যুক্তরাজ্যে ২০ লাখের বেশি ভারতীয় আছেন
যুক্তরাজ্যে ২০ লাখের বেশি ভারতীয় আছেন

মতামত

মোদি সরকার যেভাবে প্রবাসীদের মুখ চেপে ধরছে 

লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টারে রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নিতাশা কৌল ১৯৯৭ সালে পোস্টগ্র্যাজুয়েট পড়াশোনার জন্য ইউনিভার্সিটি অব হালে আসেন। এর পর থেকেই তিনি যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি গণতন্ত্র, ডানপন্থী রাজনীতি, ভারতীয় রাজনীতি ও কাশ্মীর নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন এবং দেড় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।

ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নেওয়ার পরও কৌল ‘ওভারসিজ সিটিজেন অব ইন্ডিয়া’ বা ওসিআই মর্যাদার মাধ্যমে নিজের জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এই বিশেষ মর্যাদা ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের দেওয়া হয়। ওসিআই কার্ডধারীরা ভ্রমণ বা বসবাসের ক্ষেত্রে আজীবন ভিসার মতো বিস্তৃত সুবিধা পান। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষ এই মর্যাদা ভোগ করছেন।

কিন্তু হঠাৎ গত মে মাসে কৌলের ওসিআই বাতিল করা হয়। ভারতের সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫–এর ৭ডি ধারায় বলা আছে, কিছু বিশেষ কারণে ওসিআই বাতিল করা যেতে পারে, যেমন ১. জালিয়াতির প্রমাণ মিললে, ২. ভারতের সংবিধানের প্রতি অনুগত না হলে, ৩. ভারতের শত্রু কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধকালে যোগাযোগ বা ব্যবসা করলে, ৪. দুই বছরের বেশি কারাদণ্ড পেলে, ৫. ভারতের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক কিংবা জনস্বার্থের খাতিরে প্রয়োজন মনে করলে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব আইন প্রয়োগ অনেক সময় আইনসম্মত বাতিল নয়; বরং একধরনের শাস্তিমূলক সেন্সরশিপে পরিণত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা রক্ষা করা হয় না, যা আইনের মৌলিক নীতির বিরোধী। ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সামঞ্জস্যপূর্ণ শাস্তি ও আইনের শাসন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। যদিও দেশের ভেতরে আদালতগুলো এখনো অনেক ক্ষেত্রে সরকারের এসব পদক্ষেপের বিরোধিতা করছেন।

নিতাশা কৌলকে যে নোটিশ দেওয়া হয়, সেখানে বলা হয় তিনি ‘ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত’। তাঁর এই কর্মকাণ্ড নাকি বিদ্বেষপ্রসূত ও ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করেছে। কিন্তু নোটিশে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ ছিল না।

কৌল আসলে ভারতের গণতন্ত্রের প্রবল সমর্থক এবং সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত সমালোচনা করে আসছেন। তিনি বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর দমননীতি আর হিন্দু ডানপন্থী সংগঠন আরএসএসের বিভাজনমূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করে আসছেন।

আন্তর্জাতিক সূচকগুলোয়ও কৌলের কথার সত্যতা মেলে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রিডম হাউসের গ্লোবাল ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতকে ‘আংশিক মুক্ত’ বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বৈষম্যমূলক নীতি নিচ্ছে এবং মুসলমানদের লক্ষ্য করে নিপীড়ন বাড়িয়েছে। একইভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও অবনতির কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম কার্যত ‘অনানুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থায়’ আছে।

কৌল একা নন। গত ৯ বছরে ১২০ জনের বেশি মানুষের ওসিআই বাতিল করেছে ভারত সরকার। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার–এর তথ্য বলছে, এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। শুধু ২০২৪ সালেই ৫৭ জনের ওসিআই বাতিল করা হয়েছে, আর ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে আরও ১৫ জন এই শাস্তির মুখে পড়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই সাংবাদিক, কর্মী বা শিক্ষাবিদ। তাঁরা বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সমালোচনা করেছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২২ সালে সুইডেনভিত্তিক একাডেমিক অশোক স্বাইনের ওসিআই বাতিল করা হয়। অভিযোগ ছিল তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টগুলো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে’ এবং ‘ভারতের সামাজিক বন্ধন দুর্বল করেছে’। কিন্তু অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়া হয়নি। পরে স্বাইন দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেন এবং ২০২৩ সালে আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন।

