মতামত

তারা বদলাবে না

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে একসময় দেখা যেত খাওয়ার স্যালাইন কীভাবে বানাতে হয়। এখনকার রাজনীতির ধরন যেন সেই হাতে বানানো স্যালাইনের ফর্মুলার মতো। এক জগ বা আধা লিটার গোষ্ঠীস্বার্থ, মিষ্টি স্বাদের জন্য তাতে এক মুঠো দেশপ্রেম ও এক চিমটি আদর্শ—এগুলো একসঙ্গে করে ঘুঁটা...ঘুঁটা...ঘুঁটা। ব্যস, পাওয়া গেল ‘শত ভাগ দেশীয় ঘুঁটা রাজনীতি’।

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর দেহে শক্তি জোগায় স্যালাইন, রোগী বাঁচায়। রাজনীতিও স্যালাইনের মতো। যাঁরা রাজনীতিতে দুর্বলতায় আক্রান্ত, তাঁদেরই কেবল শক্তি জোগায়, বাঁচায়। এই আক্রান্ত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক শক্তি পেয়ে নতুন করে বাঁচেন এবং তারপর কী কী করে থাকেন, তা এই লেখায় মুখ ফুটে বলতে হবে না। সাধারণ মানুষ তা জানেন।

বিভিন্ন সরকারের আমলে করা নানান কাণ্ডকীর্তি, বহু দৃষ্টান্ত মাতৃভূমিতে সাপের খোলসের মতো পড়ে আছে। দেশবাসী অনেক কিছু ভুলে যান। আবার যেগুলো না ভোলার মতো, তার কোনোটাই ভোলেন না।

কারও যদি মনে হয়, মনগড়া বা আপত্তিকর কথা। না, তা নয়। কথার পক্ষে পাক্কা প্রমাণপত্র আছে। আছে দুই স্থানে। আছে সুস্থ চিন্তার মানুষের মনে ও পত্রপত্রিকায়। স্বাধীনতার পর থেকে অনেক অনেক দিন দেশের খবরের কাগজগুলো নিজেদের অস্তিত্বে কাউকে হাত লাগাতে দেয়নি। মাতবরদের অধীন হওয়ার পরও পুরোনো পত্রিকার ফাইলগুলো ঘেঁটে দেখলে নানা আমলের কাণ্ডকীর্তি চোখের সামনে নতুন দ্যুতিতে হাজির হবে।

মুশকিল হলো, সমর্থকেরা দলের দোষ মানতে নারাজ। এই দল ওই দলের দিকে আঙুল তুলে বলবে, যত ভেজাল ও ভেলকি, সবই ওদের, তাদের; আমরা তো ধোয়া তুলসীপাতা ছিলাম ও আছি। সবাই যদি শুদ্ধ ও দোষহীন দাবি করেন, তাহলে ৫৪ বছর ধরে দেশটিকে একটু একটু করে গভীর সংকটের মুখোমুখি কারা করলেন? কেন মানুষে মানুষে এত দ্বন্দ্ব, এত বিভেদ! আপনা-আপনিই কি ঘৃণা, হিংসা, দায়িত্বহীনতা হইহই-রইরই করে বেড়ে পাহাড় হয়েছে?

মানুষ এখন ভয়ংকর রকমের প্রতিহিংসাপরায়ণ, আক্রমণাত্মক। দেশজুড়ে অসভ্যতার ছড়াছড়ি এবং কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এ রকম হাল হতভাগা জনগণের কারণে নয় বা ওপরওয়ালার শাস্তিও নয়। তা যদি হতো, এ জাতির সামনে বারবার নতুন মোড় হাজির হয়ে যেত না। হোঁচট খাওয়া রাস্তায় হাঁটি, আমাদের সামনে নতুন মোড় আসে। আমরা নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হই। তারপর একসময় দেখি, যে তিমিরে ছিলাম, তা আরও খানিকটা ঘন হয়েছে।

একসময় রাজনীতির অ আ ক খ ছিল স্বার্থত্যাগ—তা উল্টে এখন প্রধান যোগ্যতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বার্থপরতা। যে বা যারা স্বার্থপর হয়েও দেশ ও দশের স্বার্থের কথা বলে এবং যারা সে মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করে, তাদের দেশপ্রেমী ভাবতে হবে। না ভাবলে অন্যায়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এই মন্ত্র যাঁরা তাবিজে ঢুকিয়ে গলায় পরে আছেন, যাঁরা জোর প্রয়োগের আরাম পেয়ে গেছেন, তাঁরা বদলাবেন না।

এ কথা ক্ষোভ ও দুঃখে বলা। সমালোচনা নয়, যা সত্য, ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে, সেটিই হতাশ হয়ে উল্লেখ করা।

মানুষ ছোট থেকে বড় হয়; বদলে যায় উচ্চতা ও চেহারা। বড় হয়ে গেলে গলার স্বর ছোটবেলার মতো থাকে না। বড় হয়ে কেউ হামাগুড়ি দেয় না, আচার–ব্যবহারে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। কোনো স্বাভাবিক মানুষের কি মনে হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি করা মানুষের রকম বদলেছে?

