
সেটি ছিল স্বপ্নপূরণের এক দিন। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত ক্লাব টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেক আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে এই দিনে। টেস্ট ক্রিকেটে রজতজয়ন্তী অবশ্যই উদ্যাপনের উপলক্ষ। কিন্তু তা করতে গিয়ে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে আসে কেন! লিখেছেন উৎপল শুভ্র
দেখতে দেখতে ২৫ বছর! অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন! এমনিতে একটু আলস্যভরা শুক্রবারের সকাল সেদিন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা, উৎসবের অদৃশ্য রঙে রঙিন। সব পথ গিয়ে যেন মিলেছে জাতীয় স্টেডিয়ামে। যেটির নাম তখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। ব্যানার, ফেস্টুন আর নানা রঙে সেজে তা যেন এক বিয়েবাড়ি। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই স্টেডিয়ামের গ্যালারি প্রায় অর্ধেক ভরিয়ে ফেলেছে মানুষের স্রোত। কিছুক্ষণ পর যখন আকাশে উড়ে যেতে শুরু করল তিন হাজার বেলুন, ততক্ষণে গ্যালারি প্রায় পূর্ণ।
সেই গ্যালারিতে হর্ষধ্বনি তুলে আনন্দ-আয়োজনের পরের পর্ব। ১০ হাজার ফুট ওপর থেকে একে একে মাঠে নেমে আসছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১১ প্যারাট্রুপার। একজনের হাতে ধরা পতাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লোগো। বাকি ১০ জনের হাতে ১০টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের পতাকা। ক্রিকেটের আদি পিতা ইংল্যান্ডের পতাকাবাহী নেমে এলেন সবার আগে, গ্যালারির চিৎকারকে সপ্তগ্রামে তুলে সবার শেষে টেস্ট পরিবারের নবীনতম সদস্য বাংলাদেশ। সবচেয়ে নিখুঁত অবতরণ হলো লাল-সবুজ প্যারাট্রুপারেরই। সেটির প্রতীকী অর্থও খুঁজে নিয়েছিলাম আমরা অনেকে।
স্মারক এক স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে টস হলো একটু পর। যে টস করতে নামার সময় টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুই অধিনায়ক বাংলায় কথা বলতে বলতে মাঠের মাঝখানে। বাংলাদেশের নাঈমুর রহমান ও ভারতের সৌরভ গাঙ্গুলী। গ্যালারিকে আবার জাগিয়ে তুলে টসে বাংলাদেশের জয়। সকাল সাড়ে ৯টায় টেস্টের প্রথম বলটি করতে দৌড় শুরু করলেন ভারতের পেস বোলার জাভাগাল শ্রীনাথ। তাঁর সামনে বাংলাদেশের ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন, বিদ্যুৎ নামেই যাঁকে মানুষ বেশি চেনে।
২০০০ সালের ১০ নভেম্বর সকালে টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায় ভীরু ভীরু পা পড়ল বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এটিকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে ঘোষণা দিয়েছিলাম একটি লেখায়। তা থেকে সরে আসার কোনো কারণ দেখছি না। আর কোনো খেলার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নেই—এটাই যথেষ্ট এই দাবির যৌক্তিকতা বোঝাতে। সেই টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ২৫ বছর, মানে রজতজয়ন্তী উদ্যাপনের একটা উপলক্ষ তো বটেই। এরই সঙ্গে চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানোরও। তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মনে হয় জরুরি। ২৫ বছর একেবারে কম সময় নয়, আবার টেস্ট ক্রিকেটের বৃহত্তর ছবিতে আসলেই কি খুব দীর্ঘ সময়? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনাকে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসটা একটু জানতে হবে।
ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল ১৮৭৭ সালের মার্চে। এবার তাহলে টেস্ট ক্রিকেটের বয়সটা হিসাব করে ফেলুন। মাস-দিন ধরে একেবারে নিখুঁত হিসাবে না গেলে টেস্ট ক্রিকেটের বয়স এখন ১৪৮ বছর। এটা না বললেও চলছে, প্রথম টেস্টের দুই দল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ক্রিকেটে পদচারণও ঠিক ১৪৮ বছর ধরে।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার পর টেস্ট পরিবারের তৃতীয় সদস্য হিসেবে আবাহন দক্ষিণ আফ্রিকার। প্রথম টেস্টের প্রায় এক যুগ পর, ১৮৮৯ সালের মার্চেই দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট অভিষেক। টেস্ট ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার তাই ১৩৬তম বছর চলছে। পর্যায়ক্রমে বাকি দেশগুলোর কথা যদি বলে যাই—টেস্ট ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আছে ৯৭ বছর, নিউজিল্যান্ড ৯৫, ভারত ৯৩, পাকিস্তান ৭৩, শ্রীলঙ্কা ৪৩ ও জিম্বাবুয়ে ৩৩ বছর। টেস্ট পরিবারে বাংলাদেশের জুনিয়র দুই দেশ আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের এটি সপ্তম বছর চলছে।
