
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৯ জুলাই হোয়াইট হাউসে গ্যাবন, গিনি-বিসাউ, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া ও সেনেগালের নেতাদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী একটি ছোট সম্মেলন করেন।
তবে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জনসমক্ষে অপমান করার মধ্য দিয়ে। আর সম্মেলন নামের এই নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।
যে অপমানজনক দৃশ্যটি সম্মেলনের শুরুতে ঘটেছে, তা সম্মেলনের মূল অনুষ্ঠানসূচির অংশ ছিল না। অন্তত যেভাবে সম্মেলনটি জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করার কথা ছিল, তাতে এই অপমান বা কর্তৃত্বমূলক আচরণ থাকার কথা ছিল না।
হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা ৩ জুলাই বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেন, আফ্রিকার দেশগুলো অসাধারণ ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করতে পারে। এ সুযোগ আমেরিকান জনগণ এবং আমাদের আফ্রিকান অংশীদার—উভয়েরই উপকারে আসবে।’
তবে কাকতালীয় নাকি পূর্বপরিকল্পিত, তা নিশ্চিত না হলেও বৈঠকটি এমন এক দিনে অনুষ্ঠিত হয়, যেদিন ট্রাম্প প্রশাসন তাদের বাণিজ্যযুদ্ধ আরও জোরদার করে নতুন করে আটটি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করে। আর এর মধ্যে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া ও আলজেরিয়াও ছিল।
এ ঘটনা এক গভীর বার্তা বহন করে। ট্রাম্প একদিকে যখন বলছেন, তিনি ‘আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার’ করছেন, অন্যদিকে তাঁর প্রশাসন আফ্রিকান দেশগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে।
দৃশ্যপটটি ট্রাম্পের আফ্রিকা নীতি নিয়ে একধরনের অসংগতি প্রকাশ করে। মনে হচ্ছে তাঁর নীতিতে অংশীদারি আসলে নির্ভর করছে যেসব শর্তের ওপর সেগুলো প্রায়ই শাস্তির মতো মনে হয়।
সম্মেলনের শুরুতেই ট্রাম্প চার মিনিটের একটি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, এই পাঁচজন আমন্ত্রিত নেতা পুরো আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
যদিও বাস্তবে এই দেশগুলোর কোনো একটিও যুক্তরাষ্ট্র-আফ্রিকা বাণিজ্যে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রাখে না, কিন্তু ট্রাম্পের কাছে তা মনে হয়নি। তাঁর কাছে এই দেশগুলোর মাটির নিচে লুকানো সোনা, খনিজ ও তেলসম্পদই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘এই মহান নেতাদের ধন্যবাদ… এঁরা সবাই খুবই শক্তিশালী অঞ্চল থেকে এসেছেন। এঁদের জমি খুব দামি। এসব জমিতে রয়েছে চমৎকার খনিজ, প্রচুর তেল এবং সেখানে অনেক ভালো মানুষও আছেন।’
এরপর তিনি ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আফ্রিকার এই দেশগুলোকে ‘সহায়তা’ না দিয়ে তাদের সঙ্গে ‘বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে’, কারণ এটি এসব দেশের উন্নয়নের জন্য ‘আরও কার্যকর, দীর্ঘস্থায়ী’ ফল দেবে।
এখানেই ট্রাম্পের কূটনৈতিক সম্পর্কের ভান খোলস ভেঙে বেরিয়ে পড়ে, আর তাঁর আসল চেহারাটি প্রকাশ পায়। এই বক্তব্যের পরই ট্রাম্প রাষ্ট্রনায়ক থেকে এক প্রদর্শনপ্রবণ মঞ্চসজ্জকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি শুধু অতিথিদের স্বাগত জানানোয় সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং তিনি তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন।
এরপর পুরো সম্মেলনটি এক বিব্রতকর প্রদর্শনীর দিকে মোড় নেয়। সেখানে আফ্রিকাকে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের মহাদেশ হিসেবে নয় বরং এক বিশাল সম্পদভান্ডার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
সেখানে বসে থাকা আফ্রিকান নেতাদের তখন অসহায় অনুগত প্রতিনিধির মতো মনে হচ্ছিল। ক্যামেরার সামনে মনে হচ্ছিল তাঁরা আগে থেকে বলে দেওয়া ভূমিকা পালন করছিলেন।
আসলে এটি কোনো সংলাপ-বৈঠক ছিল না। এটি ছিল ট্রাম্পের কর্তৃত্ব প্রদর্শনের মঞ্চ। এটি ছিল এক সম্পূর্ণ পরিকল্পিত প্রদর্শনী, যেখানে দৃশ্যপট রচনা করেছিলেন ট্রাম্প নিজে। আর আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানেরা সেখানে গৌণ চরিত্রে ছিলেন।
