Thank you for trying Sticky AMP!!

শিশু সাহিত্য: রাজকন্যাকে কেন সুন্দরী হতেই হবে

‘রাজপুত্র না এলে রাজকন্যা কি কখনো রাক্ষসরাজ্য থেকে মুক্তি পাবে না?’

সদ্য সমাপ্ত বইমেলার খুব সম্ভবত তৃতীয় শুক্রবার ছিল সেদিন। আমি বসে ছিলাম শিশু চত্বরের একটি স্টলে। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ একটি শিশুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সে দোকানে থাকা বিক্রয়কর্মীর কাছে প্রিন্সেস কিংবা রাজকুমারীর ওপর লেখা বই চাইছিল। মেয়েটির বয়স বড়জোর আট বছর হবে। প্রিন্সেসের প্রতি তার এই আগ্রহ আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। শিশুটির কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। জানতে চাইলাম, ‘তুমি প্রিন্সেসের বই কেন পছন্দ করো?’ শিশুটি যেন একটু লজ্জা পেল। হেসে উত্তর দিল, ‘প্রিন্সেসরা দেখতে খুব সুন্দর হয়। ওরা ভীষণ ফরসা, চুল লম্বা, আবার রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়েও হয়। আমার প্রিন্সেস হতে খুব ইচ্ছা হয়।’ শিশুটির কথা শুনে তার মা হাসছিলেন। তাঁর মুখের রেখায় ফুটে উঠেছে গর্বের হাসি। শিশুটির উত্তর শুনে হতভম্ব আমি হাসতে চেষ্টা করলাম বটে, তবে হাসতে পারলাম না।

প্রতিবারের মতো এবারের বইমেলাতেও শিশুদের জন্য ছিল বইয়ের আলাদা আয়োজন। শিশু চত্বরে তো বটেই, বড়দের বইয়ের প্যাভিলিয়ন এবং স্টলেও শিশুদের জন্য বইয়ের কর্নার চোখে পড়েছে। সেখানে ছিল শিশুতোষ অনেক বই। তবে সেই বইগুলো আদৌ শিশুতোষ হয়ে উঠেছে কি না, তা প্রশ্ন। শিশুদের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন বইয়ের সামগ্রিক ঘাটতির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু যে বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয় না, সেটি হলো বইয়ের বাজারে শিশুদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল বইয়ের অভাব। এই অভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় বইমেলার মতো আয়োজনগুলোতে।

Also Read: নতুন বাংলা পাঠ্যবইয়ে নারী লেখকেরা কোথায়

রূপকথার গল্পগুলো নিশ্চিতভাবেই শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এবং নারী-পুরুষের পরিবর্তিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা বিবেচনায় এসব বইয়ের অনেক বিষয়বস্তু নিয়েই নতুন করে চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বড়দের তুলনায় শিশুরা ছাপা হরফের প্রতি অনেক বেশি আস্থাশীল থাকে। শিশুরা বয়সে ও অভিজ্ঞতায় অপরিপক্ব হওয়ায় অনেক কিছুই বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়। সমালোচনামূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক ভাবনাই হয়তো তাদের মাথায় আসে না। তবে আশার কথা, রূপকথার গল্প পড়ে আজকাল অনেক শিশুই প্রশ্ন করে, ‘রাজার কেন সাত রানি হয়?’ ‘যেকোনো অপরাধে রানিকেই কেন বনবাসে পাঠানো হয়?’ ‘রানিকে কিংবা রাজকন্যাকে কি সুন্দর হতেই হয়?’ ‘ডাইনি কিংবা পিশাচিনীরা দেখতে কেন সব সময় অসুন্দর হয়?’ ‘রানিকে কি পুত্রসন্তানের জন্ম দিতেই হয়?’ ‘রাজপুত্র না এলে রাজকন্যা কি কখনো রাক্ষসরাজ্য থেকে মুক্তি পাবে না?’ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আজকাল হিমশিম খান অভিভাবকেরা।

Also Read: রাজাদের কেন সাতটা রানি? রাজকন্যারা কেন নিয়ন্ত্রিত?