এসব বলার অর্থ অবশ্যই এটা নয় যে বাংলাদেশ যখন টেস্ট খেলে, তখন আমরা প্রতিপক্ষ দলগুলো কত বছরের সিনিয়র-জুনিয়র—এ হিসাব করতে বসব। খেলায় জয়-পরাজয় এসব মেনে হয় না। তাহলে বাংলাদেশ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিতে পারত না বা হেরে বসত না আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টেই। তাহলে কোন দেশ কত বছর ধরে টেস্ট ক্রিকেট খেলছে, এটা ঘটা করে জানানো কেন? কারণ একটাই—বৃহত্তর চিত্রটা সম্পর্কে ধারণা থাকায় অনেক কিছু বুঝতে সুবিধা হবে তাহলে। সে জন্য সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে টেস্ট পরিবারে বরণ করে নেওয়ার পটভূমিটাও জানা দরকার। এর আগে একচিমটি হলেও এই অঞ্চলের ক্রিকেট–ইতিহাস।
ক্রিকেট–ঐতিহ্যের বিচারে বাংলাদেশকে বনেদিই বলতে পারেন। তা এতটাই সমৃদ্ধ যে এই উপমহাদেশে ক্রিকেট শুরুর ইতিহাস খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের নাম চলে আসে। অন্য সব দেশের মতো এই উপমহাদেশেও ক্রিকেট এসেছে ইংরেজদের মাধ্যমে। তাদের নিজেদের মধ্যকার খেলার কথা বাদ দেওয়াই ভালো। স্থানীয়দের ক্রিকেট খেলার কথা ধরলে সেই ইতিহাসের নাড়ি পোঁতা বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। কটিয়াদী থানার মসুয়া গ্রাম অবশ্য এখন কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। সেখানেই ‘বাংলার ক্রিকেটের ডব্লু জি গ্রেস’ নামে খ্যাত সারদারঞ্জন রায়ের উদ্যোগে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল বলে জানা যায়। বিভিন্ন সূত্রে সময়টা ১৮৫৮ সাল বলেই জেনে এসেছি। সারদারঞ্জনের আরেকটা পরিচয় বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই। আজ আর সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত না যাই। কথাটা উল্লেখ করা শুধুই বাংলাদেশের ক্রিকেট–ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিতে।
টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গেও এই ভূখণ্ডের অনেক পুরোনো পরিচয়। স্বাধীনতার আগেই ঢাকায় ৭টি টেস্ট ম্যাচ হয়েছে। আপনার জানা না থাকলেও অনুমান করে ফেলার কথা, এর সবই পাকিস্তানের ‘হোম ভেন্যু’ হিসেবে। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তানের অংশ। ঘটনাচক্রে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার তিন বছর পর দেশের মাটিতে পাকিস্তান প্রথম টেস্ট খেলেছিল এই ঢাকাতেই। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের প্রতিপক্ষের মতো ১৯৫৫ সালে সেই টেস্ট ম্যাচেও পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় প্রথম টেস্ট ম্যাচ, ১৯৬৯ সালে স্বাধীনতার আগে শেষ টেস্ট ম্যাচ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঢাকায় আবার টেস্ট ম্যাচ হয়েছে ১৯৯৯ সালে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সেই ফাইনাল ঢাকায় আয়োজিত হয়েছিল বৃহত্তর এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।
টেস্ট পরিবারের সদস্য না হয়েও বাংলাদেশ কীভাবে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আয়োজক হতে পেরেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু পিছিয়ে যাই।
স্বাধীনতার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিনবদলের সূচনা করেছিল ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি। আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পায়। ১৯৯৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে জোরালো করে তোলে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার দাবি। কিন্তু শুধুই একটা ওয়ানডেতে জয়—তা যত বড়ই হোক না কেন, তা তো আর টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার নিয়ামক হতে পারে না। যেখানে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে তখনো দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচই খেলা হয় না।
