
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যেন দুই মেরুর টানাটানিতে পরিণত হয়েছে। একদিকে রয়েছে নিউ লেফট বা নতুন বামপন্থী চিন্তাধারা। এই চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন যোগেন্দ্র যাদবের মতো বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা দাবি করছেন, নিম্নবর্ণ ও বঞ্চিত শ্রেণির সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষোভই রাজনীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।
অন্যদিকে রয়েছে ডানপন্থী সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ—রাম মাধবের মতো চিন্তকদের বয়ানে যার মূল সুর হচ্ছে হিন্দুত্ব, সভ্যতার গৌরব ও সংস্কৃতিনির্ভর জাতিসত্তা।
দুদিকেই রয়েছে জোরালো বয়ান, প্রবল যুক্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারত কি অনন্তকাল এ দুই চরমের দোলাচলে দুলতেই থাকবে? নাকি, তৃতীয় এমন কোনো পথ আছে, যা দুই দিকের চরমপন্থী শক্তিকে সংযত করে তাদের সীমা লঙ্ঘন থেকে মুক্ত একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যেতে পারে?
আমার মনে হয় আছে। সেই পথ হলো ‘র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম’ বা ‘কট্টর মধ্যপন্থা’।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম কোনো কুসুমকোমল আপসনীতি নয়; বরং এটি সাহসী এক পুনঃকল্পনা। এটি এমন এক রাজনীতি, যা বহুত্ববাদকে ধারণ করে। কোনো কিছুর পরিচয় মুছে দেয় না, বরং তার উন্নয়ন চায়, তবে সমতা বিসর্জন দেয় না। এই মতাদর্শ সভ্যতার ঐতিহ্যকে সম্মান করে, কিন্তু বিশ্বজনীনতার দরজা বন্ধ করে না। এটি ঐক্য চায়, কিন্তু এক রূপের মোহে পড়ে না।
এই রাজনীতি নেহরু ও সরদার প্যাটেলের মধ্যে বেছে নিতে বাধ্য নয়। এই রাজনীতি ‘রাজাজি’ সি রাজাগোপালাচারী ও বি আর আম্বেদকরের মধ্যে বিভাজন মানে না। এটি বামপন্থার নৈতিক স্বচ্ছতা ও ডানপন্থার সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস—দুয়েরই গুণ একত্র করে একটি বাস্তববাদী ও ভবিষ্যৎমুখী রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করতে চায়।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের মূলে রয়েছে ভারতের বহুত্ববাদ। কিন্তু এটি নিছক সহনশীলতা নয়, এটি ভিন্নতার সক্রিয় উদ্যাপন। নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের ধারণা যেমন ভারতের ভিত্তি স্থাপন করেছিল, র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম সেই ভাবনাকে আরও প্রসারিত করতে চায়।
বহুত্ববাদ কেবল ধর্ম বা ভাষার বিষয় নয়; এটি জাত, লিঙ্গ, অঞ্চল ও শ্রেণির জীবন্ত বাস্তবতার প্রতিফলন। তাই এই পথ একদিকে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একরূপীকরণের প্রবণতাকে, অন্যদিকে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির বিভাজনকেও প্রত্যাখ্যান করে।
এটি এমন জোট গঠনের আহ্বান জানায়, যা ক্ষুদ্র ভোটব্যাংকের বাইরে গিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় ভাগ্যকে স্পর্শ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিহারের এক দলিত নারী কিংবা ছত্তিশগড়ের এক আদিবাসী কৃষক কেবল বঞ্চনার প্রতীক নন; বরং তাঁরাই ভারতের মূল কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের একটি বড় কাজ হলো জাতীয়তাবাদকে বর্জনের কবল থেকে মুক্ত করা। সরদার প্যাটেলের জাতীয়তাবাদ ছিল বাস্তববাদী ও ঐক্যনিষ্ঠ। আজ ভারতের প্রয়োজন এমন এক জাতীয়তাবাদ, যা বাঁধে, কিন্তু অন্ধ করে না। আজ ভারতের দরকার এমন দেশপ্রেম, যা আত্মবিশ্বাসী কিন্তু দাম্ভিক নয়।
