণ এবং জিডিপি ১০ গুণেরও বেশি বড়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আঞ্চলিক যুদ্ধ যেভাবে কম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনামকে গ্রাস করেছিল, থাইল্যান্ড সেখান থেকে মুক্ত ছিল। এমনকি পূর্বের ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকেও রেহাই পেয়েছিল দেশটি।
সামগ্রিকভাবে সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে লোয়ি এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সে থাইল্যান্ড ১০ম স্থানে রয়েছে, যেটি মধ্যম মানের শক্তি হিসেবে বিবেচিত, ইন্দোনেশিয়ার ঠিক পেছনে কিন্তু মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে। লোয়ির র্যাঙ্কিংয়ে কম্বোডিয়াকে বিবেচনা করা হয়েছে এশিয়ায় একটি ক্ষুদ্র শক্তি হিসেবে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং লাওসের মতো দেশগুলোর সঙ্গে একই গ্রুপে অবস্থান কম্বোডিয়ার।
থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দেশটির রাজনীতিতে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশটির ওপর বহু বছর ধরে সামরিক বাহিনী, রাজতন্ত্র এবং অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি রক্ষণশীল শক্তিশালী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে আছে।
সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুসারে, ১৯৩২ সাল থেকে জেনারেলরা ২০টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, প্রায়শই গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং সামরিক বাহিনী নিজেদের রাজতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর অনুসারে, একটি চুক্তির মাধ্যমে থাইল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ।
১৯৫৪ সালে দুই দেশের মধ্যে সেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেটি ম্যানিলা চুক্তি নামে পরিচিত। তখন থেকে দুই দেশের মধ্যে মিত্রতার সম্পর্ক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ড তাদের বিমান ঘাঁটিতে বি-৫২ বোমারু বিমানসহ মার্কিন বিমানবাহিনীর সরঞ্জামের জায়গা দিয়েছিল। হাজার হাজার থাই সেনা মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধও করেছিল।
ওয়াশিংটন ও ব্যাংককের মধ্যে যে সম্পর্ক বজায় আছে, সেটি বেশ শক্তিশালী। থাইল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর বাইরে প্রধানতম মিত্র হিসেবে দেখে। এর ফলে থাইল্যান্ড বিশেষ সুবিধা পায়, যেটির মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে তাদের অস্ত্র কর্মসূচির জন্য মার্কিন সমর্থন পেয়ে আসছে।
থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে কোবরা গোল্ড নামে একটি বাৎসরিক যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে থাকে। ১৯৮২ সাল থেকে এ যৌথ মহড়া শুরু হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে আরও অনেকে এ মহড়ায় যুক্ত হয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী অনুসারে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক সামরিক মহড়া।
কোবরা গোল্ড ছাড়াও থাই এবং মার্কিন বাহিনী একসঙ্গে ৬০টিরও বেশি মহড়া পরিচালনা করে এবং প্রতি বছর ৯০০টিরও বেশি মার্কিন বিমান এবং ৪০টি নৌ জাহাজ থাইল্যান্ডে আসে বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে দীর্ঘ সামরিক ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও, সম্প্রতি থাই সামরিক বাহিনী তাদের সামরিক নীতিতে আরও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। গত দশকে তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। মিলিটারি ব্যালেন্সের প্রতিবেদন অনুসারে, কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না থাকতে ইসরায়েল, ইতালি, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সুইডেনের মতো দেশগুলোর সাহায্যে একটি শক্তিশালী দেশীয় অস্ত্র শিল্পও গড়ে তুলেছে তারা।
কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনী থাইল্যান্ডের তুলনায় একেবারে নবীন। আইআইএসএস অনুসারে, ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট সরকারের বাহিনীর সঙ্গে দুটি অ-কমিউনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনীর একত্রিত হয়ে এই সেনাবাহিনী গঠিত হয়।
