শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলে ৩০০ ফিটে সংবর্ধনাস্থলের দিকে যাওয়ার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলে ৩০০ ফিটে সংবর্ধনাস্থলের দিকে যাওয়ার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।

মতামত

এখন যিনি নেতা, রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়

আমাদের একজন বিশিষ্ট কবি হেলাল হাফিজের একটা শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কবিতাটির বহুল উচ্চারিত দুটি লাইন—‘এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।

আমাদের দেশের জন্য এখন অনেকটা ‘যুদ্ধের’ সময়—দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধ। আমরা দিশাহারা হয়ে ভাবছি, কে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন এই ‘যুদ্ধে’? কাউকেই খুব প্রতিশ্রুতিশীল মনে হচ্ছে না।

এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের প্রয়োজন একজন রাষ্ট্রনায়ক। কবি হেলাল হাফিজ বেঁচে থাকলে হয়তো আরেকটা কবিতা লিখতেন—

‘এখন যিনি নেতা,
রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়।’

নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন অবশ্যই হবে। তবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত ‘সুন্দর নির্বাচন’ কতটুকু সুন্দর হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।

চারদিকে শুধু হুংকার আর হুংকার! প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ওপর হামলা নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন একটা অবান্তর চিন্তা।

নেতারা বলছেন, তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদেরই নিতে হবে। নেতাদের জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স চালু করা হয়েছে। বড় নেতারা সবাই নিজ নিজ নিরাপত্তায় ব্যস্ত, জনগণকে কে নিরাপত্তা দেবে?

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে বলল, দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। তাতে কূটনীতিবিদেরা আশ্বস্ত হতে পারেন, কিন্তু জনগণ কি আশ্বস্ত হবে?

সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নির্বাচন হতে হবে। একমাত্র নির্বাচিত সরকারই পারবে দেশে একটি উত্তেজনাহীন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে এবং দেশকে এই মব–সন্ত্রাসের অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে।

বাংলাদেশের জনগণ সংঘাতময় পরিবেশে দারুণ ক্লান্ত—এখন শান্তি চায়। আর নয় একনায়কবাদের ঝংকার, নয় কোনো লাশের হুংকার কিংবা ধর্ম নিয়ে বিভাজন।

এখন সময় একটা নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে সাংবিধানিক পথে দেশকে পরিচালনার।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আর অপমান করা হবে না, আমাদের বাউল ও সংস্কৃতিকে কেউ উপহাস করবে না, আমাদের সংবাদপত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনে কেউ আগুন দেবে না, আমরা ভোট দিয়ে আমাদের প্রতিনিধি বানাব এবং আমাদের পররাষ্ট্রনীতি রাস্তার মিছিলে প্রণীত হবে না—এসব খুবই সাধারণ চাওয়া।

কেউ কি পারবেন আমাদের এই চাওয়াগুলো মেটাতে? আমাদের কোনো নেতা কি এগিয়ে আসবেন উচ্চকণ্ঠে বলতে, ‘হে জনতা, তোমরা আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, আমিই পারব তোমাদের চাওয়া মেটাতে, দেশে শান্তি আনতে।’

বড় রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে, সবার চোখ এখন তারেক রহমানের দিকে। তিনি কী বলেন, তিনি কী করেন এবং তিনি কী পদক্ষেপ নেন তাঁর দলকে সুশৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে, তা দেখার জন্য সবাই উদ্‌গ্রীব।

প্রথম আলোর এক জরিপে দেখা গেছে, বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা বিএনপির। জরিপ বলছে, বিএনপি পাবে ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জামায়াত ইসলামী পাবে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ আসন।

মোটাদাগে এ দুই দলের জনসমর্থনের আভাসও মিলবে এই জরিপে। সম্ভাবনা বা সমর্থন, যা–ই বলি না কেন, পাল্লা ভারী বিএনপির দিকে।

তাই বিএনপি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে, সে আলোচনাই এখন প্রবল। কিন্তু সরকার গঠন করার পর বিএনপি কী করবে?

