প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, এ ঘটনায় তিনি দুঃখিত ও লজ্জিত। তিনি আরও জানিয়েছেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনার সময় দুটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা ফোন করে তাঁকে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছিলেন। সাহায্যের জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে ফোন করেছেন। কিন্তু সাহায্য সময়মতো পৌঁছায়নি। তাঁর এই অসহায়ত্বের প্রকাশ আমাদের অনেককেই হতভম্ব করেছে।
অবাক লাগে, সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সরকারের প্রভাবশালী ও দায়িত্বশীল একজন প্রতিনিধি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর অসহায়ত্ব আদৌ এভাবে প্রকাশ করতে পারেন কি না।
বাস্তব পরিস্থিতি কী ছিল যেহেতু আমার জানা নেই, তাই এ প্রসঙ্গে কোনো আলাপ–আলোচনায় যাব না। কিন্তু আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসহায়ত্বের এই প্রকাশ ছিল খুবই হতাশাজনক।
এতে সাধারণ জনগণের ধারণা হয়, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিই যদি আপত্কালীন জরুরি সেবা নিশ্চিতে ব্যর্থ হন, তাহলে সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?
শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার অপরাধ দমনে ও জরুরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে আমরা দেখেছি নিজের হাতে আইনকে তুলে নেওয়া অশুভশক্তিই বারবারই জয়ী হয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আবির্ভাব বারবারই আমাদের সিনেমার শেষ দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে পার্থক্য হলো, সিনেমার শেষ দৃশ্যে আবির্ভূত হওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমরা বলতে শুনি ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’
কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তারা এ রকম বলছেন—এমনটিও দেখছি না আমরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন অনেকটাই পর্দার অন্তরালে। তাদের অনুপস্থিতিতে মানুষ চরমভাবে আইনকে তুলে নিচ্ছে এবং যা খুশি তা–ই করছে।
মানুষ বর্বরভাবে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে, পিটিয়ে মারছে, পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে মারছে, কিংবা প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করছে।
সাম্প্রতিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কিংবা ছায়ানট ভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের সময় হামলাকারীদের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও অসহায়ত্বের যেসব চিত্র সামনে এসেছে, তা কোনো ব্যাখ্যাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আগেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভাঙার সময়, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে ফেলার সময়, জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার সময়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের ঘটনায় কিংবা প্রকাশ্যে নারী নির্যাতনের একাধিক ঘটনায় সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।
সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন আর দায়সাড়া বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন।
বর্তমানে সরকারের আরেকটি প্রবণতা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সেটি হলো যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কিংবা পরিস্থিতিতে সরকারের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়ার নতুন ধারা। আমরা অনেকেই ‘বিবৃতি’ কিংবা ‘যৌথ বিবৃতি’ শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত। ‘বিবৃতি’ কিংবা ‘যৌথ বিবৃতির’ ধারণাটি মূলত যেকোনো দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রভাবশালীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি মাধ্যম; যেখানে ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এককভাবে কিংবা সমন্বিতভাবে অধিকার আদায়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যেহেতু সরকার থাকেন, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব বিবৃতির লক্ষ্য থাকেন সরকার। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছি, ইদানীং সহিংসতায় বিভিন্ন ঘটনায় সরকার নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানাচ্ছে এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করছে।
প্রশ্ন হলো, সরকার নিজেই যদি দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি কথা না জানিয়ে সাধারণ জনগণের মতো নিন্দা জ্ঞাপন আর শাস্তির দাবির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে, তাহলে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সরকারের পার্থক্যটা রইল কোথায়?
জনগণ তাদের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর যৌক্তিক দাবির কথা কার কাছে জানাবেন?
অপরাধ আর অপরাধীর বিরুদ্ধে সরকারের নমনীয় অবস্থান দিন দিনই পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলছে। বিভিন্ন সময়ে সাজাপ্রাপ্ত দাগি আসামিদের জেলের বাইরে বেরিয়ে আসা, সন্ত্রাসবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিগুলোর সদর্প বিচরণ, ভিন্নমতের প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য আর প্রকাশ্য হুমকি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো ব্যক্তিদের আইনের আশ্রয়ে নিয়ে না আসার মতো যে উদাহরণগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, এর চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের।
এর ভয়াবহতা দিন দিন আরও প্রকট হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বলে অপরাধকে পাশ কাটিয়ে কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এড়িয়ে গেলেই অপরাধ কিন্তু হারিয়ে যায় কিংবা কমে যায় না; বরং উদাসীনতা অপরাধকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেয়।
আর এই আশ্রয়–প্রশ্রয়ে অপরাধের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এগিয়ে আসছে নির্বাচন। অপরাধ দমনে এখনই কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া না হলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
আমরা সরকারের কাছে দায়সারা কোনো বিবৃতি কিংবা ব্যাখ্যা চাই না; বরং আমরা চাই অপরাধের প্রতি সরকারের কঠোর অবস্থান ও অপরাধীর প্রতি শূন্যসহিষ্ণু দৃষ্টিভঙ্গি এবং অপরাধ দমনে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ। অপরাধীর সামনে নুয়ে পড়া কিংবা জেনে বুঝে ষড়যন্ত্রকারীর অযৌক্তিক আবদারকে মেনে নেওয়া আর যা–ই হোক; একটি স্বাধীন দেশের সরকারকে মানায় না।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
purba_du@yahoo.com