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আধুনিক শিশুসাহিত্যেও নারী-পুরুষের চরিত্রায়ণে প্রথাগত থেকে যেন কিছুতেই বের হতে পারছেন না সাহিত্যিকেরা। রাজা-রানি ও রাক্ষস-খোক্ষসের যুগের গল্পের প্রায় অবসান হলেও অবসান হয়নি নারী-পুরুষের প্রথাগত আর প্রত্যাশিত ভূমিকার। অবাক হতে হয় অনেক নামীদামি লেখকও শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত সাহিত্যে নারী ও পুরুষের চিত্রায়ণে একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। নারী চরিত্র মানেই যেন চরিত্রটি সৌন্দর্য বর্ণনার অধীন। এমনকি শিশু নারী চরিত্রগুলোও বাদ পড়ে না এই বর্ণনা থেকে। ফরসা গায়ের রং, মাথাভর্তি ঘন চুল, গোলাপি রঙের গাল, কিংবা হাসলে গালে টোল পড়ে, এই ধরনের বিশেষণগুলো অহরহ ব্যবহৃত হয় শিশুসাহিত্যে মেয়েশিশুর বর্ণনায়। একই প্রভাবে প্রভাবিত চরিত্রকে অলংকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত চিত্রশিল্পীরা। শিল্পীর তুলিতে অকারণেই নারী চরিত্রগুলো হয়ে ওঠে নিখুঁত শারীরিক সৌন্দর্যের অধিকারী। আর রাজকন্যার মতো চরিত্র হলে তো কথাই নেই। রাজকন্যা মানেই যেন তিনি রূপে অনন্যা। রাজকন্যার গালে গোলাপি আভা দিতে কখনো ভুল হয় না তাঁদের। অথচ শ্যাম বর্ণের কোনো রাজকন্যার ছবি আজ পর্যন্ত কোনো রূপকথার গল্পের বইয়ে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নারী চরিত্রগুলোর ভূমিকা আর প্রত্যাশাও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ।

Also Read: নিজের নামেই উজ্জ্বল হোক নারী

কমিকসের বইয়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে যেমন আছে নারীর সক্ষমতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতি অবমাননাকর ভাষার ব্যবহার, তেমনি আছে নারীদেহের আপত্তিকর অলংকরণ। বইমেলায় হাতে নিয়েছিলাম কয়েকটি গ্রাফিক নভেল। সেখানেও চোখে পড়েছে নারীর নির্লজ্জ শরীরসর্বস্ব অগুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপন। গোয়েন্দা গল্পগুলোতে পুরুষ চরিত্রগুলোই একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে চলেছে যুগের পর যুগ।
সাহিত্যের যেকোনো ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল হলো শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্য রচনা করতে হয় অনেক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। আমাদের সাহিত্যের চরিত্ররা মূলত আমাদের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের আদলেই তৈরি।

ব্যতিক্রম নয় শিশুসাহিত্যও। শিশুসাহিত্যের বিষয়বস্তু ও চরিত্রায়ণে সনাতনী মানসিকতা কিংবা সীমাবদ্ধতা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই কাহিনি, ভাষার ব্যবহার, অলংকরণ, রঙের ব্যবহারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কাজটি যে খুব কঠিন, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজটি শুরু করাটা খুব জরুরি। বলা বাহুল্য, পাশ্চাত্যের অনেক দেশে এরই মধ্যে পুরোনো রূপকথার কাহিনিগুলো নতুনভাবে লেখার আয়োজন শুরু হয়েছে; যেখানে নারী চরিত্রগুলোও বলিষ্ঠতা পাচ্ছে ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যুগের চাহিদা ও পরিবর্তিত সময়কে মাথায় রেখে এই কাজে হাত দেওয়া প্রয়োজন আমাদেরও।

শিশুসাহিত্যের সৌন্দর্য হলো, শিশুদের সরল মনে খুব সহজে যেকোনো বার্তা স্থাপন করা যায়। তাই বার্তা প্রবাহের এই আয়োজনটি হতে হবে অনেক বেশি সচেতন ও জেন্ডার সংবেদনশীল। শিশুদের মনের রাজত্বকে মুক্ত করতে হবে নারী-পুরুষের সৌন্দর্য, দক্ষতা আর সক্ষমতার বাক্সবন্দী সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে।

একজন নারীকে শুধু তার সৌন্দর্য দিয়ে বিবেচনা করলে তার গুণগুলো ঢাকা পড়ে যায়। নারী এখন তার যোগ্যতায়, দক্ষতায়, আত্মবিশ্বাসে অনেক দূর এগিয়েছে। তাই পরিবর্তনের এই হাওয়া শিশুসাহিত্যকে প্রভাবিত না করলে, সেই শিশুসাহিত্য একঘরে হয়ে পড়বে। সেই সাহিত্যের সঙ্গে শিশুদের সংযোগ ঘটবে না, তারা শিশুসাহিত্যের পথ ধরে প্রবেশ করবে না সাহিত্যের মূল শাখায়।

শিশুসাহিত্যের সৌন্দর্য হলো, শিশুদের সরল মনে খুব সহজে যেকোনো বার্তা স্থাপন করা যায়। তাই বার্তা প্রবাহের এই আয়োজনটি হতে হবে অনেক বেশি সচেতন ও জেন্ডার সংবেদনশীল। শিশুদের মনের রাজত্বকে মুক্ত করতে হবে নারী-পুরুষের সৌন্দর্য, দক্ষতা আর সক্ষমতার বাক্সবন্দী সনাতনী চিন্তাভাবনা থেকে। শিশুসাহিত্যের মাধ্যমে শিশুমনে ছড়িয়ে পড়ুক সমতার বার্তা। শিশুসাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিটি শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠুক তার যোগ্যতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    purba_du@yahoo.com