আমার ‘দ্য ব্যাটেল অব বিলঙ্গিং’ বইয়ে আমি যুক্তি দিয়েছি, ভারতের জাতীয়তাবাদকে হতে হবে নাগরিক–ভিত্তিক (সিভিক); ধর্মীয় বা জাতিগত নয়। সংবিধানই ভারতের মূল্যবোধের সর্বোচ্চ প্রকাশ—এই সত্যকে স্বীকার করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের কেন্দ্রে থাকতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। নিপীড়িতদের অধিকারের পক্ষে আম্বেদকরের যে সংগ্রাম ছিল, তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য ছিল না; এটি ছিল মানবমর্যাদার সর্বজনীন দাবি। তাঁর সংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাই রাজনীতির পথনির্দেশক হওয়া উচিত।
বিরোধিতা বা ভিন্নমত কোনো বিশ্বাসঘাতকতা নয়; এটি গণতন্ত্রের সুস্থতার লক্ষণ। কারণ, ভারতের ধারণা কোনো পাথরে খোদাই করা স্থির বাণী নয়; এটি এক জীবন্ত, বিকশিত সংলাপ।
রাজাজির মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শন এবং মনমোহন সিংয়ের সংস্কারের নীতি লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি অসমতা বাড়িয়েছে এবং বহু জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম এ বাস্তবতাকে স্বীকার করে। এটি বাজারকে গ্রহণ করে, কিন্তু বাজারপূজা করে না। এর লক্ষ্য হলো নৈতিক বোধসম্পন্ন উন্নয়ন।
এর মানে হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ জনসেবায় বিনিয়োগ বাড়ানো, পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা তৈরি ও জটিল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করা।
কল্যাণনীতিকে হতে হবে লক্ষ্যভিত্তিক ও দক্ষ, কিন্তু জনতুষ্টিমূলক নয়। অর্থনৈতিক সুযোগের মতোই অর্থনৈতিক মর্যাদাও সমান গুরুত্বপূর্ণ—এ কথা মনে রাখতে হবে।
আজকের মেরূকৃত রাজনীতিতে ঐকমত্য গঠনের প্রয়াসকে অনেকেই দুর্বলতা বলে মনে করেন। কিন্তু অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রমাণ করেছিলেন—ঐকমত্যই প্রকৃত শক্তি হতে পারে।
নিজ দলের মধ্যেও ভিন্নমতের মানুষকে একত্র করতে অটল বিহারি বাজপেয়ীর যে দক্ষতা ছিল, তা কেবল রাজনৈতিক কৌশল নয়; সেটি ছিল গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা।
আজকের বিভাজিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম সেই ঐকমত্যের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। এটি আলোচনা, সংলাপ ও প্রতিষ্ঠানের দৃঢ়তাকে গুরুত্ব দেয়। কারণ, শাসনব্যবস্থা কোনো শূন্য যোগফলের খেলা নয়; এটি একটি যৌথ প্রয়াস।
র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের কেন্দ্রে থাকতে হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। নিপীড়িতদের অধিকারের পক্ষে আম্বেদকরের যে সংগ্রাম ছিল, তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির জন্য ছিল না; এটি ছিল মানবমর্যাদার সর্বজনীন দাবি। তাঁর সংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাই রাজনীতির পথনির্দেশক হওয়া উচিত।
এর মানে, জাতভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই হতে হবে কেবল বক্তৃতায় নয়, বাস্তব নীতিতেও। প্রতিটি মানুষের প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব, সুযোগের প্রাপ্তি ও আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ন্যায়বিচার কোনো অনুগ্রহ নয়। এটি সংবিধানের মৌলিক অঙ্গীকার।
একটি র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিস্ট এজেন্ডার মূল দিকগুলো হতে পারে—
১. সংবিধানভিত্তিক বহুত্ববাদ রক্ষা: ধর্মনিরপেক্ষতা, ফেডারেল কাঠামো ও সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ করা, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংলাপ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়ানো।
২. অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি: বাজার সংস্কার ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক বিনিয়োগের সমন্বয়, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল অবকাঠামোয়।
৩. নাগরিক জাতীয়তাবাদ: সংবিধাননির্ভর যৌথ ভারতীয় পরিচয় গঠন; অর্থাৎ ধর্মীয় বা জাতিগত একচেটিয়াত্বকে ‘না’ বলা। একই সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি থাকবে, যা বৈশ্বিক পরিসরে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষিত করবে।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা জোরদার করা। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া, যেন তারা সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হতে পারে।
৫. অংশগ্রহণমূলক শাসন: নাগরিক সম্পৃক্ততা, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ নিশ্চিত করা।
ভারত এত বৈচিত্র্যময়, এত জটিল, এত গতিশীল যে একরৈখিক মতাদর্শ দিয়ে তাকে পরিচালনা করা যায় না। এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে প্রয়োজন চটপটে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি।
এসব লক্ষ্য কোনো কল্পনাপ্রসূত ইউটোপিয়া নয়। এটি সেই বিশ্বাস, যা আমি রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকে ধারণ করে আসছি, সংসদে উচ্চারণ করেছি, জনসভায় বলেছি এবং আমার লেখায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি।
এটি এমন এক রাজনৈতিক রূপরেখা, যা ক্ষমতা নয়, বরং উদ্দেশ্য খোঁজে, যা নীতিতে দৃঢ়, অন্তর্ভুক্তিতে সাহসী এবং ভবিষ্যৎ–চিন্তায় অগ্রগামী।
আজকের ভারতীয় রাজনৈতিক আলোচনায় এক ভয়ানক দ্বৈততা সবকিছু গ্রাস করেছে। বাম বনাম ডান, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব বনাম সংখ্যালঘু, পুনর্বণ্টন বনাম প্রবৃদ্ধি—এ রকম দ্বৈততা দেখা যাচ্ছে।
এই দ্বৈততা বাস্তবতাকে সরলীকৃত করে এবং সমাজে বিষাক্ত বিভাজন তৈরি করে। এটি নাগরিকদের পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করে, যেখানে তারা আসলে সমাধান খুঁজতে চায়।
আমাকে প্রায়ই অভিযুক্ত করা হয়—আমি নাকি ‘অন্য পক্ষের’ কিছু অবস্থানে গুণ খুঁজে পাই। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি কোনো পক্ষের নই; আমি কেবল ভারতের পক্ষেই আছি।
ভারত এত বৈচিত্র্যময়, এত জটিল, এত গতিশীল যে একরৈখিক মতাদর্শ দিয়ে তাকে পরিচালনা করা যায় না। এর সমস্যাগুলো সমাধান করতে প্রয়োজন চটপটে, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি।
আমার কাছে র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজম কোনো মাঝামাঝি অবস্থান নয়। এটি তার চেয়ে উচ্চতর পথ। এটি পার্থক্য ভাগ করার কথা বলে না; বরং পার্থক্যকে পুনর্নির্ধারণের আহ্বান জানায়। এটি চরমপন্থা এড়িয়ে চলা নয়; বরং তাদের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাকে একত্র করার প্রয়াস।
যখন ভারত ২০৪৭-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আমরা কি এমন রাজনীতি গড়তে পারি, যা ঐতিহ্যের সেরা দিক ও ভবিষ্যতের সাহসী স্বপ্ন—দুটিকেই ধারণ করে?
আমরা কি দ্বৈততার ফাঁদ পেরিয়ে র্যাডিক্যাল সেন্ট্রিজমের সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করতে পারব?
হয়তো সঠিক উত্তরটি কোনো এক পক্ষকে বেছে নেওয়ার মধ্যে নয়, বরং ভারতকেই বেছে নেওয়ার মধ্যে নিহিত।
শশী থারুর ভারতের টানা চতুর্থবার নির্বাচিত লোকসভা সদস্য ও দেশটির কংগ্রেসদলীয় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