সাধারণ মানুষ দেখতে পান, বুঝতে পারেন—কে ক্ষমতায় ছিলেন না, কারা আছেন। পরিবর্তন আসে ক্ষমতা পাওয়া ব্যক্তিদের চেহারায়, পোশাকে ও ভাষায়। সাধারণ মানুষ আশা করেন সভ্য আচরণ, সংযত ভাষা; কিন্তু ও দুটি সাধারণদের থেকে নিজেদের আলাদা করা যায় না বলে রাজনীতি করা মানুষেরা ভাষা, আচরণ, সমগ্র জীবনযাপন থেকে দরকারি সংবেদনশীলতা বাদ দিয়ে দেন। তাতে লাভ কী হয়, তা দেখার বাকি নেই সাধারণের।

আমি অভিনয় করি। অনেক মানুষ অভিনয়কলা এবং তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে মন্দ মন্তব্য করেন। এটি অশোভন ও অযৌক্তিকও। তেমন ভাব ও ভাষা অভিনয়শিল্পীদের আহত করে। ঠিক তেমনিই যাঁরা রাজনীতি করেন, আমার মন্তব্য তাঁদেরও পীড়িত করবে। অভিনয় বা বিভিন্ন কলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রশংসার সঙ্গে নিন্দা শুনতেও অভ্যস্ত। রাজনীতিতে শুধুই স্তুতি ও প্রশংসা গ্রহণের চল রয়েছে। নেতা-কর্মী কারোরই সমালোচনা শোনার শক্তি নেই।

সবাই সমালোচককে শত্রু বিবেচনা করে থাকে, ভাবে চক্রান্তকারী। অথচ রাজনীতির প্রথম দায় মানুষকে শোনা ও বোঝার চেষ্টা করা। যাঁদের কোনো দলের সঙ্গে প্রেম গড়ে ওঠেনি, তাঁরাই শুধু বলতে পারবেন যে কোনো দল আর তার সমর্থকেরা তাদের কাল এলে ভেবেছে, দেশটার মালিকানা তাদের। জনগণ বা সাধারণ সর্বদা থেকেছে কথায়, ভাষায়-অলংকারের মতো। জনগণের নামে সরকার বিরোধিতা, জনগণের নামে শাসন এবং শোষণ-এই প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘকাল ধরে। চলে সগৌরবে।

বয়স যাঁদের ষাটের ঘর অতিক্রম করেছে, তাঁরা সৌভাগ্যবান। তাঁরা দেখেছেন, শুনেছেন, জানা এবং বোঝার সৌভাগ্য হয়েছে—দেশের রাজনীতি এবং নেতৃত্ব একসময় ছিল গৌরবোজ্জ্বল। মনে পড়ে, দল না করা অনেক ছাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসভাগুলোতে ভাষণ শোনার জন্য জমায়েত হতো। কারণ, তখন ছাত্রনেতারা মনে করতেন ভালো ভাষণ দিতে পারাটাও রাজনীতিতে বিশেষ যোগ্যতা। যে যোগ্যতা দূরের জনদের কাছে এনে দিতে পারে।

নেতৃত্বের গুণ, ভদ্রতা, সভ্যতা, জ্ঞান ও যুক্তির জোরে মুগ্ধ হয়ে তখন অনেকেই দলে ও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কথা ভেবেছে, যুক্তও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসভ্যতা প্রদর্শনের জন্য কিছুসংখ্যক কর্মী লালন-পালনের রীতি ছিল; কিন্তু তাদের দর্পের তোয়াক্কা করতে হয়নি সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

দিন গেলে মানুষ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। তা আমাদের ক্ষেত্রে হয়নি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে ত্যাগের মহিমা মুছে গিয়ে যুক্ত হয়ে যায় বস্তুগত লাভ-লোকসানের হিসাব। সেই হিসাব অনুসরণ করে জাগ্রত হয়ে ওঠে দখলদারির মনোভাব। যে যত হামলে পড়তে পারে, সে তত বিশেষের সম্মান পেতে থাকে। একপর্যায়ে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। টিকে থাকার উত্তম উপায় এখন অধম হওয়া।

এ তত্ত্বে দেশ ও মানুষের কি ভালো থাকার কথা? আদর্শ নয়, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, নেই নিবেদন—আছে শুধু হুকুম, হুংকার, ধমক আর চোখরাঙানি। কেউ ভেবেও দেখেন না কে কাকে চোখ রাঙাচ্ছেন। কেউ ভাবছেন না দেশটার মালিক প্রকৃতপক্ষে কারা। মালিক তারাই, যারা দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দেওয়ার জন্য তৈরি থাকে, প্রয়োজনে প্রাণ দেয়ও।

সাধারণ মানুষ চিরকালই দেখে এসেছেন, যাঁরা দেশের জন্য মরেন, তাঁদের আত্মত্যাগ বিশেষ গোষ্ঠীর মর্যাদা বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ত্যাগের মহিমা শুধু উল্লেখিতই হয়, মর্যাদা পেয়েছে—দেখা হয়নি কখনো। রাজনীতির সবচেয়ে অধম দিক হচ্ছে অন্ধত্ব। তারপর আসে স্বার্থপরতা।

একসময় রাজনীতির অ আ ক খ ছিল স্বার্থত্যাগ—তা উল্টে এখন প্রধান যোগ্যতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বার্থপরতা। যে বা যারা স্বার্থপর হয়েও দেশ ও দশের স্বার্থের কথা বলে এবং যারা সে মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করে, তাদের দেশপ্রেমী ভাবতে হবে। না ভাবলে অন্যায়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এই মন্ত্র যাঁরা তাবিজে ঢুকিয়ে গলায় পরে আছেন, যাঁরা জোর প্রয়োগের আরাম পেয়ে গেছেন, তাঁরা বদলাবেন না।

অন্যায় দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয় না। অসভ্যতা দিয়ে সভ্যতা প্রতিষ্ঠাও হয় না। অথচ সে নিরন্তর চেষ্টাই এ বঙ্গভূমি অবলোকন করে আসছে যুগের পর যুগ। তবু মানুষ বিশ্বাস করে বসে আছে—দেশ বেশরমের বাজার নয়।

  • আফজাল হোসেন অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক