
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা পদমদী গ্রাম। সেখানেই শায়িত আছেন বাংলা ভাষার বিখ্যাত লেখক নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর ১৭৮তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে ১৩ নভেম্বর বাংলা একাডেমির আয়োজনে পদমদীতে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্রে আলোচনা অনুষ্ঠান ছিল। আমি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সচিব, পরিচালক, কয়েকজন উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, রাজবাড়ীর ডিসি, বালিয়াকান্দির ইউএনও উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজন কবি-লেখক-সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হলো।
অনুষ্ঠান শেষে ইউএনওকে বললাম চত্রা নদী দেখতে যাব। নদীতে যাওয়ার একটি ব্যবস্থা করার অনুরোধ করি তাঁকে। দুটি মোটরসাইকেল প্রয়োজন। ইউএনও উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি। চত্রা নদীর কথা বলতে মনে হলো তিনি চিনতে পারলেন না। হয়তো নতুন এসেছেন। তবে দুজন ব্যক্তিকে সঙ্গে দিলেন নদী দেখানোর জন্য। অপূর্ব রায় ও তপু আহমেদ।
চত্রা নদী রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার সিরাজপুর হাওর নদীর শাখানদী। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ কিলোমিটার। নদীটি দেখতে গেলাম নারুয়া ইউনিয়নে। যে স্থানে চত্রা নদী দেখতে গেলাম, সেই স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি স্লুইসগেট আছে। ওই বাজারের নামও স্লুইসগেট বাজার। স্লুইসগেট–সংলগ্ন নদীর ভেতরে একটি টিনের চালাঘর। এখনই যদি টিনের চালাঘরটি তুলে দেওয়া না যায়, তাহলে দখল আরও বাড়তে থাকবে।
আমাদের দেশে নদীগুলোর সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা লাগবেই। কিন্তু বারবার বদলি আর নানাবিধ কাজের কারণে যাঁদের নদী সুরক্ষায় কাজ করা প্রয়োজন, তাঁরা নদীগুলোই চেনেন না। এ জন্য সামাজিক সংগঠনগুলোর একটি বড় দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন
স্লুইসগেট থেকে তিন-চার শ মিটার ভাটিতে গড়াই নদে চত্রা নদী মিলিত হয়েছে। মিলিত স্থান দেখতে গেলাম। গড়াই নদে অনেক পানি আছে। যে স্থানে চত্রা নদী মিলিত হয়েছে, সেখানে নারী-শিশু-বৃদ্ধ গোসল করছেন, কাপড় পরিষ্কার করছেন। শিশুদের লাফালাফি দেখতে ভালোই লাগছিল।
দুটি নদীর মিলিতস্থলে একটি নৌকা ভেড়ানো। একজন মাঝি জাল থেকে মাছ নামাচ্ছেন। জেলে কী মাছ পেয়েছেন, তা দেখতে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম ইলিশ মাছ ধরছেন। মাঝির নাম রেজাউল ইসলাম। বয়স ৪০-৪৫ বছর। ছোটবেলা থেকে ইলিশ মাছ ধরেন। কোনো কোনো দিন একাই ১৫-২০ কেজি ইলিশ মাছও পান। তবে এ রকম দিন কম। তিন জানালেন, এ বছর গড়াই নদে পৌনে দুই কেজি ওজনের ইলিশ অনেক পাওয়া গেছে। দিনে–রাতে ইলিশ ধরা চলে। যাঁদের জাল আছে, তাঁরাই মাছ ধরতে পারেন।
গড়াই নদে ভাঙন আছে। দেখলাম ‘গড়াই কফি হাউস অ্যান্ড ফুড ভ্যালি’ নামক দোকান প্রায় ভাঙনে পড়েছে। পাকা সড়কে চলে আসছে নদী। অপূর্ব রায় জানালেন, নদীর বাঁ তীরে কয়েক শ মিটার ভেঙেছে। নদী–লাগোয়া বাড়িওয়ালা এক চাচা ভাঙন বন্ধের দাবি জানাচ্ছিলেন। বাড়ি ভেঙে গেলে কোথায় যাবেন জানেন না।
