
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপকে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিবেক হিসেবে উদ্যাপন করা হয়েছে—একটি করপোরেট পরিবার, যারা মুনাফার সঙ্গে দাতব্য কাজকে, উন্নয়নের সঙ্গে নৈতিকতাকে যুক্ত করেছে। কোটি কোটি ভারতীয়ের কাছে ‘টাটা’ মানে বিশ্বাস—একটি ব্র্যান্ড, যা আধুনিক ভারতের গল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। কিন্তু এই সুপরিকল্পিত সুনামের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্ধকার বাস্তবতা—যা এখন টাটাকে সরাসরি যুক্ত করছে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রের সঙ্গে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দক্ষিণ এশীয় সংগঠন সালামের প্রকাশিত নতুন রিপোর্ট আর্কিটেক্টস অব অকুপেশন: দ্য টাটা গ্রুপ, ইন্ডিয়ান ক্যাপিটাল অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়া–ইসরায়েল অ্যালায়েন্স–এ বলা হয়েছে, টাটা ভারত–ইসরায়েল সামরিক অংশীদারত্বের ‘কেন্দ্রবিন্দুতে’ রয়েছে এবং ‘দখল, নজরদারি ও উচ্ছেদের স্থাপত্যে মৌলিকভাবে জড়িত।’
টিআরটি ওয়ার্ল্ড–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাটার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক–শিল্পকাঠামোকে শক্তিশালী করছে।
রিপোর্টে টাটা গ্রুপের কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড (টিএএসএল)—ভারতের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি প্রতিরক্ষা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বহুদিন ধরে ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। তারা একসঙ্গে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য বারাক–৮ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরি করে, যা ইসরায়েলের নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মূল অস্ত্র এবং গাজায় হামলায় ব্যবহৃত হয়। টিএএসএল এফ–১৬ যুদ্ধবিমান ও অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টারের অংশও উৎপাদন করে, যা ইসরায়েল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে।
জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার (জেএলআর)—টাটার আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান—অভিযোগ রয়েছে যে তারা এমডিটি ডেভিড নামে হালকা সাঁজোয়া যান তৈরিতে চেসিস সরবরাহ করে, যা ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীরে টহল ও জনতাকে দমন করার অভিযানে ব্যবহার করে।
ভারতের কাশ্মীরে ব্যবহৃত অনেক নজরদারি ব্যবস্থাও এই সামরিক নেটওয়ার্কের অংশ। এভাবে একটি দখলদার শক্তি অপর দখলদার শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হিন্দুত্ব ও জায়নিজম মতাদর্শগতভাবে মিলে যায়।
টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিস (টিসিএস) একটি আইটি জায়ান্ট, যা ইসরায়েলের সরকারি ও আর্থিক খাতের ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরিতে যুক্ত, বিশেষ করে প্রজেক্ট নিমবাসে—যা গুগল ও অ্যামাজন পরিচালিত একটি বিতর্কিত ক্লাউড কম্পিউটিং প্রকল্প এবং ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় নজরদারি কাঠামোকে শক্তিশালী করে।
রিপোর্ট বলছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়; বরং ভারতের পুঁজি ইসরায়েলের ‘দখলদারি অর্থনীতির’ অভ্যন্তরে গভীরভাবে যুক্ত। টাটার আন্তর্জাতিক ইভেন্ট স্পনসরশিপ—যেমন নিউ ইয়র্ক সিটি ম্যারাথনকে রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘স্পোর্টস–ওয়াশিং’, অর্থাৎ যুদ্ধে মুনাফা অর্জনের নৈতিক প্রশ্ন আড়াল করার প্রচেষ্টা। বারবার অনুসন্ধান পাঠানো হলেও টাটা গ্রুপ অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ইসরায়েলের সঙ্গে টাটার সম্পর্ক শূন্য থেকে হয়নি। এটি ভারতের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা নীতির করপোরেট রূপান্তরের প্রতিফলন। ১৯৯০-এর দশক থেকে, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির আমলে, ভারত নীরব কূটনীতি থেকে বের হয়ে এসে ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কৌশলগত জোট গড়ে তুলেছে। আজ ভারত ইসরায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা—ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা রপ্তানির ৪০–৪৫ শতাংশ ভারতের কাছে যায়।
