মতামত

নির্বাচন সফল করতে কার্যকর পুলিশ এখনই লাগবে

প্রথম আলোয় আইজিপি বাহারুল আলমের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে (২০ অক্টোবর ২০২৫)। তার আগের দিন টেলিভিশনে দেখেছিলাম, উনি বলছেন, ‘সরকারের বা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত পুলিশ প্রশাসন চলতে দিন।’

সাক্ষাৎকারটি খুব যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, তা মনে হলো না। দেশের এই বিশেষ সংকটের সময় একজন চৌকস ও বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে যে আস্থা-বিশ্বাস রেখে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা বোধ হয় উনি যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি।

না, তাঁর দোষের কথা বলছি না। তাঁর যোগ্যতার অভাব বলছি না। সবকিছু মিলিয়ে একটা প্রত্যাশা তাঁর ওপর বোধ হয় করা হয়েছিল যে অভ্যুত্থান–পরবর্তী পুলিশ বাহিনীকে তিনি পুনর্গঠন করতে পারবেন। সেটা উপ্ত কিংবা অনুপ্ত, যা–ই হোক। এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরে যখন পুলিশ-প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে, সেই পুলিশ-প্রশাসনকে আবার নতুন করে, বর্তমান সময়ের উপযোগী করে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে গড়ে তোলার কাজটি তিনি করতে পারেননি।

আমি মানি, এটি খুব সহজ কাজ নয়। মানি, এটি প্রধানত সরকারের কাজ। এ–ও মানি, সরকার যদি বিশেষভাবে উদ্যোগী না হয়, তাহলে পুলিশের কোনো আইজিপি বা কর্মকর্তা নিজে নিজে এগুলো করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও যে প্রশাসন বা সরকার আছে, আমি যে ধারণার কথা বললাম, তার বিপরীতে তো নয় তারা। এটা করার মতো অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাদের নেই। কিন্তু আইজিপি বাহারুল আলম বা অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তার তো তা থাকতে পারে।

এই যে নির্বাচন আসছে, সেটি একটি গুণমানসম্পন্ন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, যেকোনো ধরনের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত করে সম্পাদনের জন্য যে পুলিশ বাহিনী দরকার, সেটা গড়ে তুলতে তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। কিন্তু সে রকম কিছু আমরা দেখলাম না। পুলিশ আগের মতোই আছে; কিংবা আরও নিষ্ক্রিয় হয়েছে।

আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে পা দিতে চাইছি। সেই গণতান্ত্রিক দেশের উপযোগী একটি পুলিশ বাহিনী করা দরকার। এখন কি সে রকম হবে? সে সময় কি আমাদের হাতে আছে? পুলিশের কি কোনো সংস্কার হয়েছে? আমরা জানি না। সাধারণভাবে মানুষ যা দেখছে, তাতে পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ কথা আইজিপি বাহারুল আলম নিজেও স্বীকার করেছেন।

গত বছরের আন্দোলনের সময় অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। প্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। নির্বিচার গুলি চালিয়ে হাজারখানেক লোক হত্যা করেছে। তার ফলে জনগণের ক্রোধ পুলিশের ওপর আছড়ে পড়েছে।

পুলিশের মধ্যে একটা ট্রমা তৈরি হয়েছে। তারা ডিউটি করতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা তো অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। তার ওপর তিন থেকে সাড়ে তিন মাস পর নির্বাচন। পুলিশ তো আমাদের লাগবে।

আমরা একটি পুলিশ বাহিনী তো আমদানি করতে পারব না, রাতারাতি গজিয়েও ফেলতে পারব না। যা আছে, তা দিয়েই আমাদের সামনে যেতে হবে। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, যারা গুপ্তহত্যার মতো, ক্রসফায়ারের মতো ঘটনায় যুক্ত ছিল, মানবিক অপরাধ করেছে, তাদের বিচার হবে; বাকি সবাইকে সরকার আশ্বস্ত করবে যে তোমরা তোমাদের ডিউটি করতে পারবে, নির্ভয়ে। তোমাদের সিকিউরিটির দায়িত্ব আমাদের।

সে রকম করে কেউ কোনো বক্তব্য দেয়নি। সে রকম কিছু হয়েছে, তা–ও দেখিনি। অথচ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠন। বর্তমান সময় বলতে আমি ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে যে সময়, তার কথা বলছি না। বরং গত বছর আমরা যখন অভ্যুত্থানে বিজয়ী হয়েছিলাম, তার পর থেকেই এই দায়িত্বটা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা দু-একবার বলেছেন। তাঁর অগ্রাধিকার হচ্ছে পুলিশ।

