
‘আপনারা কিছু বলতেছেন না ক্যান’—হাসপাতালের অলিন্দে ছোটাছুটি করতে করতে এক হতাশ কিশোরী বারবার চিৎকার করে কথাগুলো বলছিল। স্বেচ্ছাসেবক কিশোরী আহত ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতালের প্রবেশপথটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করছিল। কেউ তার এই চিৎকার আমলে নিচ্ছিল না। হাসপাতালের বারান্দা তখন মানুষের দঙ্গলে সয়লাব। একেক রাজনৈতিক দলের একেক নেতা তাঁদের চ্যালা–চামুণ্ডা নিয়ে উত্তেজিত মিছিলের মতো ঢুকছেন হাসপাতালে।
উদ্ধারকর্মীরা পথ পাচ্ছেন না ওটির, ওয়ার্ডের এবং ডাক্তারের টেবিলের। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার ভিড় আর কথিত প্রত্যক্ষদর্শীদের একই বয়ান রেকর্ডিং বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। কিশোরীর আকুতি ছিল, ওদের সরিয়ে রোগী নিয়ে আসা যাওয়ার পথটা পরিষ্কার রাখা। সারা রাত আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় কিশোরীর সেই নিরুপায় চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়েছে কানে। কে কাকে সরতে বলবে? কে কাকে বাধা দেবে?
আগ্রহী পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৮ সালের ২৩ জুনের কথা। সেদিন থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই প্রদেশে ফুটবল অনুশীলন শেষে ১২ শিশুর একটি দল থাম লুয়াং গুহায় আটকা পড়েছিল। তাদের ফুটবল কোচও ছিলেন তাদের সঙ্গে। বৃষ্টির কারণে গুহার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ভেতরে আটকা পড়ে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর তাদের জীবিত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর উদ্ধারকারী দলের সহায়তায় তাদের সবাইকে নিরাপদে গুহা থেকে বের করে আনা হয়।
রুদ্ধশ্বাস সেই উদ্ধার অভিযানে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল ভিড় সামলানো বা ক্রাউড ম্যানেজমেন্ট। এক কিলোমিটার দূরে সাংবাদিকসহ সব মানুষের দঙ্গল আটকে দেওয়া হয়েছিল। কাউকে ভিড় করে ছবি–সেলফি তুলতে দেওয়া হয়নি। সবাই সেটা করে, সেটা পারে। আমরা সাভার, বনানী, চুড়িহাট্টা—কোথাও এটা করিনি, করার চেষ্টাও করিনি।
বহু বছর থেকে শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেমের (আইসিএস) কথা। কিন্তু জাতিসংঘের তকমা পাওয়া (‘জাতিসংঘ জনসেবা পদক ২০২১’ এবং জাতিসংঘের সাসাকাওয়া অ্যাওয়ার্ড ২০১৩) বাংলাদেশে দুর্যোগ বা র্যাপিড অনসেট ডিজাস্টার মোকাবিলার জন্য এখনো কোনো কার্যকর ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা হয়নি।
ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম (আইসিএস) হলো একটি স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। জরুরি পরিস্থিতিতে কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি একটি কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি, যা বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা ও কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করে। আইসিএস মূলত দাবানল ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি করা হলেও বর্তমানে এটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শুধু মাইলস্টোন স্কুলে অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীর জন্য নয়, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে প্রয়োজনীয় তথ্য, যেমন রক্তের গ্রুপ, অভিভাবকের নাম, ফোন নম্বর এবং জরুরি যোগাযোগের তথ্য বাধ্যতামূলক করা হোক।
আইসিএস থাকলে মাইলস্টোনের মতো পরিস্থিতিতে সবার পক্ষ থেকে একটা কমান্ডের ব্যবস্থা চালু থাকত। তখন সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো আইসিএসের মাধ্যমে। কিশোরীকে প্রাণফাটা চিৎকার করতে হতো না। সবাই জানত কার কী কাজ। মোবাইল ক্যামেরা বন্ধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য বারবার অনুরোধ করার পরও কথা না শোনা ভিড়কে ঠ্যালা–ধাক্কা দিয়ে ‘গায়ে হাত তোলার’ বদনাম নিতে হতো না।
এখন শোনা যাচ্ছে, মাইলস্টোন স্কুলের ভবন তৈরি নিয়েই নাকি সমস্যা। বিমান নামা–ওঠার পথে সভ্য কোনো দেশে স্কুল বা অনেক মানুষের জমায়েত হয়, এমন প্রতিষ্ঠান বানাতে দেয় না। ২১ জুলাই অন্যান্য দিনের মতো ক্লাস চলছিল। কেউ খেলছিল মাঠে। ঠিক তখনই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান এফ-৭ বিজিআই বিধ্বস্ত হয় শিক্ষার্থীদের ভবনে। বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটির ‘নাক’ ঢুকে যায় ভবনের সিঁড়িতে। এর দুই পাখার আঘাতে ও আগুনে পুড়ে ছাই হয় শিশুদের দুটি ক্লাসরুম। এ ঘটনায় প্রাণহানির তালিকা ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩২ জন, আহত হয়েছেন ১৬৫ জন।
বেঁচে যাওয়া অনেক শিশু আর অভিভাবকের ট্রমা থাকবে এবং এর জন্য প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা ব্যবস্থাপনা। শুধু যাঁরা দেখেছেন বা আহত হয়েছেন, তাঁদের সমস্যা নয়; এই ট্রমা তাঁদেরও আক্রান্ত করবে, যাঁরা টিভির পর্দায় এগুলো দেখেছেন আর দেখছেন। লাশ আর আহতের ছবি না দেখিয়েও ঘটনা বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে উপস্থাপন করা যায়। আমরা কেউ টুইন টাওয়ারের আহত–নিহত ব্যক্তিদের ছবি দেখেছি কি?