চত্রা নদী দেখে আমরা গেলাম বাটিখাল নদী দেখতে। এই নদীতেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেট আছে। স্লুইসগেট যেহেতু নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট প্রস্থের, তাই স্লুইসগেটকে নদীর প্রস্থ হিসেবে ধরে দখলপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই স্থানটি বকচর স্লুইসগেট নামে পরিচিত। এই নদীটিও বালিয়াকান্দি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত। নদীটি গড়াই নদের উপনদী।
রাজবাড়ীর একটি নদীর নাম চন্দনা। কী সুন্দর নাম! নদীটি বালিয়াকান্দি উপজেলা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। তপু আহমেদ জানালেন, এই নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যায়। তাঁর কাছে জানলাম গত বছর বড়শি দিয়ে অনেকেই প্রচুর ট্যাংরা মাছ ধরেছেন। ডাহুক এবং ছোট পানকৌড়ি দেখলাম। নদীটিতে দূষণ আছে। প্লাস্টিক-ময়লা-আবর্জনা ফেলছে অনেকে।
চন্দনা নদী দেখার পর আমরা যাচ্ছিলাম হড়াই নদ দেখতে। হড়াই নদে যাওয়ার আগে বহরমপুর নিমতলা বাজারের কাছে আরেকটি প্রবাহ চোখে পড়ল। দেখতে নদী মনে হচ্ছিল। কচুরিপানায় ভর্তি। তপু আহমেদের কাছে জানলাম এর নাম মরাচন্দনা। এর প্রবাহ কোথাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হলো।
এখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে লিজ দেওয়া হয়। যারা লিজ নিয়েছিল, তারা ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে পলাতক। সে জন্য মাছ চাষও নেই, কচুরিপানাও সরানো হয়নি। নদীটির পুরোনো প্রবাহ ফেরানো যায় কি না, উপজেলা কিংবা জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি সরেজমিন দেখতে পারেন।
কবি সালাম তাসির নিজের লেখা একটি বই ওই দিন উপহার দেন। বইটিতে একটি কবিতা আছে। কবিতার নাম ‘হড়াই নদীর বাঁকে’। হড়াই নদ রাজবাড়ী এবং বালিয়াকান্দি উপজেলাকে আলাদা করেছে। দেখলাম ছিমছাম হড়াই নদ বয়ে গেছে। সন্ধ্যায় দেখতে গেলাম পদ্মা নদী। পদ্মা এই জেলায় গোয়ালন্দে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলায় কতগুলো নদী আছে, তা জানার চেষ্টা করলাম। সরকারি তালিকায় রাজবাড়ী জেলার নদ–নদীর সংখ্যা মাত্র ৯। চত্রা, চন্দনা, হড়াই, গড়াই, পদ্মা, যমুনা, সিরাজপুর হাওর, মরাকুমার ও কৈজুরী খাল। এই তালিকায় নেই বাটি খাল কিংবা মরাচন্দনা। মরাকুমার ও সিরাজপুর হাওর নদী ছাড়া অন্য নদীগুলো আমার দেখা।
রাজবাড়ী জেলার নদীগুলোর সব কটিকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। দখল-দূষণসহ অন্য যেসব ক্ষতিকর দিক এ জেলার নদীগুলোতে আছে, তা দূর করা সম্ভব। অনেক জেলায় নদীবিষয়ক সংগঠন আছে। এ রকম একটি কার্যকর সংগঠন রাজবাড়ীতে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যারা রাজবাড়ীর নদীগুলোর সংকট চিহ্নিতকরণ ও সুরক্ষায় কাজ করবে। সরেজমিন অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তালিকার বাইরে আরও নদী রয়েছে।
আমাদের দেশে নদীগুলোর সুরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা লাগবেই। কিন্তু বারবার বদলি আর নানাবিধ কাজের কারণে যাঁদের নদী সুরক্ষায় কাজ করা প্রয়োজন, তাঁরা নদীগুলোই চেনেন না। এ জন্য সামাজিক সংগঠনগুলোর একটি বড় দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক