ডেভিড বার্গম্যানের কলাম

আইসিসিতে আওয়ামী লীগের অভিযোগ কতটা যৌক্তিক

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আওয়ামী লীগের জমা দেওয়া আনুষ্ঠানিক আবেদনে দলীয় নেতা বা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ড ও কারাবন্দী করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চাওয়া হয়েছে। আইসিসিতে করা অভিযোগকে আওয়ামী লীগের একটি বড় ধরনের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। আইসিসিতে আওয়ামী লীগের অভিযোগ কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে লিখেছেন ডেভিড বার্গম্যান

আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্যের সুপরিচিত আইনি সেবাদানকারী সংস্থা ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারসের এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) একটি ‘কমিউনিকেশন’ বা আনুষ্ঠানিক আবেদন জমা দিয়েছে।

এ আবেদনে দলীয় নেতা বা দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ড ও কারাবন্দী করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত চাওয়া হয়েছে। বিষয়টিকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই যেখানে অভিযুক্ত

এটি মোটেও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একবারও উল্লেখ করা হয়নি যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এখন আইসিসিতে তদন্তের আবেদন করছে। সেই একই দলের নেতারাই মানবতাবিরোধী অপরাধের, বিশেষ করে গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে সংঘটিত শত শত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কোনো ‘অস্পষ্ট বা কল্পিত অভিযোগ’ নয়। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) একটি বিশদ তদন্ত চালিয়ে একটি তথ্য-উপাত্তভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, ওএইচসিআরের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে হত্যা, নির্যাতন, কারাবন্দী করা ও অন্য অমানবিক কর্মকাণ্ড—এসব অপরাধ ঘটেছে।

এগুলো ছিল একটি ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণের অংশ। এ আক্রমণ চালানো হয়েছিল সেসব প্রতিবাদকারী ও সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে, যাদের সরকার মনে করেছিল যে তারা আন্দোলনে অংশ নিতে পারে বা আন্দোলন সমর্থন করতে পারে।

আসলে আগের সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার নীতি বাস্তবায়নের জন্য এবং সহিংসভাবে আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে এসব করা হয়েছিল।

এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে। সেখানে প্রসিকিউশনের প্রমাণ হিসেবে শেখ হাসিনার টেলিফোন কথোপকথনের রেকর্ডিং এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শকের সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

তবে ইতিহাস আমাদের দেখায়, কখনো কখনো অপরাধী খুব দ্রুতই ভুক্তভোগীতে পরিণত হতে পারে। আবার ভুক্তভোগীও কখনো কখনো অপরাধীতে রূপ নিতে পারে।

তাই আওয়ামী লীগের করা অভিযোগগুলোকে শুধু অতীতে তার দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একেবারে খারিজ করে দেওয়া যায় না।

‘৪০০ জন নিহত’

এ কথা ঠিক, ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকে আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট বা দলটির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন বা হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

বিশেষ করে নির্বিচার ধরপাকড় বা ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন; কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না, আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শিকার’ (যেমনটা আইসিসিতে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে)।

ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারসের সবচেয়ে গুরুতর দাবি হলো আওয়ামী লীগের ৪০০ নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁদের অনেককেই নৃশংসভাবে পিটিয়ে বা গণপিটুনি দিয়ে মারা হয়েছে।

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটেছিল। তবে দলটি জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে যে ১২৬ জন নিহত মানুষের সংখ্যা দিয়েছে, তাঁদের সবাই এ ধরনের হামলার শিকার ছিলেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট এ প্রতিশোধমূলক সহিংস ঘটনার কথা স্বীকার করেছে এবং বলেছে, ‘সহিংস জনতা শুধু ভবন ও সম্পত্তি ভাঙচুরই করেনি, তারা এমন গণমাধ্যম অফিসেও হামলা চালায়, যেগুলোকে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে দেখা হতো। তারা এমন ভবনেও আগুন দিয়েছিল, যেখানে মানুষ আটকা ছিল। তারা আওয়ামী লীগ–সমর্থক ও পুলিশের ওপরও সহিংস হামলা চালিয়েছিল, এমনকি কিছু লোককে তারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল।

‘৪ আগস্টের পর যখন তৎকালীন সরকার ক্ষমতা হারাতে থাকে, তখন এসব প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা আরও বেড়ে যায়। অনেক জায়গায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় মানুষজন তাদের ওপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের করা নির্যাতন ও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়। প্রতিবাদের সময় এবং পরেও কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও এসব সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’

তবে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে এ সহিংস ঘটনাগুলো রাষ্ট্র বা কোনো সংগঠনের নীতি অনুসারে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছিল।

অথচ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে কোনো সহিংসতাকে গণ্য করতে হলে তা অবশ্যই কোনো রাষ্ট্র বা সংগঠনের ইচ্ছাকৃতভাবে ও নির্দিষ্ট নীতি অনুসারে ঘটতে হবে।

স্বতঃস্ফূর্ত, বিচ্ছিন্ন বা এলোমেলো ঘটনার মতো হলে তা এই শ্রেণিতে পড়বে না। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ওএইচসিএইচআর এমন কোনো তথ্য পায়নি, যা প্রমাণ করে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল।

