প্রথমে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এ এবং পরে ছায়ানট ও উদীচীতে যে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। হামলাকারীরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে পরিকল্পিতভাবে নথিপত্র, সরঞ্জাম এবং মূল্যবান আর্কাইভ ধ্বংস করেছে। ব্যাপক লুটপাট করেছে। ডেইলি স্টার ভবনের ভেতরে অবস্থানরত সাংবাদিকসহ নারী–পুরুষের জীবন বিপন্ন করেছে। তাঁদের বাঁচাতে লেখক সম্পাদক নূরুল কবীর ওই ভবনে গেলে তাঁর ওপরও আক্রমণ করা হয়েছে।
একই সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান, বাসভবন ও ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং সহিংস উন্মাদনা ছড়ানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে এ ধরনের সমন্বিত হিংস্র উন্মাদনা আগে কখনো দেখা যায়নি। ঘটনাগুলো অবিশ্বাস্য হলেও কোনোভাবেই আকস্মিক নয়।
অনেক দিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বিভ্রান্তিকর তথ্যের মাধ্যমে লাগাতার আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছিল। জনগণকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এই উসকানি দেশের ভেতর থেকেও এসেছে, দেশের বাইরে থেকেও এসেছে। ফলে সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা যাঁরা নিয়মিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদের কাছে বিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়। উত্তেজনা তৈরির মাধ্যমে একটি সংঘবদ্ধ সহিংসতার পরিবেশ তৈরি করা কিংবা তাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা ছিল স্পষ্ট।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে এই গোষ্ঠী আরও তৎপর হয়ে ওঠে। হাদিকে হত্যাচেষ্টার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাধারণ নাগরিকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করেন। কারা আক্রমণ করেছে, কীভাবে আক্রমণ করেছে, এসব বিষয়ে ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হয়। কিন্তু সেই সময় গোয়েন্দা সংস্থা বা সরকারের বাহিনীর পক্ষ থেকে তেমন কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি।
বরং বলা হলো, হত্যাকারী নাকি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেছে। অথচ সন্ত্রাসী উন্মাদনার পর পুলিশ থেকে বলা হচ্ছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিই ভারতে গেছেন কি না, সে বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। হাদির মৃত্যুর পর এই অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর তথ্যকে পুঁজি করেই একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। হত্যার বিচার, হত্যাকারীকে ধরার বিষয় বাদ দিয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
হাদির মৃত্যুর পর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং কারা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে, সে তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার জানার কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যেই আক্রমণের ডাক দিচ্ছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের কিছু নেতা ও ব্যক্তি। এর বাইরেও নানা উসকানিমূলক তৎপরতা চলছিল। এসব তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার অজানা থাকার কথা নয়। এত তথ্য সত্ত্বেও এক রাতেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। এই অবস্থা নতুন নয়, তথ্য থাকা সত্ত্বেও সরকারের ভয়াবহ নিষ্ক্রিয়তা মাসের পর মাস ধরে চলতে দেখা যাচ্ছে।
এই গোষ্ঠী এমন একটি সমাজ তৈরি করতে চায়, যেখানে মানুষ রোবটের মতো থাকবে এবং ভিন্নমত, ধর্ম, লিঙ্গ ও পরিচয়ের মানুষের ওপর সহিংসতা চালানো হবে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য একটি বড় বার্তা যে বহু বছরের স্বৈরশাসন, লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার ফলে সমাজে একটি ভয়ংকর অপশক্তি তৈরি হয়েছে।
আমরা দেখছি, যারা এই হামলাগুলো চালিয়েছে, তারা দীর্ঘদিন ধরেই মাজারে আক্রমণ, বাউলদের ওপর হামলা, নারীদের হুমকি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা, নাটক ও গানের অনুষ্ঠানে চাপ সৃষ্টি, গান বন্ধ করা ইত্যাদি হামলা ও হুমকি দিয়ে আসছে। শিল্পী ও সংস্কৃতিচর্চার ওপর তারা বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। এসবের পেছনে একই গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা এই সহিংসতা অব্যাহত রাখতে পেরেছে, কারণ সরকার এখন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনার জন্য প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এর ফলেই তারা নিজেদের ক্ষমতায়িত ভাবছে, বুঝে গেছে যে তারা যা খুশি বলতে পারে এবং করতে পারে। একই সঙ্গে আমরা দেখছি, বিদেশ থেকে দুজন উসকানিদাতা মাসের পর মাস ধরে হিংস্র বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, ভাঙচুর, সন্ত্রাস ও হামলার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তারা বিভিন্ন সময় প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেও আক্রমণের ডাক দিয়েছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো, যখন সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে, তখন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