বিরোধী দল কারা হবে? জরিপ অনুযায়ী জামায়াত হবে বিরোধী দল। যদি তা–ই হয়, তাহলে এ নির্বাচনে জুলাই আন্দোলনের নেতারা যাঁরা এই সরকারকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাঁরা ‘ক্ষমতা’ হারাবেন। বিএনপি কি পারবে চাপ ও মবের রাজনীতিকে উল্টে দিতে?

তারা কি পারবে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে, যেখানে সব সমস্যার সমাধান হবে সংসদে। সত্যিকার অর্থে বিএনপি নেতৃত্বের বড় পরীক্ষা হবে নির্বাচনের পর। তাই বলছিলাম, এখন যিনি নেতা, রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়।

নেতা নির্বাচিত হবেন, প্রধান মন্ত্রী হবেন, প্রেসিডেন্ট হবেন। নতুন শাসকশ্রেণি আসবেন। আমরা কি নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারব?

আমাদের দেশে কখনো তো শাসকের অভাব ছিল না। তাহলে শান্তি আসেনি কেন? কেন হলো এত মারামারি ও খুনোখুনি?

আমাদের দুজন রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রাণ দিতে হলো, অন্যদের টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো। প্রতিবার কেন সরকার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করতে হয়?

যাঁরা আমাদের ক্ষমতায় ছিলেন বা ক্ষমতায় আসতে চান, তাঁরা নিজ নিজ আয়নায় উত্তরটা পেয়ে যাবেন।

উত্তর কিন্তু একটাই—আমাদের শাসকেরা দেশের চেয়ে নিজের ক্ষমতাকেই বেশি ভালোবেসেছেন।

কেউ চাননি নিজের কাজের মহিমা দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে, কেউ চাননি নিজের কাজের ব্যর্থতা স্বীকার করে ক্ষমতা ছাড়তে এবং কেউ চাননি নিজের মেধা দেখিয়ে ক্ষমতায় আসতে।

যিনি ক্ষমতায় আছেন, তিনি চেয়েছেন লাঠিপেটা করে অন্যদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে। যিনি ক্ষমতায় আসতে চাইছেন, তিনি চেয়েছেন ক্ষমতাসীনদের টানাহেঁচড়া করে ক্ষমতার বাইরে নিতে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলে ৩০০ ফুটে গণসংবর্ধনাস্থলের দিকে রওনা হওয়ার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান।

দেশের জনগণের যেহেতু কোনো ভালো বিকল্প ছিল না, তারা কখনো এক পক্ষে, কখনোবা অন্য পক্ষে হাততালি দিয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রেখেছেন।

কেন এমন হলো? কারণ, আমাদের যাঁরা নেতা ছিলেন, তাঁরা কেউই শাসক থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠতে পারেননি। তাঁরা ভিত্তিটা ভালোভাবে গড়তে পারেননি।

কেউই রেখে যেতে পারেননি নিয়মতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসনের ভালো উদাহরণ, যা অন্যরাও অনুসরণ করতে পারতেন।

ক্ষমতায় পুরুষ ছিলেন, নারী ছিলেন, জেনারেল ছিলেন, ছিলেন সিভিলিয়ান; সবাই রেখে গেছেন একই উদাহরণ—নিজে ক্ষমতায় এসে অন্যদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করা এবং যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী, কীভাবে তাঁদের অকেজো করে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা।

মাঝেমধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, আন্দোলন বা নিয়ম-অনিয়ম করে। যাঁরা ছিলেন নিপীড়িত, তাঁরাই ক্ষমতায় গিয়ে হয়ে গেছেন নিপীড়ক।

আমাদের দরকার একজন স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক, যিনি নেহরু, ম্যান্ডেলা, লি কুয়ান ইউ ও মাহাথিরের মতো পথ দেখাবেন এবং একটা শাসনতন্ত্রান্ত্রিক ভিত্তি তৈরি করবেন, যার মূলমন্ত্র হবে—

১. অন্যদের জন্যও ক্ষমতায় আসার সমান সুযোগ রাখা এবং ২. প্রতি পাঁচ বছরে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন ও নিয়মমাফিক শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

আমাদের সরকারে সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির সংস্কার নিয়ে সবাই নিশ্চুপ। অবশ্য এটাও ঠিক, রাজনীতির সংস্কার কাগজে–কলমে আইন লিখে করা যাবে না।

রাজনীতির সংস্কার আসবে রাজনীতিকদের সুরাজনীতির চর্চা থেকে, রাজনীতির সংস্কার আসবে রাষ্ট্রের উন্নতির প্রতি রাজনীতিবিদদের দায়বদ্ধতা থেকে।

রাজনীতিবিদদের দায়বদ্ধতা না থাকলে আমাদের রাষ্ট্র কোনো দিন নিয়মতান্ত্রিকতায় ফিরে যেতে পারবে না। রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার দুটি শর্ত যিনি পূরণ করতে পারবেন, তিনিই হবেন আমাদের বড় সংস্কারক।

তারেক রহমান যদি একজন রাষ্ট্রনেতা, একজন ভালো শাসক এবং একজন ভালো রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন, তাহলে তাঁর নাম আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে স্বর্ণাক্ষরে এবং তিনি আমাদের পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ রেখে যাবেন। শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক হলেও তাঁর অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব।

আমাদের পূর্বপুরুষ কোনো শাসক এ দুটি দাবি মেটাতে পারেননি। তাই আমাদের মেনে নিতে হয়েছিল, একদলীয় শাসন, ‘হ্যাঁ-না’ ভোট, জেনারেলদের শাসন, নিরপেক্ষ সরকারকে অনিরেপেক্ষ করার চেষ্টা, গুম-খুন, রাতের নির্বাচন, ডামি-আমি নির্বাচন ইত্যাদি।

এ দুটি ভিত্তির মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে অনেক পূর্বশর্ত, যেমন নিরপেক্ষ নির্বাচন, নিপীড়নমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সুশাসনের প্রচেষ্টা ইত্যাদি।

এ দুটি দাবি পূরণ হলে দেশের জন্য সৃষ্টি হবে এক স্থিতিশীল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, যেখানে একজন শাসককে দেশ শাসনের জন্য জনগণ দায়িত্ব দেবে পাঁচ বছর, তিনি আশা পূরণ না করতে পারলে পরের নির্বাচনে আরেকজন শান্তিপূর্ণভাবে আসবেন।

প্রশ্ন হলো, কে হবেন সেই স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়ক, যিনি আমাদের নিয়মতান্ত্রিকতার পথে এগিয়ে নিতে পারবেন?

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে প্রথমেই নাম উঠবে তারেক রহমানের। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি কি পারবেন আমাদের দুটি ছোট্ট দাবি মিটিয়ে আমাদের রাষ্ট্রনায়ক হতে এবং আমাদের একটা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নিতে?

যিনি রাষ্ট্রনায়ক হবেন এবং তিনি যদি একই সঙ্গে ভালো শাসক হন, তাহলে দেশের জন্য সোনায় সোহাগা। একজন রাষ্ট্রনায়ক, একজন ভালো শাসক এবং একজন ভালো নেতা পাওয়ার জন্য এ দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনেক দিনের।

তারেক রহমান যদি একজন রাষ্ট্রনেতা, একজন ভালো শাসক এবং একজন ভালো রাজনৈতিক নেতা হতে পারেন, তাহলে তাঁর নাম আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে স্বর্ণাক্ষরে এবং তিনি আমাদের পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ রেখে যাবেন। শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক হলেও তাঁর অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব।

এখন যিনি নেতা, রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়। তারেক রহমান কি হতে পারবেন সেই রাষ্ট্রনায়ক?

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    ই-মেইল: salehpublic711@gmail.com