ভারতের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমাগত হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ
ভারতের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমাগত হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

মতামত

ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে খ্রিষ্টানদের কোণঠাসা করছে

কেরালা লোক ভবনে কর্মীদের বড়দিনের ছুটি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত সারা ভারতে ব্যাপক জনরোষের সৃষ্টি করে। এটি শুধু প্রশাসনিক রীতি মানার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ ছিল না। কর্মীদের ২৫ ডিসেম্বর পালিত গুড গভর্ন্যান্স ডে উপলক্ষে আয়োজিত সরকারি কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। এই দিনটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়।

লোক ভবনকে ঘিরে বিতর্ক আরও তীব্র হয় এর আগে প্রকাশিত তাদের সরকারি ক্যালেন্ডার নিয়ে। সেই ক্যালেন্ডারের ফেব্রুয়ারি মাসের পাতায় ভি ডি সাভারকরের প্রতিকৃতি ছাপা হয়েছিল। এই অন্তর্ভুক্তি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এবং অনেকের কাছে এটি নিরপেক্ষ ইতিহাসের বদলে একটি আদর্শগত বার্তা বলেই মনে হয়। এই দুই ঘটনা একসঙ্গে দেখলে স্পষ্ট হয় যে এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি ধারাবাহিক প্রবণতার অংশ।

যদিও ২৫ ডিসেম্বরের কর্মসূচিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত সরকারি কার্যক্রম হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল, তবু এর রাজনৈতিক প্রতীকী অর্থ উপেক্ষা করা যায় না। বড়দিন কেবল একটি সাধারণ তারিখ নয়। এটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। সেই দিনে বাধ্যতামূলক উপস্থিতির নির্দেশ বিশেষ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে, যা উল্লেখযোগ্য খ্রিষ্টান জনসংখ্যার রাজ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে—তা নিরপেক্ষতার নয় বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য জাহির করার একটি সচেতন বার্তা দেয়।

এই ঘটনাপ্রবাহ আসলে আরও গভীর ও উদ্বেগজনক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধীনে জনজীবনে ধর্মীয় সহনশীলতা ও সমন্বয়ের জায়গা ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

এই ধারা নতুন নয় এবং শুধু কেরালাতেই সীমাবদ্ধ নয়। চলতি বছর উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকার ঘোষণা করে যে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটি না দিয়ে স্কুল খোলা রাখা হবে। ওই দিন শিক্ষার্থীদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বাধ্যতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বলা হয়।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টান সংগঠন ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল, এতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করা হচ্ছে এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে প্রতীকী অবহেলা আসলে আরও ভয়াবহ বাস্তবতার কেবল বাইরের দিক। ভারতে খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা ধারাবাহিকভাবে এবং প্রমাণযোগ্যভাবে বেড়েছে।

ইভানজেলিক্যাল ফেলোশিপ অব ইন্ডিয়ার রিলিজিয়াস লিবার্টি কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ তথ্য। হেট অ্যান্ড টার্গেটেড ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ক্রিশ্চিয়ানস ইন ইন্ডিয়া ইয়ারলি রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে হামলার নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ২০২৩ সালের ৬০১ থেকে ২০২৪ সালে অন্তত ৮৩০ তে পৌঁছেছে। গত এক দশকে এটি অন্যতম সর্বোচ্চ বার্ষিক সংখ্যা এবং এটি কোনো বিচ্ছিন্ন অস্থিরতার ফল নয় বরং একটি কাঠামোগত প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।

এই সহিংসতার ভৌগোলিক বিস্তারেও একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ছক দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে উত্তর প্রদেশে। এরপর রয়েছে ছত্তিশগড়, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা। এসব রাজ্যে ক্রমে উগ্র সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী বক্তব্য স্থানীয় শাসনব্যবস্থা, পুলিশি আচরণ ও রাজনৈতিক সংগঠনের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এই রাজ্যগুলোতে হামলার ঘটনার ঘনত্ব দেখায় যে খ্রিষ্টানবিরোধী সহিংসতা কোনো প্রান্তিক ঘটনা নয় বরং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আদর্শিক পরিবেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে কার্যকর হওয়া ধর্মান্তর বিরোধী আইন খ্রিষ্টানদের জন্য আইনি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলে স্বাভাবিক ধর্মীয় কার্যক্রমও সহজেই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাস্তবে এসব আইন অনেক সময় জোরজবরদস্তি রোধের চেয়ে বেশি করে উগ্র নজরদারি ও জনতার হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়।

ছত্তিশগড় সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখায় কীভাবে শারীরিক সহিংসতা ও আইনি চাপ একসঙ্গে কাজ করছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রেলস্টেশন ও বিভিন্ন গণপরিবহন কেন্দ্রে খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনী ও যাজকদের মানবপাচার বা জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগে আটক করা হয়েছে। এসব অভিযোগ তাঁরা ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করেছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

নাগরিক স্বাধীনতা বিষয়ক সংগঠনগুলোর মতে, এই গ্রেপ্তারগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে বেশি ভয়ভীতি প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য জনপরিসরে খ্রিষ্টানদের উপস্থিতিকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরা।

এই সবকিছুই যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটছে, তা থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে কার্যকর হওয়া ধর্মান্তর বিরোধী আইন খ্রিষ্টানদের জন্য আইনি অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলে স্বাভাবিক ধর্মীয় কার্যক্রমও সহজেই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বাস্তবে এসব আইন অনেক সময় জোরজবরদস্তি রোধের চেয়ে বেশি করে উগ্র নজরদারি ও জনতার হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়। এই সময়টিকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক করে তুলছে এই ধরনের ‘বর্জন’ ও বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান স্বাভাবিকীকরণ।

যখন ধর্মীয় ছুটি বাতিল, যাজকদের ওপর হামলা বা গির্জা ভাঙচুর আর সাংবিধানিক সংকট হিসেবে নয় বরং নিয়মিত খবর হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন তা গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। এটি শুধু খ্রিষ্টানদের নয়, সব ভারতীয় নাগরিকের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। ভারতের সংবিধান ধর্মের স্বাধীনতা ও সমান নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ক্রমশ দেখাচ্ছে যে এই অধিকারগুলো রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।

এই প্রেক্ষাপটে কেরালা লোক ভবনে বড়দিনের ছুটি না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কোনো সাধারণ প্রশাসনিক বিষয় হিসেবে দেখা যায় না। বরং এটি একটি বৃহত্তর আদর্শিক পরিবর্তনের স্পষ্ট লক্ষণ। এমন এক পরিবর্তন যেখানে জনপরিসর ধীরে কিন্তু পরিকল্পিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের অগ্রাধিকারের দিকে ঝুঁকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে জাতির সামষ্টিক কল্পনায় সংখ্যালঘুদের প্রতীকী ও বাস্তব জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

অমল চন্দ্র লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত