এই প্রবন্ধে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব এমনভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনের পর কোনো রাজনৈতিক দল অত্যধিক ক্ষমতার মালিক হতে না পারে।
এর মাধ্যমে অনেক উদ্বেগজনক বিষয়ের মোকাবিলা করা সম্ভব, যা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ অনেক দিন ধরে উপলব্ধি করে আসছে। সংবিধানের কাঠামোর পরিবর্তন করা না হলে, ক্ষমতার অপব্যবহারের যে চিত্র আমরা আগে দেখেছি, তা আবার ঘটার আশঙ্কা আছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সংস্কার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো। আমরা বিগত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে দেখতে পাই যে সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে ওঠেন।
এটাই আমাদের সংবিধানের প্রধানতম সমস্যা, যার মূলে রয়েছে আমাদের এককক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ। যিনি যেকোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হোন না কেন, কোনো রকম অর্থপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার অপরিসীম সুযোগ তৈরি করে ফেলেন। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সূত্রপাত ঘটে।
এই সমস্যার সমাধান কেবল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতিশ্রুতিতে নয়, বরং সংসদের মূল কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব। এখানে ‘চেক ও ব্যালান্স’ বা ভারসাম্য রক্ষার তত্ত্বের প্রয়োগ অপরিহার্য।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষমতা দুই বা ততোধিক সংস্থার মধ্যে বণ্টিত হবে; কোনো সংস্থা আপনা–আপনি নিজের মতো করে পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে না, বরং একে অপরকে নজরদারির মধ্যে রাখবে। বর্তমানে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ এই ভারসাম্যের অভাব তৈরি করে, যা প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাচারিতা এবং নিয়ম ভেঙে যা খুশি তা করতে পারার সুযোগ তৈরি করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছর ক্ষমতাচ্যুত সরকারের নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচনের কারচুপি থেকে শুরু করে ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাৎ এবং সম্ভাব্য প্রতিপক্ষদের হত্যা করার মতো ঘটনাগুলো প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ।
এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে ক্ষমতার কাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ একটি জরুরি পদক্ষেপ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংসদের একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা সবচেয়ে সহজ ও বাস্তবসম্মত সমাধান, যা বিদ্যমান জাতীয় সংসদের (নিম্নকক্ষ) পাশাপাশি কাজ করবে।
‘চেকস এবং ব্যালান্স’ তত্ত্বের আলোকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রস্তাবটি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু কাঠামোব্যবস্থা সুচারুভাবে গঠিত না হলে এর আশানুরূপ ফল আমরা পাব না। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কাঠামো নিয়ে আলোচনা ও নানামুখী প্রস্তাব দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এই পরিবর্তনের সুপারিশ উঠে এসেছে, যেখানে একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট) এবং একটি নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) রাখার কথা বলা হয়েছে।
এই প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যমান ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই সংস্কারপ্রক্রিয়া অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত কমিশন দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাপক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে; যেখানে অন্তত ১৪টি রাজনৈতিক দল নীতিগতভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে মত দিয়েছে, যদিও গঠনপ্রণালি নিয়ে মতপার্থক্য বিদ্যমান।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, নিম্নকক্ষ বা জাতীয় সংসদের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। তবে মূল আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে উচ্চকক্ষের গঠনপ্রক্রিয়া ঘিরে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বপদ্ধতি (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) কেন্দ্রীয় প্রস্তাব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই পদ্ধতি অনুযায়ী, সিনেটের ১০০টি আসন নিম্নকক্ষে নির্বাচনে প্রাপ্ত মোট ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে বণ্টন করা হবে, যেখানে ন্যূনতম এক শতাংশ ভোট পাওয়ার শর্ত রাখা হয়েছে। এর ফলে আসনভিত্তিক নির্বাচনে পিছিয়ে পড়া ছোট দল বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও আইনসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।
কিছু রাজনৈতিক দল এই পদ্ধতিকে সমর্থন করেছে। আবার কিছু সমালোচক মনে করেন, এই প্রস্তাব উচ্চকক্ষকে নিম্নকক্ষের ‘প্রতিলিপি’তে পরিণত করবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, শ্রমিক, নারী অধিকারকর্মী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী থেকে নির্দলীয় প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। সংস্কারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ নিয়ন্ত্রিত ভূমিকা রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সিনেটের পাঁচটি আসনে রাজনীতিনিরপেক্ষ বিশিষ্ট নাগরিক মনোনয়ন দেবেন, যা আইনসভায় দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটাবে।