ট্রাম্প স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একজন পাপেট মাস্টারের মতো পুরো আয়োজনটি নিজে পরিচালনা করছিলেন। সেখানে প্রত্যেক আফ্রিকান অতিথিকে তিনি কে কী বলবেন এবং কীভাবে তাঁর অনুকূলে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তা নির্দিষ্ট করে বাতলে দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁদের ‘মিডিয়ার সামনে কিছু মন্তব্য করতে আমন্ত্রণ’ জানান। কিন্তু সেই ‘আমন্ত্রণ’ কার্যত ছিল একধরনের নির্দেশ। এ সময় এই পর্ব একটি সাজানো আনুগত্য প্রদর্শনীতে পরিণত হয়।
মৌরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ওলদ গাজোয়ানি শারীরিকভাবে এবং প্রতীকীভাবে ছিলেন এই নাটকের প্রথম অভিনয়শিল্পী। তিনি ট্রাম্পের ‘আফ্রিকার প্রতি প্রতিশ্রুতি’র প্রশংসা করেন। অথচ তাঁর এই বক্তব্য ছিল যেমন বিভ্রান্তিকর, তেমনি অবাস্তব।
কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগেই আফ্রিকার জন্য সহায়তা কমিয়েছে, আফ্রিকায় শুল্ক আরোপ করেছে এবং আফ্রিকান নাগরিকদের জন্য ভিসা নীতিও কঠোর করেছে।
সবচেয়ে বিব্রতকর মুহূর্তটি আসে তখন, যখন গাজোয়ানি ট্রাম্পকে বিশ্বের সেরা শান্তি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দাবি করেন, ট্রাম্প নাকি ‘ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন’।
এই প্রশংসার মধ্যে একবারও উল্লেখ করা হয়নি, গাজার ওপর ইসরায়েলের যে যুদ্ধ চলছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন স্পষ্ট ভাষায় তার নিন্দা করেছে।
গাজোয়ানির এই সত্য চেপে যাওয়া একপ্রকার ইসরায়েলের প্রতি সম্মতির মতোই ছিল। আসলে গাজা ইস্যুতে তাঁর সত্য এড়িয়ে যাওয়া পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশাকে মুছে ফেলার চেষ্টাতেই সায় দিয়ে গেছে। আর এটি তিনি করছেন শুধু আমেরিকার সুনজর পাওয়ার আশায়।
সম্ভবত নিজ দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের আশঙ্কা মাথায় রেখেই ২০২৪ সালের আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গাজোয়ানি নিজেকে একপ্রকার স্বেচ্ছায় করুণা প্রার্থনাকারীর ভূমিকায় নিয়ে যান।
তিনি ট্রাম্পকে মৌরিতানিয়ার মূল্যবান খনিজ সম্পদ ব্যবহার করার জন্য কার্যত আমন্ত্রণই জানান। তিনি ট্রাম্পকে ‘শান্তিদূত’ বলে প্রশংসা করার সময় এই কথাও এড়িয়ে যান যে, ট্রাম্পের দেওয়া অস্ত্র দিয়েই গাজায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
এই রকম ভঙ্গিমাই পুরো বৈঠকের সুর ঠিক করে দেয়। একে একে প্রত্যেক আফ্রিকান নেতা ট্রাম্পকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন এবং নিজেদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাঁর প্রবেশাধিকার দেন। কত সহজেই ক্ষমতার সামনে মানুষ মাথা নত করে ফেলে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল এই বৈঠক।
সেনেগালের প্রেসিডেন্ট বাসিরু দিয়োমায়ে ফায়ে এমনকি ট্রাম্পকে তাঁর দেশে একটি গলফ কোর্স বানানোর অনুরোধও জানান। ট্রাম্প তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তার বদলে তিনি ফায়েকে অনেক তরুণ বয়সী চেহারার নেতা বলে প্রশংসা করেন।
গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট ব্রাইস ক্লোতায়ের ওলিগি এনগেমা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘উইন-উইন পার্টনারশিপ’ বা দুই পক্ষেরই লাভ হয়—এমন অংশীদারির কথা বলেন। কিন্তু তাঁর এই সমমর্যাদার দাবির জবাবে ট্রাম্প খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।
এর মধ্যে ট্রাম্পের সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে বিষয়টি, তা হলো লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোআকাইয়ের ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা। বোআকাই কী বলছেন, সেদিকে না গিয়ে ট্রাম্প তাঁর ‘চমৎকার’ ইংরেজি শুনে অবাক হয়ে যান এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি এত সুন্দর করে ইংরেজি শিখলে কোথায়? কোথায় লেখাপড়া করেছ? লাইবেরিয়াতেই?’
ট্রাম্পের প্রশ্ন শুনে মনে হয়, তিনি জানেন না, লাইবেরিয়ার সরকারি ভাষাই হলো ইংরেজি। সম্ভবত তিনি জানেন না, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত ক্রীতদাসদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গড়ে তোলা দেশটির মানুষ ১৮২২ সাল থেকেই ইংরেজিভাষী।
তবে ট্রাম্পের এই অজ্ঞতা যতটা না অবাক করার মতো, তার চেয়েও বেশি অবাক করা বিষয় ছিল তাঁর প্রশ্নে ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রকাশ। একজন আফ্রিকান প্রেসিডেন্ট ভালো ইংরেজি বলতে পারেন—এই বিষয়েই ট্রাম্পের এমন বিস্ময় আসলে একধরনের বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে তুলে ধরে।
এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। ২৯ জুন হোয়াইট হাউসে কঙ্গো ও রুয়ান্ডার সঙ্গে এক শান্তি অনুষ্ঠানে ট্রাম্প অ্যাঙ্গোলার নারী সাংবাদিক হারিয়ানা ভেরাসকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি তো দেখতে ভারি সুন্দর; তুমি ভেতর থেকেও সুন্দর।’
ভেরাস সত্যিই ‘সুন্দর’ কি না, সেটি আসলে কোনো বিষয় না। আসল ব্যাপার হলো, ট্রাম্পের এই আচরণ ছিল অনুপযুক্ত ও অপেশাদার। এই মন্তব্য একজন সম্মানিত সাংবাদিককে তাঁর পেশাগত পরিচয়ের বদলে তাঁর চেহারার মাধ্যমে বিচার করল—তা-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অনুষ্ঠানের মাঝখানে।
অতীতে যখন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে না দেখে তাঁদের শুধু শারীরিক সৌন্দর্য বা আকর্ষণ দিয়ে মূল্যায়ন করা হতো, তখন এই রকম আচরণ প্রায়ই দেখা যেত।
এই চিন্তা বহু বছর আগে দাস ব্যবসা আর ইউরোপের উপনিবেশবাদ থেকে এসেছে। কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কামনার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা ছিল ট্রান্সআটলান্টিক দাস বাণিজ্য ও ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের মূল বৈশিষ্ট্য।
ট্রাম্পের ওই মন্তব্য সেই পুরোনো বর্ণবাদী মানসিকতাকেই আজকের দিনে টেনে এনেছে।
একইভাবে বোআকাইয়ের ইংরেজি শুনে ট্রাম্পের বিস্ময়ও একটি দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ধারা অনুসরণ করে। আফ্রিকান কেউ যদি ‘উপনিবেশকের ভাষা’ ভালোভাবে রপ্ত করেন, তাহলে তাঁকে একজন স্বাধীন ও বহুভাষী বুদ্ধিজীবী হিসেবে না দেখে বরং এমনভাবে দেখা হয় যেন তিনি আধিপত্যশীল সংস্কৃতিতে একরকম আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি তখন নিজের যোগ্যতার কারণে নয় বরং শ্বেতাঙ্গদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার কারণে পুরস্কৃত হন।
ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায়, তাঁর দৃষ্টিতে যদি কোনো আফ্রিকান ভালো ইংরেজি বলেন বা দেখতে ভালো হন, তাহলে সেটি তাঁর কাছে খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।
এতে বোঝা যায়, ট্রাম্প বোআকাই ও ভেরাস—এই দুজনকে শুধুই বাহ্যিক রূপ বা শব্দচয়ন দিয়ে মূল্যায়ন করেন। তাঁদের নিজস্ব স্বাধীনতা, অবদান বা কৃতিত্বকে তিনি গ্রাহ্য করেন না। এতে তিনি একদিকে তাঁদের ব্যক্তিসত্তাকে মুছে দেন, অন্যদিকে নিজের ঔপনিবেশিক অহংকারকে চরিতার্থ করেন।
ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ভাবল, মাত্র পাঁচজন লোক পুরো আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, তা এক রহস্যই। তবে হয়তো এই সম্মেলন আসলে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ছিল না; ছিল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। ট্রাম্প আসলে আলোচনা চাননি; তিনি সমান অংশগ্রহণও চাননি। তিনি চেয়েছিলেন একটা প্রদর্শনী। দুঃখজনকভাবে অতিথিরা সেটাই তাঁকে উপহার দিয়েছেন।