এতে প্রশ্ন ওঠে, বিদেশ থেকে যারা উসকানি দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে সরকারের কোনো যোগাযোগ আছে কি না। সরকার কি তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, নাকি তাদের ব্যবহার করছে। ধর্মের নামে যারা এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সরকারের প্রশ্রয়ের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে কেন, সেটাই বড় প্রশ্ন।
১৮ ডিসেম্বর রাতের ঘটনাতেও সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা অত্যন্ত স্পষ্ট। হামলার পর যারা আক্রমণ করেছে, তারা গর্বের সঙ্গে ভিডিও করেছে এবং তা প্রকাশ করেছে। টেলিভিশন ক্যামেরায় তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখা গেছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদীচীসহ বেশ কিছু স্থানে হামলা হয়েছে এবং আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা খুবই সহজ। ফেসবুকে কারা উসকানি দিয়েছে, কারা আহ্বান জানিয়েছে, কারা হামলার কথা বলেছে, সবই দৃশ্যমান। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সহিংসতার উসকানি দেওয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। ঘটনার কয়েক দিন পার হয়ে গেলেও এখনো মূল উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
এটাই সরকারের ভূমিকার ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে। এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে যারা বৈষম্যবাদী রাজনীতি করে, ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও বিদ্বেষ ছড়াতে চায় এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তাদের প্রতি সরকারের একটি নমনীয়তা ও প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। তাদের ‘প্রেশার গ্রুপ’ বা চাপ সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে বর্ণনা করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর ফলেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী তৎপরতা হয়েছে। ভালুকায় শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগে নির্মমভাবে পিটিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের জন্য এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এসব ঘটনা ঘটছে, কারণ হামলাকারীরা ধরে নিচ্ছে যে সরকার তাদেরই লোক অথবা সরকার বলে কিছু নেই।
এই বাস্তবতার মধ্যে স্মরণ করি যে কিছুদিন আগে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বললেন, ‘এখন আমরা সভ্যতার পথে পা বাড়িয়েছি। আমরা এমন এক সভ্যতা গড়ে তুলব, যা দেখে বিশ্ববাসী ঈর্ষান্বিত হবে।’ এসব নৃশংসতাই কি তাহলে সেই সভ্যতার নমুনা?
এই নৃশংস সহিংস পরিস্থিতি যারা তৈরি করছে, তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের শত্রু এবং ২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানেরও শত্রু। তারা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশাকে উল্টো পথে নিয়ে যেতে চায়। তারা নারীর সক্রিয়তার বিরোধী, সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির বিরোধী এবং ইতিহাস দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে দমন করতে চায়।
এই গোষ্ঠী এমন একটি সমাজ তৈরি করতে চায়, যেখানে মানুষ রোবটের মতো থাকবে এবং ভিন্নমত, ধর্ম, লিঙ্গ ও পরিচয়ের মানুষের ওপর সহিংসতা চালানো হবে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য একটি বড় বার্তা যে বহু বছরের স্বৈরশাসন, লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার ফলে সমাজে একটি ভয়ংকর অপশক্তি তৈরি হয়েছে।
এদের মোকাবিলা না করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। সর্বস্তরে বৈষম্যবাদী অপশক্তি প্রতিরোধ এবং জনপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা বিস্তারে সব গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা খুবই জরুরি।
আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক
মতামত লেখকের নিজস্ব