আর যে ছাত্রসংগঠনগুলো আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনায় দেখা গেছে, কয়েকজন ছাত্রনেতা বা কর্মী ছাত্রলীগের সমর্থকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এর পেছনে কোনো পরিকল্পিত বা সংগঠিত তৎপরতার প্রমাণ মেলেনি।

৫ আগস্ট-পরবর্তী হত্যাকাণ্ড

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পরও নিঃসন্দেহে কিছু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। তবে দলটি ২৭৪ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন বলে যে দাবি করেছে, তা অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে।

এমনকি আওয়ামী লীগপন্থী প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্ন্যান্স’ ৬ আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মোট ১৩৪ নেতা-কর্মীর মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করেছে। তাঁদের মধ্যে আটককালে মারা যাওয়া ব্যক্তিরাও আছেন।

সংখ্যার বিষয়টি বাদ দিলে নিহত ব্যক্তিদের সংবাদ প্রতিবেদনগুলো দেখায়, এ হত্যাকাণ্ডগুলো একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়। এগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক শত্রুতা বা বিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কোনো রাষ্ট্র বা দলের নীতি অনুসারে সমন্বিতভাবে করা হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে এসব হত্যা কোনো নীতি বা পরিকল্পনার অংশ নয়। এগুলো সেই প্রতিহিংসামূলক পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে, যেখানে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে, জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে এবং জাতীয় সরকারও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না।

ইচ্ছেমতো হরেদরে আটক

ডাউটি স্ট্রিটের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তাদের আইসিসিতে পাঠানো কমিউনিকেশন বা আনুষ্ঠানিক আবেদনে একটি ‘প্যাটার্ন’ উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বা যুক্ত হিসেবে ধারণা করা ব্যক্তিদের অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জামিন না দিয়ে বা অভিযোগ ছাড়াই কারাগারে রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে রাজনীতিবিদ, বিচারক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতাদের মতো এমন মানুষও রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক খুবই দূরবর্তী।

সন্দেহাতীতভাবে আওয়ামী লীগের এ দাবিতে অনেক সত্যতা আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন বা গ্রেপ্তারের মুখে আছেন। প্রমাণিত কোনো সত্য তথ্যের ভিত্তি ছাড়াই অনেককে হত্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ এমন কোনো ব্যবস্থা করতে পারেনি, যা প্রকৃত অপরাধের মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ বা সম্পর্কের কারণে করা মামলার থেকে আলাদা করতে পারে।

কিন্তু এ ধরনের নির্বিচার গণগ্রেপ্তার যদি আইসিসির মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হয়, তবে অতীতে আওয়ামী লীগ নিজেই যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন একই অভিযোগে আইসিসিতে তদন্তের জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল, সেটিও গ্রহণযোগ্য হতো।

কিন্তু আইসিসি সে সময় এই আবেদন গ্রহণ করে তদন্ত করেনি। কাজেই এখন তারা তা করবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ।

এর আগে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়
ছিল, তখন পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে প্রায়ই বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হতো।

কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ঘটে যাওয়া হত্যা মামলাগুলো সাধারণত সেসব পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, যেসব পরিবারের সদস্যরা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহত হয়েছেন। যদিও এসব মামলায় অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততাও ছিল।

 এ পার্থক্য আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে প্রমাণ করা কঠিন করে তোলে যে গ্রেপ্তার বা আটকগুলো কোনো ‘রাষ্ট্র বা সংস্থার নীতি’ অনুযায়ী করা হয়েছে, যা কিনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ধরার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

ভরসা নেই

আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের হত্যা করা এবং ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার করার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তবে এগুলো আইনিভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে আইসিসিতে করা অভিযোগকে আওয়ামী লীগের একটি বড় ধরনের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

নিজের ওপর আসা জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভে সংঘটিত হত্যার দায় থেকে লোকের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া এ প্রচারাভিযানের উদ্দেশ্য হয়ে থাকতে পারে।

তবে যা-ই হোক, এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে, তা কোনো ধরনের শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারসের আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বর্ণিত কিছু অনিয়ম এখনো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে এবং অন্তর্বর্তী সরকার এগুলো ঠেকাতে বা সংশোধনে যথেষ্ট কিছু করেনি।

যাঁরা আশা করেছিলেন আওয়ামী লীগের পতন বাংলাদেশে মানবাধিকার ও জবাবদিহির জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করবে, তাঁদের কাছে বাস্তবতা একেবারেই হতাশাজনক। প্রতিশোধ ও দমন চক্রের আগের ছবিই দেখা যাচ্ছে।

এতে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষমতা বদলালেও বাংলাদেশ এখনো এমন রাজনীতির ফাঁদে আটকে আছে, যেখানে অনিয়ম ও দোষীদের শাস্তি না হওয়া বা দায়মুক্তির সংস্কৃতি আগের মতোই রয়ে গেছে।

  • ডেভিড বার্গম্যান সাংবাদিক। বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন।

    *মতামত লেখকের নিজস্ব