বোআকাই সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্য সবচেয়ে বেশি যেটি প্রকাশ করে, তা হলো, আফ্রিকার প্রতি তাঁর গভীর উদাসীনতা। এসব মন্তব্য স্পষ্ট করে দেয়, আন্তরিক অংশীদারত্ব গড়া মোটেও এই সম্মেলনের আসল উদ্দেশ্য ছিল না।
এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আয়োজন করা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-আফ্রিকা নেতাদের সম্মেলনের তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
সে সময় হোয়াইট হাউসে ৪০টির বেশি আফ্রিকান দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী নেতারা আমন্ত্রিত ছিলেন। সেই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল একে অপরের সঙ্গে সমানভাবে কথা বলা এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ‘এজেন্ডা ২০৬৩’-কে গুরুত্ব দেওয়া।
সেটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ। ট্রাম্পের এই সাজানো নাটকের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে ভাবল, মাত্র পাঁচজন লোক পুরো আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, তা এক রহস্যই। তবে হয়তো এই সম্মেলন আসলে প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ছিল না; ছিল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। ট্রাম্প আসলে আলোচনা চাননি; তিনি সমান অংশগ্রহণও চাননি। তিনি চেয়েছিলেন একটা প্রদর্শনী। দুঃখজনকভাবে অতিথিরা সেটাই তাঁকে উপহার দিয়েছেন।
এর আগের দিন, অর্থাৎ ৮ জুলাই ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত ও সুসংগঠিত বৈঠক করলেন, তার বিপরীতে আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে তাঁর মধ্যাহ্নভোজ ছিল একধরনের বিশৃঙ্খল ও বাস্তবতাবিচ্ছিন্ন আয়োজন।
সবাইকে সবচেয়ে হতাশ করেছেন সেনেগালের প্রেসিডেন্ট বাসিরু দিয়োমায়ে ফায়ে। তিনি নির্বাচনে জিতেছিলেন উপনিবেশবিরোধী অবস্থান নিয়ে। তিনি তাঁর ভোটারদের নতুন এমন এক আফ্রিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেখানে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং জাতীয় মর্যাদা ফিরিয়ে আনা হবে।
কিন্তু হোয়াইট হাউসে গিয়ে সেই তিনিই সবচেয়ে স্পষ্ট উপনিবেশবাদী মানসিকতার মানুষ ট্রাম্পের সামনে মাথা নত করলেন। বাকি নেতাদের মতো তিনিও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি, সমান মর্যাদা দাবি করেননি, নিজের দেশের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে কোনো চেষ্টা করেননি।
ঔপনিবেশিক মানসিকতার পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা সুযোগ যখন আফ্রিকার নেতাদের সামনে এল, তখন তাঁরা সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে উল্টো মাথা নিচু করে দাঁড়ালেন। তাঁরা ট্রাম্পের সামনে আধিপত্যে মোড়ানো সেই ষোড়শ শতকের স্মৃতি আবার আনার সুযোগ করে দিলেন।
আর সেই আনুগত্যের জন্য ট্রাম্প তাঁদের একটা পুরস্কারও দিলেন। তিনি বললেন, ‘ওরা এখন আমার বন্ধু, তাই আমি তাদের ওপর নতুন কোনো শুল্ক আরোপ করব না।’
এভাবেই ট্রাম্প একজন ‘প্রভু’ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করালেন। এর বিপরীতে আফ্রিকান নেতাদের তাঁর পায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে হলো।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
তাফি এমহাকা আল-জাজিরার কলাম লেখক