আইআইএসএস বলে, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষায় চীন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে কম্বোডিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার ওপর ঐতিহ্যগতভাবে নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও, কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন।’ বেইজিং কম্বোডিয়ায় একটি নৌঘাঁটিও তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, থাইল্যান্ড উপসাগরে অবস্থিত রিম নৌঘাঁটি চীনা বিমানবাহী রণতরীগুলোকে আশ্রয় দিতে সক্ষম হবে।
কম্বোডিয়া ও চীন মে মাসে গোল্ডেন ড্রাগন নামে তাদের বাৎসরিক যৌথ সামরিক মহড়া সপ্তমবারের মতো সম্পন্ন করেছে, যা এ যাবৎকালের বৃহত্তম মহড়া হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল এবং এতে তাজা গোলাবারুদ নিক্ষেপের প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ওয়েবসাইট অনুসারে, দুই দেশের মধ্যে এই প্রতিরক্ষাসম্পর্কটি এ বছর ‘একটি নতুন স্তরে পৌঁছাবে এবং একটি নতুন উন্নয়ন ঘটাবে’ বলে আশা করা হচ্ছে।
চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল উ কিয়ান ফেব্রুয়ারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেছিলেন, ‘চীন ও কম্বোডিয়ার বন্ধুত্ব লোহার মতো শক্তিশালী। তারা সর্বদা একে অপরকে সমর্থন করে। দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং পাথরসম দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বিদ্যমান।’
কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনীর এই সমর্থন প্রয়োজন। আইআইএসএস রিপোর্ট অনুসারে, ‘কম্বোডিয়ার বর্তমানে তার সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আধুনিক সরঞ্জাম তৈরি করার ক্ষমতা নেই।’
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে রয়্যাল থাই এয়ার ফোর্স ভালোভাবে সজ্জিত। আইআইএসএস অনুসারে অন্তত ১১টি আধুনিক সুইডিশ গ্রিপেন যুদ্ধবিমান এবং কয়েক ডজন পুরোনো মার্কিন এফ-১৬ ও এফ-৫ যুদ্ধবিমান রয়েছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার যুদ্ধ করতে সক্ষম কোনো বিমানবাহিনী নেই।
আর স্থলে থাইল্যান্ডের কয়েক শ মার্কিন ট্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে ৬০টি আধুনিক। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার প্রায় ২০০টি পুরোনো চীনা-ও সোভিয়েত নির্মিত ট্যাংক রয়েছে।
থাই সেনাবাহিনীর ৬০০টিরও বেশি আর্টিলারি রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৫৬টি শক্তিশালী ১৫৫ মি.মি যুদ্ধাস্ত্র এবং ৫৫০টিরও বেশি ১০৫ মি.মি টোয়েড গান রয়েছে। আইআইএসএস-এর তথ্য অনুসারে, কম্বোডিয়ার মাত্র এক ডজন ১৫৫ মি.মি যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে, যার সঙ্গে প্রায় ৪০০টি ছোট টোয়েড আর্টিলারি রয়েছে।
থাইল্যান্ডের কাছে আছে মার্কিন কোবরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও ১৮টি মার্কিন ব্ল্যাক হক যুদ্ধযান। কম্বোডিয়ার কাছে আছে মাত্র কয়েক ডজন পুরোনো সোভিয়েত এবং চীনা হেলিকপ্টার।
ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের সাবেক ডিরেক্টর ও হাওয়াই-ভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক কার্ল শুস্টার বলেছেন, পরিসংখ্যান ও মানের দিক থেকে সামরিকভাবে থাইল্যান্ড এগিয়ে থাকলেও কম্বোডিয়া অন্তত একটি দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, সেটি হচ্ছে বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় তাদের ভূগত অবস্থান। শুস্টার সিএনএনকে বলেছেন, কম্বোডিয়ার দিক থেকে বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় প্রবেশে সুবিধা বেশি।
তিনি আরও বলেন, কম্বোডিয়ার বাহিনী বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় ল্যান্ডমাইন ও বিভিন্ন ফাঁদ স্থাপন করায় থাইল্যান্ডকে দূরপাল্লার অস্ত্রের ওপর নির্ভর করতে হবে। শুস্টার বলেছেন, ‘থাইল্যান্ডের বিমানবাহিনী বেশ শক্তিশালী এবং তাদের বিশেষ ফোর্সটি লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠ। আমি মনে করি থাইরা সংঘাতে বিমান শক্তি এবং দূর-পাল্লার অস্ত্রের ওপর জোর দিতে পছন্দ করবে।’
ব্রাড লেনডন দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক সাংবাদিক। সিএনএন ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র নিউজ ডেস্ক রিপোর্টার
সিএনএন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