তবে এই প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ গঠনকাঠামো আমাদের জন্য কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে আশাবাদ ও আশঙ্কা উভয়ই রয়েছে। সম্ভাব্য ইতিবাচক দিকগুলো ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং আইনের গুণগত মান বৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রভাব রাখবে। এর সঙ্গে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ছোট দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিস্তৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে। সংবিধান সংশোধনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বাধ্যবাধকতা থাকায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে সম্ভাব্য নেতিবাচক দিক ও প্রতিবন্ধকতাগুলো হতে পারে, ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ আর্থিক ব্যয় এবং অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে নিম্নকক্ষ হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধি; সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাঁদের জবাবদিহিও বেশি। ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উচ্চকক্ষের গঠনকাঠামো নির্ণয় করা হবে আমাদের মুখ্য কাজ।
বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষকে একটি স্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো রূপ দেওয়া জরুরি। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব যদি উচ্চকক্ষকে নিম্নকক্ষের প্রতিলিপিতে পরিণত করে, তাহলে জবাবদিহির আলোকে এটি তার নিরপেক্ষতা হারাতে পারে।
এই আঙ্গিকে উচ্চকক্ষ রাজনীতিবিদ বা তার প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হওয়া সমীচীন হবে না, বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীতি অনুসরণ করে মনোনীত ১১ সদস্যের একটি ‘জ্যেষ্ঠ পরিষদ’ হিসেবে গঠিত হতে পারে। এসব সদস্য তাঁদের কর্মক্ষেত্রে সমাদৃত, উচ্চমানের সততার ধারক, রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত এবং ষাট বা তার বেশি বয়সী হবেন। তাঁদের কাজ হবে নিম্নকক্ষের কার্যবিধির নজরদারি করা এবং শুধু প্রধানমন্ত্রী বা নিম্নকক্ষ অপ্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদর্শন করলে হস্তক্ষেপ করা।
উচ্চকক্ষের দুটি প্রধান কার্যবিধি প্রস্তাব করা যেতে পারে: বিধানিক কার্যবিধি এবং নজরদারির কার্যবিধি। বিধানিক কার্যবিধির অধীনে নিম্নকক্ষের যেকোনো বিল বা আইন প্রস্তাবিত হলে, এমনকি অর্থবাজেটও, তা উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হবে। যদি উচ্চকক্ষের অনুমোদন না পাওয়া যায়, তবে নিম্নকক্ষ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমে উচ্চকক্ষের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করতে পারবে।
এই যাচাইপ্রক্রিয়া যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ‘বিবেকহীন’ আইনের অনুমোদন রোধে একটি ‘প্রতিবন্ধক’ হিসেবে কাজ করবে। এটি বিরোধী দলকে রাজপথের সহিংস কার্যক্রমের পরিবর্তে সংসদীয় প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্তি তুলে ধরার সুযোগ দেবে এবং একটি ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে কাজ করে সংসদকে কার্যকর দুই কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করবে।
নজরদারির কার্যবিধির অধীনে উচ্চকক্ষের হাতে সরকারি কর্ম কমিশন নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, তথ্যাধিকার কমিশন, কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের অফিস, জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা, সংবাদমাধ্যম প্রবিধান কমিশন ও সেন্সরশিপ কমিশনের তদারকির ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। এর মাধ্যমে উচ্চকক্ষ এই সব কমিশনকে বাইরের চাপ থেকে রক্ষা করে তাদের জবাবদিহিমূলক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় সহায়তা করবে এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে অনধিকারচর্চা থেকে নিবৃত্ত করবে।
উপসংহারে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ একটি যুগান্তকারী সংস্কার প্রস্তাব, যার মূল লক্ষ্য গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং ক্ষমতার একটি কার্যকর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। এর সাফল্য নির্ভর করছে উচ্চকক্ষের গঠনপ্রক্রিয়া এবং তাকে দেওয়া ক্ষমতার ওপর। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আইনসভা তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করলেও এর প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক বিতর্ক বিদ্যমান।
এই প্রস্তাব নিছক একটি কাঠামোগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ধারণের একটি মৌলিক পরীক্ষা, যেখানে বৃহত্তর জবাবদিহির প্রতিশ্রুতির বিপরীতে রয়েছে আইন প্রণয়নের দীর্ঘসূত্রতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অকার্যকারিতার ঝুঁকি। একটি নিরপেক্ষ রেফারি বা ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে উচ্চকক্ষ বিশৃঙ্খলা রোধে এবং নীতি মেনে চলার দায়িত্ব গ্রহণে সহায়তা করবে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থিতিশীল ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
সালাহ্দীন ইমাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান’ বিষয়ে স্নাতক ও ‘তুলনামূলক সমাজতত্ত্ব’ বিশেষজ্ঞ।
ই–মেইল: salimam32@yahoo.com
*মতামত লেখকের নিজস্ব