বাংলাদেশে ধর্মের নামে জীবিত কিংবা মৃত মানুষ পোড়ানোর ঘটনা এবারই নতুন নয়।
২০২০ সালের লালমনিরহাট হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করি। ৩০ অক্টোবর ২০২০, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরের একটি মসজিদে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে শহীদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, জুয়েল ও তাঁর এক বন্ধু মসজিদে গেলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি হয়।
একপর্যায়ে মুসল্লিরা তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মারধর শুরু করেন। পরে প্রশাসন দুজনকে উদ্ধার করে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বাইরে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে জুয়েলকে আবারও বেধড়ক পেটান। পরে তাঁর মরদেহ মহাসড়ক পর্যন্ত টেনে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।
এবার বর্তমানে ফেরত আসি। ঘটনাস্থল গোয়ালন্দ, ৫ আগস্ট ২০২৫—জুমার নামাজের পর বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার দরবারে একদল লোক হামলা চালায়। নেতৃত্বে ছিল উপজেলা ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। তারা শরিয়ত পরিপন্থীভাবে দাফনের অভিযোগ তুলে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে এনে আগুনে পোড়ায়। এ সময় সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। দরবারের খাদেম রাসেল মোল্লাকে মারধর করে, পরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এটিকে নিঃসন্দেহে মব হত্যাকাণ্ড বলা যায়।
এ অপরাধগুলোকে আমরা আদর্শগত অপরাধ বলতে পারি। এর অর্থ হলো, কোনো অপরাধ যখন রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক বা দার্শনিক বিশ্বাস ও মতাদর্শের ভিত্তিতে সংঘটিত হয়, অপরাধীরা এটিকে অপরাধ মনে করে না; বরং মনে করে তারা একটি উচ্চতর আদর্শ রক্ষার জন্য কাজ করছে এবং প্রতিদান হিসেবে পরকালীন পুরস্কার বা সামাজিক মর্যাদা পাবে। এ ধরনের অপরাধের মূল লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষের মতাদর্শকে দমন করা।
রাষ্ট্র যখন অপরাধীদের বিচার করে না, তখন দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়। এতে অপরাধীরা নিশ্চিত হয় যে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে এ সংস্কৃতি দৃঢ় হয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শগত অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নয়; বরং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে।
ফরাসি মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বনের ক্রাউড সাইকোলজি বা দঙ্গলের মনস্তত্ত্ব তত্ত্ব মতে বলা যায়, ভিড় একজন মানুষকে তার ব্যক্তিগত নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তখন সে নিজের পরিচয় হারিয়ে ‘সমষ্টিগত সত্তা’র অংশ হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় মানুষ এমন সব কাজ করে, যা একা থাকলে কখনোই করত না।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মব সহিংসতাকে এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বৈধ সহিংসতার একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়, অর্থাৎ রাষ্ট্রকে তখন মবকে কঠোরভাবে বোঝাতে হয় যে রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের সহিংসতা করার অধিকার নেই, এ অধিকার শুধু রাষ্ট্রের হাতে সীমাবদ্ধ ও এই ক্ষমতা শুধু নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা বৈধ।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের ভাষায়, রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈধ সহিংসতার ওপর তার একচেটিয়া অধিকার (মনোপলি অব ভায়োলেন্স)। যখন রাষ্ট্র মবকে দমন না করে সহিংসতা চালাতে দেয়, তখন রাষ্ট্র তার মূল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এবং নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ দুর্বলতা আদর্শগত অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কাজে লাগায়, সমাজে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে, নাগরিককে জিম্মি করে বিরোধী মতকে দমন করতে থাকে।
আদর্শগত অপরাধ সমাজে নতুন নয়; বরং এ ধরনের অপরাধ সমাজে ঘটে। প্রশ্ন হলো, এ অপরাধকে মোকাবিলা করতে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে? আসুন, আমরা দেখি ২০২০ সালের ঘটনায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী ছিল। লালমনিরহাট হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিল। ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রধান আসামিসহ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভিডিও ফুটেজ ধরে আসামিদের শনাক্ত করা হয়, পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁদের নাম তখন প্রকাশ করা হয়নি, অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রসিডিউরাল ও আইনি ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছিল।
এখন দেখি ২০২৪-২৫ সালে আদর্শগত অপরাধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কী ছিল। আমরা কি আদর্শগত অপরাধ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন চিত্র দেখতে পাচ্ছি? প্রথম আলোর (১৮ জানুয়ারি ২০২৫) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে সাড়ে পাঁচ মাসে ৪০টি মাজার, সুফি সমাধি ও দরগাহে ৪৪টি হামলা হয়েছে। এসব হামলায় ভাঙচুর, ভক্তদের ওপর হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রতিটি ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, এতগুলো ঘটনায় অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের বিষয়ে রাষ্ট্র নীরব কেন?
প্রশ্ন ওঠে, তাহলে রাষ্ট্র কি আদর্শগত অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তন করেছে? যে রাষ্ট্র ২০২০ সালে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল, সেই রাষ্ট্র কেন ২০২৪ সালে ৪৪টি হামলার ঘটনায় মাত্র ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে? বিষয়টি কি এমন যে ধর্মের নামে সংঘটিত মব অপরাধ দমনে রাষ্ট্র এখন আরও নরম অবস্থান নিচ্ছে?
এ ধরনের পরিবর্তন কি শুধু ধর্মকেন্দ্রিক আদর্শগত অপরাধের ক্ষেত্রে হচ্ছে, নাকি রাজনৈতিক আদর্শগত অপরাধের ক্ষেত্রেও ঘটছে? উদাহরণ হিসেবে ধানমন্ডি ৩২-এর মব–সন্ত্রাসের কথা বলা যায়। এ ঘটনাকে আমরা রাজনৈতিক আদর্শগত অপরাধ হিসেবে দেখতে পারি। দুই দিন ধরে চলা ভাঙচুরে কারা জড়িত ছিল, তার প্রমাণ রাষ্ট্রের কাছে রয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছিল। এ ঘটনায় মামলা বা তদন্ত কমিশন গঠনের কোনো খবরও পাওয়া যায়নি।
রাষ্ট্র যখন অপরাধীদের বিচার করে না, তখন দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়। এতে অপরাধীরা নিশ্চিত হয় যে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে এ সংস্কৃতি দৃঢ় হয়েছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শগত অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নয়; বরং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে।
রাষ্ট্রের এ নমনীয়তা ও নীরবতা আমাদের বৃহত্তর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি রাষ্ট্র হিসেবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মব ও ‘তৌহিদি জনতার’ নিয়ন্ত্রণে যাব, নাকি নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পাব?
আসিফ বিন আলী বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে।
ইমেইল: asif.du111@gmail.com
মতামত লেখকের নিজস্ব