• কতজন নিহত ও আহত, তার সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা নিয়ে আজ ২২ জুলাই পর্যন্ত বিভ্রান্তি রয়েছে।
• রাজধানী ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনা দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত।
• স্কুল, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা এবং জনসমাগমপূর্ণ স্থানের ওপর দিয়ে যাত্রা করা যুদ্ধবিমান যেকোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নীতিমালা বা প্রয়োগ ছিল না।
• বিমান বিধ্বস্তের ঘটনার অল্প মুহূর্তের মধ্যে মানুষের ঢল নামে যেন। উদ্ধার কার্যক্রমে যুক্ত মানুষের চেয়ে উৎসুক মানুষের ভিড় বেশি। উদ্ধারকাজ চলাকালে অনেকে ছবি ও ভিডিও তোলায় ব্যস্ত ছিলেন, যা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। হতাহতদের উদ্ধার থেকে শুরু করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে চরম বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। ঘটনাস্থল থেকেই বিষয়টি বারবার বলা হচ্ছিল। অতিরিক্ত মানুষের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু সময় যত গেছে, ততই যেন মানুষের ঢল বেড়েছে।
• ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট পর্যন্ত মানুষের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। মানুষের ভিড়ের কারণে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্সের গতি কমে গেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক নেতারা দলবল নিয়ে হাসপাতালে ঢুকছেন। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে অন্যান্য নেতা-কর্মী-সমর্থক, নিরাপত্তাকর্মী, মিডিয়াকর্মী মিলিয়ে রীতিমতো একটা হট্টগোল পরিস্থিতি তৈরি হলো হাসপাতাল এলাকায়। ভিড় সামলাতে কাজ করছেন, এমন স্বেচ্ছাসেবীদের এই কারণে বেগ পেতে হয়েছে অনেক।
• বহু স্বজন নিহত বা আহত ব্যক্তিদের অবস্থান জানাতে পারেননি। হাসপাতালগুলোতে একজন ‘ইনফরমেশন অফিসার’ বা সহায়ক ডেস্ক তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় ছিল না।
• স্কুলের শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে নাম ছাড়া অন্য কোনো কার্যকর তথ্য ছিল না, বিশেষ করে শিশুর পরিবার বা অন্য কোনো ইমার্জেন্সি ফোন নম্বর বা অভিভাবকের নাম দেওয়া হয়নি, ফলে নিহত ও আহতের পরিবারের কাছে তাঁদের সন্তানদের খবর পৌঁছে দিতে দেরি হয়েছে।
• এ ধরনের পরিস্থিতিতে সমন্বয়হীনতা দূর করার জন্য একক কমান্ডের অধীনে ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেমের আওতায় উদ্ধার কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত, যা এই দুর্ঘটনায় করা হয়নি, ফলে বিপর্যয় আরও বেড়েছে।
• দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলমাঠেই প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি।
এক. শিশুর মানসিক অবস্থা বোঝা ও মোকাবিলায় আমাদের সবার সচেতন হতে হবে। প্রথমত, শিশুদের কাছ থেকে কী হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল—এমন বর্ণনা শোনা বন্ধ করতে হবে।
দুই. পেশাদার মনোবিদদের সহায়তায় আহত ও বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ট্রমা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিন. স্কুলে পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যায়ক্রমে থেরাপি, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও ধাপে ধাপে শ্রেণিকক্ষে ফেরা সহজ করতে হবে।
চার. এমন জাতীয় ট্র্যাজেডির পর শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য পুনর্বাসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার।
সর্বোপরি, শুধু মাইলস্টোন স্কুলে অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীর জন্য নয়, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে প্রয়োজনীয় তথ্য, যেমন রক্তের গ্রুপ, অভিভাবকের নাম, ফোন নম্বর এবং জরুরি যোগাযোগের তথ্য বাধ্যতামূলক করা হোক। এ দুর্ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি জাতিগত ট্র্যাজেডি। একদিকে মূল্যবান প্রাণহানি, অন্যদিকে একটি প্রজন্মের মানসিক ভার। এখন জরুরি দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং ভবিষ্যতে এমন মর্মান্তিক ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
গওহার নঈম ওয়ারা স্বাধীনতার ৫০ বছর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্জন গ্রন্থের লেখক
wahragawher@gmail.com
মতামত লেখকের নিজস্ব