পাল্টাপাল্টি অভিযোগে গণ অধিকার পরিষদের অবস্থা জেরবার। ফলে রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান সৃষ্টির আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল এই সংগঠনের পথচলা। আহ্বায়ক পদে নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া, ইমপিচমেন্ট ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গভীর সংকটে পতিত হয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দলটির নেতাদের নিয়ে জনমনে অস্বস্তি ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ নির্ধারিত সময়েই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীন নির্বাচনে রাজি নয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল। দেশের রাজনীতির এই জটিল মুহূর্তে গণ অধিকার পরিষদ মনে হয় তাল সামলাতে পারেনি। রাজনীতি খুব সহজ বিষয় নয়। এখানে অনেক ধরনের প্রলোভন থাকবে। প্রতিপক্ষ থেকে নানা ধরনের টোপ ফেলা হবে। অসময়ে ভুল টোপ গিললে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।
রাজনীতির খেলায় অনেক হিসাব-নিকাশ কষে পদক্ষেপ নিতে হয়। গণ অধিকার পরিষদ, বিশেষ করে দলটির সদস্যসচিব নুরুল হক নুর ভুল হিসাব-নিকাশের পাঁকে পড়েছেন কিনা সেটা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোন্দল ও বিশৃঙ্খলা মধ্যে পড়েছে দলটি।
সম্প্রতি দলটির আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়ার জাতীয় ইনসাফ কমিটির সমাবেশে যাওয়া নিয়ে সংকটের শুরু। যত দূর জানি, দলের পক্ষ থেকে রেজা কিবরিয়াকে ইনসাফ কমিটির সমাবেশে যেতে না করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি কথা শুনেননি। বরং ইনসাফ কমিটির সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
এ ঘটনা থেকেই সাম্প্রতিক কোন্দলের শুরু। ড. রেজা কিবরিয়া দলের সদস্যসচিব নুরুল হকের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ করেছেন। ইসরায়েলের কথিত গোয়েন্দা মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তাঁর বৈঠকের অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিন্তু সম্প্রতি নুরুল হকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে গোপনে বৈঠকের অভিযোগ করেছেন রেজা কিবরিয়া।
গণ অধিকার পরিষদ মূলত নুরুল হক নুর, মো. রাশেদ খান, হাসান আল মামুন, বিন ইয়ামিন মোল্লাসহ কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। নতুন দল হিসেবে গণ অধিকার পরিষদের প্রতি জনসাধারণের আশা-ভরসা ছিল ভিন্ন ধরনের। সারা দেশের অনেক তরুণই দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই দলে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপির রাজনীতির বাইরে নতুন একটি ধারা তৈরি করতে পারবে গণ অধিকার পরিষদ। তৃতীয় ধারার দল হিসেবে রাজনীতিতে শক্তিশালী জায়গা করে নেবে।
নুরুল হক বুঝে হোক না বুঝে হোক ফাঁদে পড়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকের কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব গুজবও হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের বৈঠক হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে মূলত গোপন বৈঠকগুলো নিয়ে এবং ওই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে যখন অস্বীকার করা হয়, তখন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে কোনো দলই নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নানা কারণে নানা সময় আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির কারণে রংপুর অঞ্চলের কিছু সমর্থন থাকলেও জাতীয় পার্টি কখনোই সারা দেশের দলে পরিণত হতে পারেনি। বরং আঞ্চলিক দল হিসেবে এখন টিমটিম করে জ্বলছে। এর বাইরে বামপন্থী ও ইসলামপন্থীরা কিসের ভিত্তিতে রাজনীতি করবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি। তাই তারাও রাজনীতিতে এই আছি এই নেই অবস্থায় আছে।
জনসাধারণ আশা করেছিল, আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরের দলগুলোর নানা ধরনের সংকট ও সমস্যার মধ্যে গণ অধিকার পরিষদ একটি উদার গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সমর্থ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকার পরিষদও সম্ভবত স্রোতে গা ভাসিয়েছে। দেশের অন্য দলগুলোর বিরুদ্ধে সচরাচর যে ধরনের অভিযোগ ওঠে বা যেসব আচরণ লক্ষ করা যায়, গণ অধিকার পরিষদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
গণ অধিকার পরিষদ বা নুরুল হকের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে তথ্য গোপনের অভিযোগ। ইসরায়েলি গোয়েন্দার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি নুর স্বীকার করলেই পারতেন প্রকাশ্যে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাই হয়তো নুর বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করেছেন। বারবার অস্বীকার করে নুর প্রতিপক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। অথচ ড. রেজা কিবরিয়ার ভাষ্যমতে, গত ১৮ জুন দলের কাছে নুর বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েল ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়টি জনমনে সহজ করার জন্য তাঁর সঙ্গে ইসরায়েলি নাগরিকের বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর জনপ্রিয়তার ব্যবহার করা হয়েছে।
নুরুল হক বুঝে হোক না বুঝে হোক ফাঁদে পড়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকের কথা বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব গুজবও হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের বৈঠক হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে মূলত গোপন বৈঠকগুলো নিয়ে এবং ওই বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে যখন অস্বীকার করা হয়, তখন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।
কোন্দল, অভিযোগ, ইমপিচমেন্টের কারণে গণ অধিকার পরিষদ এখন ধুঁকছে। অথচ দলটির পথচলা আরও মসৃণ ও ভালো হতে পারত। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ইসলামপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোর বাইরে নিজস্ব একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তৈরি হতে পারত। দলটি নুরুল হকের রাজনৈতিক দল হিসেবেই পরিচিত। ড. রেজা কিবরিয়া বাইরে থেকে দলে এসেছেন। তাঁকে বাদ দিলে তিনি চলে যাবেন। এটা ড. কিবরিয়ার জন্য নতুন নয়। এর আগে তিনি গণফোরামে ছিলেন। কিন্তু গণ অধিকার পরিষদ, বিশেষ করে নুরুল হক নুরকে এখন কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।
গণ অধিকার পরিষদের এখন তরতর করে ওপরে ওঠার কথা। কিন্তু তার উল্টোটা ঘটছে বলে মনে হয়। গণ অধিকার পরিষদ কি তবে অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে? সুবিধাবাদী শ্রেণি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের লোকেরা কি নিজেদের স্বার্থে গণ অধিকার পরিষদকে ব্যবহার করেছেন? আমাদের রাজনীতিতে কোনো দল একবার পথ হারালে আর ফিরে আসতে পারে না। গণ অধিকার পরিষদ কোন পথে হাঁটছে তা সামনের দিনগুলোতে আরও পরিষ্কার হবে।
মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক