
পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বাংলাদেশ সফরটি যতটা কূটনৈতিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন। তাঁর সফরকালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি ও চারটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এগুলোর নিশ্চয়ই গুরুত্ব আছে।
কিন্তু রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে একাত্তর প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য এবং তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়াও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং শফিকুর রহমানের হার্টের অপারেশন হয়েছে সম্প্রতি। ইসহাক দার তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইতে পারেন। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে নয়।
১৩ বছর পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটা প্রথম সফর। এর আগে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি ঢাকা সফর করেছিলেন। এরপর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দেওয়াকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তান সে সময় এর নিন্দা জানায়।
একাত্তরের বিষয়টি দুবার মীমাংসা হয়েছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক মহলে তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রতিবাদ হয়েছে। তাঁর দাবি, ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। এরপর ২০০০ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এখানে (বাংলাদেশে) এসে প্রকাশ্যে ও খোলামনে বিষয়টির সমাধান করেছেন।
দুই দেশের মধ্যে ভিসা রেয়াত নিয়ে যে চুক্তিটি হয়েছে, তার সুবিধা পাবেন শুধু সরকার ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা। সই হওয়া এমওইউর মধ্যে আছে, দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার (বাসস ও এপিপিসি) মধ্যে সহযোগিতা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সঙ্গে পাকিস্তানের ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইসলামাবাদের (আইএসএসআই) সহযোগিতা নিয়েও সমঝোতা স্মারক সই হয়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ইসহাক দারের সফরকে দুই দেশের মধ্যে ‘একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ বলে অভিহিত করলেও একাত্তরের ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে মীমাংসা না করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইসহাক দারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন। দ্বিমত পোষণ করেছেন স্বয়ং পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও। তাঁরা বলেন, এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো সরকার একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি। ১৯৭৪ সালে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতে আটক সব পাকিস্তানি বন্দীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো একাত্তরের বিপর্যয়ের জন্য সেনা নেতৃত্বকে দায়ী করে ‘তওবা’ করার কথাও বলেছিলেন। গণহত্যায় সেনাবাহিনীর দায় নিরূপণে তিনি হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করলেও বোধগম্য কারণে সেটি প্রকাশ করেননি।
নব্বইয়ের দশকে কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জানা যায়, কেবল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয়, ভুট্টোসহ পাকিস্তানি নেতারাও গণহত্যায় ইন্ধন জুগিয়েছেন।
কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যে তিনটি বিষয়ে এখনো অমীমাংসিত আছে তা হলো, একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়া ও একাত্তরপূর্ব সম্পদের হিস্যা আদায়। মাস ছয়েক আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের সময়ও বাংলাদেশ একাত্তরের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সফরের কথা উল্লেখ করে ইসহাক দার বলেন, ‘তিনি (পারভেজ মোশাররফ) প্রকৃতপক্ষে নমনীয়ভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আমি মনে করি, পরিবারের মধ্যে বা ভাইদের মধ্যে ঘটলে এসব করা হয়। এমনকি ইসলাম আমাদের বলেছে, “তোমাদের দিল পরিষ্কার করো।”’
পাকিস্তানকে মনে রাখতে হবে, এটি ‘পরিবার’ বা ‘ভাতৃত্বের’ বিষয় ছিল না, এ দেশের মানুষের ওপর তারা একটি গণহত্যা চালিয়েছে। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার দিল পরিষ্কার করার কথা বলেছেন? যারা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের, না যাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের? বাংলাদেশের মানুষের দিল পরিষ্কার বলেই পাকিস্তানি সেনা ও শাসকদের বর্বরতা ক্ষমা করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন শীর্ষ কর্মকর্তাকেও ছেড়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একমত কি না, সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমি একমত নই। আমি যদি একমত হতাম, তাহলে তো সমস্যার সমাধানই হতো। বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। আমরা একাত্তরের দেনা–পাওনার হিসাব চাই। একই সঙ্গে একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করি। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নিতে হবে।’
তৌহিদ হোসেন স্বীকার করেন যে ‘একাত্তরের বিষয়টি এক দিনে সমাধান হবে না এবং আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছি।’
২০১৩ সালের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। গত বছর গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা গতি আসে। সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ইসহাক দারের সফরকে দুই দেশের মধ্যে ‘একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক’ বলে অভিহিত করলেও একাত্তরের ইস্যুটি আনুষ্ঠানিকভাবে মীমাংসা না করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন আদৌ সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।
*মতামত লেখকের নিজস্ব