প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন বিদেশে থাকা ভারতীয়দের দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু উন্নয়নে অংশ নেওয়ার মানে হওয়া উচিত—ভয় ছাড়া মতপ্রকাশ ও সমালোচনার সুযোগ। যদি সরকারকে প্রশ্ন করলেই প্রবাসীদের শত্রু মনে করা হয়, তাহলে একসময় এমন অবস্থা আসবে, যখন আমরা কেবল শাসক দলের শর্তে ভারতে যেতে পারব। এতে ভারতের অগ্রগতিতে আমাদের অবদান রাখার সুযোগও সীমিত হয়ে যাবে।

আবার ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদিক রাফায়েল স্যাটারের ওসিআই বাতিল করা হয়। তিনি রয়টার্সে কাজ করেন এবং সাইবার নিরাপত্তা, গুপ্তচরবৃত্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে রিপোর্ট করেছেন। ভারত সরকার তাঁর সমালোচনামূলক প্রতিবেদনকে কারণ দেখালেও তিনি এখন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়ছেন।

ভারতে এখন সমালোচকদের দমনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিবিদ, এনজিও কর্মী, আন্দোলনকারী, সাংবাদিক বা সামাজিক নেতা—যিনিই সরকারকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁকেই নানা উপায়ে চুপ করানো হচ্ছে। কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, কারও মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, আবার অনেককে ভীতি প্রদর্শন বা শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।

এই দমন–পীড়ন আরও বেড়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালানোর পর। পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর সরকার এই অভিযান শুরু করে। এরপর এক্স প্ল্যাটফর্মকে প্রায় আট হাজার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে বলা হয়। এসবের মধ্যে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের অনেক অ্যাকাউন্টও ছিল। যেমন ফ্রি প্রেস কাশ্মীর, বিবিসি উর্দু ও দ্য ওয়্যার।

দেশের ভেতরে ভিন্নমত দমনের পাশাপাশি ভারত সরকার এখন প্রবাসীদের দিকেও নজর দিয়েছে। ওসিআই মর্যাদাকে তারা কার্যত ‘ব্ল্যাকমেলের হাতিয়ার’ বানাচ্ছে। ফলে প্রবাসী ভারতীয়রা ভয় পাচ্ছেন—সরকারের সমালোচনা করলে হয়তো ভারতে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের চুপ করাতেই ওসিআই ব্যবহার করা হচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ফর ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসির এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ ব্রিটিশ ভারতীয় ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

আমি যেসব প্রবাসী ভারতীয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অনেকেই স্পষ্ট বলেছেন, তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা প্রকাশ্যে বলতে ভয় পান। কারণ, তাঁরা আশঙ্কা করেন, এতে ভারতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

কিন্তু আমাদের, মানে ব্রিটিশ ভারতীয়দের এভাবে ভয় পাওয়া উচিত নয়। আমাদের ওসিআইয়ের মতো আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানোর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কারণ, আমরা পরিবার, বন্ধু, সংস্কৃতি ও কমিউনিটির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। বিজেপি সরকার প্রবাসীদের যেভাবে চাপে রাখছে, তা ভারতের সংবিধানে প্রতিশ্রুত ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত।

যুক্তরাজ্যে ২০ লাখের বেশি ভারতীয় থাকলেও ব্রিটিশ সরকার ভারতের সঙ্গে বড় বাণিজ্যচুক্তি করেছে, কিন্তু ভারতের গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। অথচ যুক্তরাজ্য চাইলে এই বিশেষ সম্পর্ক ব্যবহার করে ভারত সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারত। চুপ করে থাকলে কেবল বিজেপির অবস্থানই আরও শক্ত হবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি এখন বিদেশে থাকা ভারতীয়দের দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে ডাক দিচ্ছেন। কিন্তু উন্নয়নে অংশ নেওয়ার মানে হওয়া উচিত—ভয় ছাড়া মতপ্রকাশ ও সমালোচনার সুযোগ। যদি সরকারকে প্রশ্ন করলেই প্রবাসীদের শত্রু মনে করা হয়, তাহলে একসময় এমন অবস্থা আসবে, যখন আমরা কেবল শাসক দলের শর্তে ভারতে যেতে পারব। এতে ভারতের অগ্রগতিতে আমাদের অবদান রাখার সুযোগও সীমিত হয়ে যাবে।

আসলে প্রবাসীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কই ভারতের গণতন্ত্রের মূল শক্তি। এই সম্পর্ক ছিন্ন হলে ভারতের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়বে।

রাউল লাই ব্রিটিশ ভারতীয়দের একত্র করে ভারতের গণতন্ত্র রক্ষায় কাজ করা ‘প্ল্যাটফর্ম ফর ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসি’ নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