পুলিশ সংস্কারের ব্যাপারে আমরা বেশ কিছু কথাবার্তা শুনেছিলাম। আইজিপি বাহারুল আলম এখানে উল্লেখ করেছেন, তা প্রায় এক দশক হয়ে গেছে এবং কমিশনের একটা প্রতিবেদনও সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এবার যে সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম চলল, পরে এটাকে ঐকমত্য কমিশন বলা হলো, সেখানে পুলিশ সংস্কারের বিষয় আলোচনায় আসেনি।

চব্বিশের জুলাই–আগস্টে ছাত্র জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় পুলিশ। এর ফলে পুলিশের ওপর জনতার ক্রোধ আছড়ে পড়ে।

সরকার এটাকে আলাদাভাবে করতে চেয়েছে। কেন? আমি জানি না। এর ফলাফল কী, তা–ও দেখছি না। কোনো ফলাফল যে আছে, তা মনে হয় না। পুলিশ বাহিনীর জন্য জনগণের মধ্যে কোনোরকমের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়নি। আর পুলিশ বাহিনীতে যারা আছে, তাদের ট্রমা কাটেনি। তারা এখনো বুঝতে পারে না, কোন সময় কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে! বেশির ভাগ সময় তারা নীরব দর্শকের মতো থাকে। অথচ ৫ আগস্টের পর থেকে এই সময় প্রধান দাবি ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ নিয়মশৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচন যেদিন হোক, তা সামনে রেখে আমাদের পুলিশ বাহিনীকে যেন ঢেলে সাজানো হয়।

আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে পা দিতে চাইছি। সেই গণতান্ত্রিক দেশের উপযোগী একটি পুলিশ বাহিনী করা দরকার। এখন কি সে রকম হবে? সে সময় কি আমাদের হাতে আছে? পুলিশের কি কোনো সংস্কার হয়েছে? আমরা জানি না। সাধারণভাবে মানুষ যা দেখছে, তাতে পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ কথা আইজিপি বাহারুল আলম নিজেও স্বীকার করেছেন।

আমি আগেই বলেছি, সরকার যদি উদ্যোগী না হয়, সরকার যদি প্রো–অ্যাকটিভ না হয়, তাহলে পুলিশ প্রো–অ্যাকটিভ তো দূরের কথা, কিছুই করতে পারবে না। আমি এটা স্বীকার করি, কিন্তু তারপরও আমি বলি, পুলিশ বাহিনীর নিজের কি কিছু করার ক্ষমতা নেই? একজন আইজিপি কিংবা একটা গ্রুপ অব অফিসার কি কোনো ব্যতিক্রম দেখাতে পারতেন না?

আইজিপি বাহারুল আলম রাজনীতির প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনীর কথা বলেছেন, যেটা অবশ্যই জরুরি। এ প্রসঙ্গে তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কথা বলেছেন। তাঁর দাবি হচ্ছে, পুলিশকে যেন দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়।

এ জন্য আইজিপি বাহারুল আলম প্রস্তাবও দিয়েছেন, বিশেষ করে নিয়োগের ক্ষেত্রে। প্রস্তাবটা আমার ভালো লেগেছে। এখন পর্যন্ত যে রকম হয়, একদম দলীয় বিবেচনায় পুলিশের নিয়োগ হয়; সেখানে তিনি একটা কমিটি করতে বলেছেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল পুলিশ কমিশন গঠনের বিষয়ে।

তাঁরা বলেছিলেন, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, সরকার ও বিরোধী দলের দুজন করে সংসদ সদস্য, একজন মানবাধিকারকর্মী ও একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়ে একটি কমিশন করা যেতে পারে। তারা আগে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম প্রস্তাব করবে, তাদের মধ্য থেকে একজনকে সরকারকে বেছে নিতে হবে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এ নিয়ম মেনে চলা হবে।

বর্তমান সরকারের দায়িত্ব ছিল পুলিশের এই সংস্কারের কাজটা করার, কিন্তু কিছুই করা হয়নি। দুবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশের সঙ্গে বসেছেন। কিন্তু তাতে পুলিশের মধ্যে কোনো আস্থা ফেরেনি। জনগণও পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়নি। কিন্তু এ অবস্থা তো অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না।

নির্বাচনের তিন থেকে সাড়ে তিন মাস মাত্র বাকি আছে। এই পুলিশ দিয়ে একটা ভালো নির্বাচন হতে পারবে—কেউ এ আশা ব্যক্ত করতে পারছেন না। আমি বলব, ‘ইট ইজ বেটার দ্যান নেভার।’

এখনো সময় আছে, যে সাড়ে তিন মাস আছে, তার মধ্যে অন্তত সরকার উদ্যোগটি নেবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকবে। আইজিপি বাহারুল আলম আগামী নির্বাচন যে ভালোভাবে করতে পারবেন, তার জন্য নিজের কাঁধে সব দায়িত্ব নেননি। তিনি বলেছেন, এ জন্য অংশীদের সহযোগিতা লাগবে। সবার ওপরে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনী একা এটি করতে পারবে না।

  • মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

    মতামত লেখকের নিজস্ব