ভারত–ইসরায়েলের যৌথ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্প, যা আংশিকভাবে টাটার কারখানায় সংযোজিত; ভারত ইসরায়েল থেকে ড্রোন ও অ্যান্টি ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র, যেসব অস্ত্র কেনে যা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। ভারতের কাশ্মীরে ব্যবহৃত অনেক নজরদারি ব্যবস্থাও এই সামরিক নেটওয়ার্কের অংশ। এভাবে একটি দখলদার শক্তি অপর দখলদার শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হিন্দুত্ব ও জায়নিজম মতাদর্শগতভাবে মিলে যায়।
উভয়ই ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ বক্তব্যকে আগ্রাসন ও দখলদারির যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। উভয়েই নজরদারি ও জাতিগত নিয়ন্ত্রণকে স্বাভাবিকীকরণ করে। সুতরাং টাটার এই সম্পর্ক শুধু বাণিজ্য নয়—এটি করপোরেট পুঁজি, রাষ্ট্রীয় শক্তি ও মতাদর্শের সম্মিলিত প্রকল্প।
টাটা একা নয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বহুদিন ধরেই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের দমননীতিকে সমর্থন করে আসছে—এইচপি, ক্যাটারপিলার, গুগল, অ্যামাজন—অনেক নামই এই তালিকায়। কিন্তু টাটার অবস্থান বিশেষ কারণ—তারা নৈতিকতার দাবিদার। গান্ধীর নাম ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেওয়া কোম্পানি এখন মৃত্যু–অর্থনীতিতে মুনাফা করছে। তাদের নিজস্ব আচরণবিধিতেও বলা আছে—মানবাধিকার লঙ্ঘনে অংশ না নেওয়ার অঙ্গীকার। কিন্তু বাস্তবে নেই—প্রতিরক্ষা খাতে তাদের আয়ের কোনো স্বচ্ছতা, মানবাধিকারের প্রভাব মূল্যায়ন কিংবা কোনো অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি।
রিপোর্টে এই আচরণকে বলা হয়েছে—‘জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নৈতিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’–এর নামে নৈতিক জবাবদিহি থেকে পালানো।
মূলধারার ভারতীয় গণমাধ্যম টাটা-সম্পর্কিত তথ্য প্রায় প্রকাশই করেনি। সরকারও কোনো তদন্তে আগ্রহ দেখায়নি। বরং ভারত–ইসরায়েল অংশীদারত্বকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মডেল হিসেবে প্রচার করছে। একসময় ফিলিস্তিনের দৃঢ় সমর্থক ভারত, এখন নীরব। বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা বন্ধ হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে গ্রেপ্তারের ঝুঁকি। এটি শুধু করপোরেট নীরবতা নয়; এটি সমষ্টিগত নৈতিক পতনের প্রতিচ্ছবি।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী—যেকোনো কোম্পানি যুদ্ধাপরাধে ব্যবহৃত সরঞ্জাম সরবরাহ করলে তারা অপরাধে সহায়তাকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
টাটার অস্ত্র বা উপকরণ গাজায় ব্যবহৃত হয়ে থাকলে স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। ১৯৮০-এর দশকে যেমন বৈশ্বিক আন্দোলন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিল, তেমনি এখন ইসরায়েলি বর্ণবাদ থেকে লাভবানদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন দরকার। বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট, স্যাংশনস (বিডিএস) আন্দোলন এমনই একটি পথ।
গণহত্যার মুখে টাটার নীরবতা শুধু করপোরেট ব্যর্থতা নয়; এটি ভারতের নৈতিক আত্মপরিচয়ের দেউলিয়া হওয়ার প্রমাণ। গাজায় শিশুরা অনাহারে, পরিবারগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে আর টাটা তাদের হত্যার যন্ত্রকে প্রযুক্তি সরবরাহ করে; একই সময়ে বিজ্ঞাপনে দেখায় ‘মানবতা’ ও ‘উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার’ প্রতিশ্রুতি। কোনো দেশ নৈতিক নেতৃত্ব দাবি করতে পারে না, যখন তার করপোরেশনগুলো নিপীড়িতদের রক্ত থেকে মুনাফা করে। ভদ্র নীরবতার সময় শেষ। ভারতকে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে হবে এবং যে মানবিকতা সে একসময় বিশ্বের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা ফিরে পেতে হবে।
রঞ্জন সলোমন ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া
অনুবাদ ও সংক্ষিপ্তকরণ: মনজুরুল ইসলাম