১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হলো বিএনপি; ‘ভি’ চিহ্নে তা প্রকাশে খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি
১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হলো বিএনপি; ‘ভি’ চিহ্নে তা প্রকাশে খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি

মতামত

খালেদার রাজনীতি ছিল সম্মানের, বিদায়ও হলো সম্মানের

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চলে গেলেন। ফিরে গেলেন সৃষ্টিকর্তার কাছে, ঠিক যেমনটি সুরা আল বাকারায় বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’

খালেদা জিয়া হাসপাতালে সিসিইউ এবং আইসিইউতে কাটাচ্ছিলেন কয়েক সপ্তাহ ধরে। তিনি যেন তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। এরপর তারেক রহমান এলেন, বেগম জিয়া চলে গেলেন।

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বেগম খালেদাই একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি নিজের সম্মান অক্ষুণ্ন রেখে ক্ষমতা ছেড়েছেন এবং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত নারী, যিনি নিজের সম্মানকে ক্ষমতার চেয়েও বেশি মর্যাদা দিতেন।

বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যতটুকু সম্মানিত ছিলেন, ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে তিনি তার চেয়ে কম সম্মানিত ছিলেন না।

একজন গৃহবধূ ও অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ কীভাবে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং কীভাবে একটা কোন্দলগ্রস্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলকে একত্র করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে রেখে গেছেন, তা খুঁজে বের করতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদদের তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অনেক বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে।

মৃদু হাসির আড়ালে তিনি ছিলেন একজন কঠোর রাজনীতিবিদ। কঠোর না হলে তিনি এত বড় একটি রাজনৈতিক দলে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারতেন না। তবে তাঁর কঠোরতার মধ্যে কোনো হিংস্রতা ও রুক্ষতা ছিল না।

ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বেগম জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি বানালেন, তাঁদের মধ্যে প্রোটোকল নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল। তিনি নিয়মমাফিক দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের ওপর ছেড়ে দিলেন এটি সমাধান করার জন্য।

বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সম্মানজনকভাবে পদত্যাগ করার সুযোগ দেওয়া হলো। দলের চেয়ারপারসন হিসেবে তখন বা তার পরেও এ ঘটনা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।

এর সঙ্গে শেখ হাসিনা কর্তৃক সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হেনস্তা করার ঘটনার তুলনা করলে দুজনের পার্থক্যটা পরিষ্কার বোঝা যায়।

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর  খালেদা জিয়া অনেকটা ছিলেন রাজনীতিবিমুখ। তা ছাড়া তখন অনেকেই চাইত না বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসুন।

বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ তাঁর বই ‘চলমান ইতিহাস’-এ লিখেছেন, ‘বেগম জিয়া দলের চেয়ারম্যান হোন এটি সামরিক নেতারা, দুই গোয়েন্দা বিভাগ এবং মন্ত্রিসভার দুই গ্রুপ—কেউই চায়নি। তাই বিচারপতি সাত্তারই হলেন বিএনপির চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি।’

বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ তাঁর বই ‘চলমান ইতিহাস’-এ লিখেছেন, ‘বেগম জিয়া দলের চেয়ারম্যান হোন এটি সামরিক নেতারা, দুই গোয়েন্দা বিভাগ এবং মন্ত্রিসভার দুই গ্রুপ—কেউই চায়নি। তাই বিচারপতি সাত্তারই হলেন বিএনপির চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি।’

এরশাদের সামরিক শাসনের পর বিচারপতি সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীকালে বিএনপি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হলো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাত্রা শুরু হলো খালেদা জিয়ার।

রাষ্ট্রপতি জিয়াকে যাঁরা হত্যা করেছিলেন বা হত্যাকাণ্ডে যাঁরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে কঠিন শাস্তি পেয়েছিলেন। বেগম জিয়ার মধ্যে তাই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মধ্যে প্রতিশোধের কোনো প্রবণতা ছিল না।

তাঁর মূল বাধ্যবাধকতা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষা করা। জিয়ার মৃত্যুর পর এম এ মতিন, জামাল উদ্দিন আহমেদ ও শাহ আজিজুর রহমানের উপদলীয় কোন্দলে বিএনপি একটি অকেজো রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল।

বিএনপি রাজনীতির মেরুকরণ ও ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস বেগম জিয়ার দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া

রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার প্রথম থেকেই বেগম জিয়া ছিলেন খুব আত্মবিশ্বাসী। ১৯৯১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বেগম জিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিল, ‘একজন নিহত জেনারেলের বিদ্রোহী বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া ৯ বছর ধরে রাস্তায় বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে একটি গণতান্ত্রিক বিদ্রোহের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন, যখন পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বিভ্রান্ত হয়েছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, খারাপ আবহাওয়া এবং খারাপ রাজনীতির ২০ বছরের ইতিহাস কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন।’

এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি সত্যিই অবহেলিত বোধ করি না। ক্ষমতায় থাকা একজন ব্যক্তি হওয়ার মধ্যে বিশেষ কিছু নেই।’

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় চেক অনিয়মের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তাঁকে গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে এবং অসুস্থ শরীরে তাঁর ওপর বড় অবিচার করা হয়েছিল; কিন্তু এ নিয়ে তাঁকে কখনো কোনো অভিযোগ বা কটু কথা বলতে শোনা যায়নি।

তিনি শুধু বলেছিলেন, তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন এবং তাঁর কাছেই এসবের প্রতিকার চান। এমনকি হাসিনা দেশ ছাড়ার পরও হাসিনাকে নিয়ে তিনি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি।

একটি অতৃপ্তি হয়তো তাঁর রয়ে গিয়েছিল, তিনি তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী দেখে যেতে পারলেন না। নির্বাচনের যখন মাত্র দেড় মাসের মতো বাকি এবং বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার যখন একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তিনি সৃষ্টিকর্তার ডাকে চলে গেলেন।

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার বড় লিগ্যাসি হলো ভদ্রতা ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ধৈর্য। এই দুটি গুণ তাঁকে তাঁর অনেক প্রতিপক্ষের কাছেও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।

তিনি যখন ক্ষমতায়, তখন দু–দুইবার তাঁকে তাঁর পলিসি নিয়ে দারুণ বিরুদ্ধতায় পড়তে হয়েছিল এবং তিনি দুবারই সম্মানের সঙ্গে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। কখনো দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বা সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চাননি।

ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার জনগণের ম্যান্ডেট নিতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। এর জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর নাম সব সময় সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হবে।

বেগম জিয়ার তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান বিএনপি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা শুরু করেন।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, বেগম জিয়ার ইচ্ছা ছিল তিনি ক্ষমতায় থাকতেই তারেক রহমানকে বিএনপির পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত করে নিজে সরে দাঁড়াবেন। নানা প্রতিকূল অবস্থায় তা হয়ে ওঠেনি।

তবে একসময় তিনি তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত করে দলের সব ক্ষমতা তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন।

একটি অতৃপ্তি হয়তো তাঁর রয়ে গিয়েছিল, তিনি তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী দেখে যেতে পারলেন না। নির্বাচনের যখন মাত্র দেড় মাসের মতো বাকি এবং বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার যখন একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তখনই তিনি সৃষ্টিকর্তার ডাকে চলে গেলেন।

তবে তিনি বিএনপি ও তারেক রহমানের জন্য অনেক ইতিবাচক ভবিষ্যতের আলো দেখে গেছেন। ছেলের জন্য এই ইতিবাচক ভবিষ্যৎ তিনি নিজেই গড়ে তুলেছিলেন এবং নিজেই সযত্নে এতদিন পাহারা দিয়ে গেছেন।

এখন আমাদের দেশের জন্য একটি সংকটপূর্ণ সময়। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দারুণভাবে দিশাহারা।

এই সময়টাতে আমাদের প্রয়োজন ছিল খালেদা জিয়ার মতো একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের।

ইদানীং দলীয় রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় বক্তব্য দেওয়া থেকে তিনি নিজেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রতি মান্যতা ও শ্রদ্ধা সব মহলেই ছড়িয়ে ছিল। এখন তিনি বেঁচে থাকলে জাতীয় একতার প্রতীক হয়ে দাঁড়াতে পারতেন।

যে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়া এতটা বছর সংগ্রাম করেছেন, সেই নির্বাচন সময়মতো অনুষ্ঠিত করে আমাদের রাজনীতিকেরা যদি দেশে একটা নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলেই তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো হবে।

খালেদা জিয়া চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর রাজনীতি ও আমাদের দেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান রয়ে যাবে চিরদিন। তাঁকে নিয়ে অনেক আলোচনা হবে, সমালোচনাও প্রচুর হবে। কারণ, কোনো রাজনীতিবিদই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।

তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা হবে, তা এই দেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদানকে আরও আলোকিত করবে।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
    ই-মেইল: salehpublic711@gmail.com