তারপরও বাংলাদেশ যে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায়, তাতে মাঠের বাইরের দূতিয়ালির বড় ভূমিকা ছিল। সে সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হকের কূটনৈতিক দক্ষতারও যাতে বড় অবদান।
তবে তাতেও কাজ হতো না, যদি জগমোহন ডালমিয়া আইসিসির সভাপতি হয়েই ক্রিকেটে বিশ্বায়নের স্লোগান না তুলতেন। প্রতিবেশী কলকাতায় নিবাস ছিল বলেই হয়তো ডালমিয়ার বাংলাদেশের প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল, বাংলাদেশের ক্রিকেট-সম্ভাবনাটাও তিনি সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বুঝতে পেরেছিলেন, ক্রিকেটের জন্য এটা কত বড় একটা বাজার। আর ক্রিকেটকে বাণিজ্যিকীকরণের পথে এগিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বড় অবদান বিবেচনায় একজন প্রশাসকের নাম বললেও জগমোহন ডালমিয়ার নামটাই সম্ভবত সবার আগে বলতে হবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কার্যত ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়ে থাকায় সারা দেশে খেলার বিস্তার নেই। বিকেন্দ্রীকরণের কথা শুধুই সেই ‘কাজির গরু’ হয়ে রয়েছে; যেটির উপস্থিতি শুধুই কেতাবে, গোয়ালে নয়। টেস্ট ক্রিকেট শেখার পাঠশালা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট; আসলে তো যেকোনো ধরনের ক্রিকেটেরই। ক্রিকেটের মৌলিক বিষয়গুলো তো এখানেই শেখেন ক্রিকেটাররা। অথচ বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এখনো যেন নিজেরা ভাগ হয়ে কিছু ম্যাচ খেলামাত্র। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটারদের তৈরি করার জন্য যা মোটেই উপযুক্ত নয়।
ক্রিকেট-বাণিজ্য বিস্তারে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনাকে বাকি ক্রিকেট–বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে ঢাকায় একটার পর একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজনও সম্ভবত ডালমিয়ারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৯৯৮ সালে ভারত–পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে নিয়ে ইনডিপেনডেন্স কাপের পর সে বছরই নয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশকে নিয়ে মিনি বিশ্বকাপের প্রথম আসর, ২০০০ সালে আইসিসির বিশ্বায়ন কর্মসূচির শোপিস ইভেন্ট এশিয়া বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব ওয়ানডে ম্যাচ...এগুলোর মাঝখানে ১৯৯৯ সালে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সেই ফাইনাল। যেটির মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটের আবার ঢাকায় ফেরা।
এসব আয়োজনে গ্যালারিভর্তি দর্শক আর এটিকে ঘিরে জনমানসে উন্মাদনা মিলিয়ে এরপর কোনো দেশ টেস্ট মর্যাদা পেলে সেটি বাংলাদেশকেই দিতে হবে—এটি একরকম প্রতিষ্ঠিতই হয়ে যায়। যে কারণে ২০০০ সালের ২৬ জুন লর্ডসে আইসিসির সভায় সব দেশের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে টেস্ট পরিবারের অংশ হয়ে যায় বাংলাদেশ। নাক–উঁচু ইংল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়ার মন গলাতে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়ি দক্ষতার চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশে ক্রিকেটের বিপুল সম্ভাবনা।
শুরুতেই যা বলেছি, সেটি দিয়েই তাহলে শেষ করি। টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার রজতজয়ন্তী অবশ্যই উদ্যাপন করার উপলক্ষ, তবে একই সঙ্গে চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি মেলানোরও। তা করতে গেলে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে আসে। দুঃখ লাগে, ক্ষোভ হয়, শেষে আচ্ছন্ন করে ফেলে অসহায়ত্বের একটা অনুভূতি। দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মিলও কি খুঁজে পাওয়া যায় না! দুই ক্ষেত্রেই কী বিপুল সম্ভাবনার নিদারুণ অপচয়!
টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার রজতজয়ন্তীতেও বাংলাদেশ শুধু নামেই টেস্ট খেলুড়ে দেশ। প্রথম টেস্ট খেলার ২৫ বছরে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি টেস্ট খেলেছে শুধু শ্রীলঙ্কা (শ্রীলঙ্কা, ১৬৭, বাংলাদেশ ১৫৪)। প্রথম ২৫ বছরে অর্থাগমের দিক থেকে তো নিশ্চিতভাবেই আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ক্রিকেট-বাণিজ্যের রমরমার সঙ্গে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময়টা মিলে যাওয়াতে স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কোষাগার। কিন্তু সেটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিকেট পরিকাঠামো গড়ে উঠল কোথায়! অবকাঠামো, অনুশীলন সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ, সংস্কৃতি—কোনো দিক থেকেই কি বাংলাদেশকে আদর্শ একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশ বলে দাবি করা যায়?
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার কথা না হয় বাদই দিন, পাশের দেশ ভারতও তো চোখের সামনেই বদলে গেল। আগে শুধু ভারতের টাকার জোর ছিল, এখন মাঠের খেলায়ও রীতিমতো ছড়ি ঘোরায়। সেটি সম্ভব হয়েছে ক্রিকেট থেকে আসা বিপুল অর্থ আবার ক্রিকেটেই সঠিকভাবে বিনিয়োগ করায়। হয়তো কালেভদ্রে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ পায়, কোনোটি হয়তো পায়ও না—ভারতের এমন ছোট ছোট শহরেও যেমন স্টেডিয়াম-মাঠ-অনুশীলনের সুবিধা আছে, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুরেও তা নেই।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কার্যত ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়ে থাকায় সারা দেশে খেলার বিস্তার নেই। বিকেন্দ্রীকরণের কথা শুধুই সেই ‘কাজির গরু’ হয়ে রয়েছে; যেটির উপস্থিতি শুধুই কেতাবে, গোয়ালে নয়। টেস্ট ক্রিকেট শেখার পাঠশালা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট; আসলে তো যেকোনো ধরনের ক্রিকেটেরই। ক্রিকেটের মৌলিক বিষয়গুলো তো এখানেই শেখেন ক্রিকেটাররা। অথচ বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এখনো যেন নিজেরা ভাগ হয়ে কিছু ম্যাচ খেলামাত্র। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটারদের তৈরি করার জন্য যা মোটেই উপযুক্ত নয়।
এসব নতুন কোনো কথা নয়। ২৫ বছর ধরেই যা বলা হচ্ছে। প্রথম টেস্ট খেলার রজতজয়ন্তীতে ক্রিকেট বোর্ডের নতুন কমিটি যদি নতুন পথে হাঁটার সংকল্প না করে, তাহলে কে জানে, আরও ২৫ বছর পর, টেস্ট অভিষেকের সুবর্ণজয়ন্তীতেও হয়তো এসবই বলতে হবে!
উৎপল শুভ্র প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক
* মতামত লেখকের নিজস্ব