মতামত

ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশ্ন

ফুলবাড়ী আন্দোলন শুধু ওই অঞ্চলের মানুষের জমি আর বসতবাড়ি রক্ষার আন্দোলন নয়, এটি দেশের পানিসম্পদসহ সব সম্পদ রক্ষার। এসব সম্পদের ওপর সর্বজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। জাতীয় নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন তোলে এই আন্দোলন। ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থান এবং এর সঙ্গে উন্নয়ন প্রশ্ন নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ

অনেক বাধাবিঘ্ন হামলা হুমকি অগ্রাহ্য করে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীসহ ছয় থানার লক্ষাধিক মানুষ দেশ-মানুষ-প্রকৃতি বাঁচাতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ থেকে মিছিল করছিলেন। তাঁদের ওপর তৎকালীন বিডিআর গুলিবর্ষণ করেছিল।

গুলি ও ব্যাপক নির্যাতনে আন্দোলনকর্মী আমিন, তরিকুল ও সালেকিন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন দুই শতাধিক। ওই ঘটনায় আহত বাবলু রায় চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন।

কিন্তু মানুষ খুন করে ও জুলুম করে গণপ্রতিরোধ ঠেকাতে পারেনি তৎকালীন সরকার। উল্টো পুরো অঞ্চলে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি প্রশাসন অচল হয়ে পড়েছিল। দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় জনরোষে অভিযুক্ত জালিয়াত বিদেশি কোম্পানি পালায়। সরকার জনগণের দাবি মেনে ফুলবাড়ী চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয় ৩০ আগস্ট।

এর মধ্য দিয়ে মানুষ জীবন দিয়ে দেশের জন্য এক ভয়ংকর প্রকল্প ঠেকান; তা না হলে আবাদি জমি, পানি, বসত ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে দেশের কয়লা সম্পদ বিদেশে পাচারের প্রকল্পের জন্য নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পদের ভয়াবহ বিপর্যয় হতো। এত দিনে উত্তরবঙ্গ বিরান হতো। কয়েক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হতেন। কৃষিসহ প্রাণবৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হতো। দেশ এক ভয়াবহ জালে আটকে যেত।

২.

সেদিনের সে প্রেক্ষাপট আবার স্মরণ করা দরকার।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লা সম্পদ অনুসন্ধানের লাইসেন্স–সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৯৪ সালের ২০ আগস্ট।

একপর্যায়ে ফুলবাড়ীতে সমৃদ্ধ কয়লাখনির অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যে ১৯৯৭ সালে রহস্যজনকভাবে রাতারাতি ‘এশিয়া এনার্জি’ নামে একটি কোম্পানির জন্ম হয়। সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ নতুন এই কোম্পানির হাতে বিএইচপি তার লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ নিয়ে অন্যান্য চুক্তির মতো এটিও ছিল গোপন। জনগণের জীবন–জীবিকা, খনিজ সম্পদ, আবাদি জমি, পানিসম্পদ যে প্রকল্পের আওতাভুক্ত, সে প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়।

৩.

প্রকৃতপক্ষে বিএইচপি দেখেছে ফুলবাড়ী খনির গভীরতায় উন্মুক্ত খনি করতে গেলে ভূতাত্ত্বিক ও কারিগরি সমস্যা মোকাবিলা ছাড়াও বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত ঝুঁকি আছে। অসংখ্য নদীনালা, খাল–বিল, মৌসুমি ভারী বৃষ্টি, বন্যাপ্রবণ এই অঞ্চলে অস্ট্রেলীয় মান তো দূরের কথা, যেকোনো দেশের বিধি রক্ষা করে উন্মুক্ত খনি পরিচালনা সম্ভব হবে নয়। আবার অন্য পদ্ধতি অতটা লাভজনক হবে না।

বিএইচপি চায়নি পাপুয়া নিউ গিনির ওক-টেডি কপার খনির মতো আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় নিতে, যেখানে খনির বিষাক্ত পানি নিকটবর্তী নদীতে ভয়াবহ দূষণের সৃষ্টি করেছিল এবং নিচের বিশাল অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। বিএইচপিকে এর জন্য বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল।

বাংলাদেশের পানির আধার ও অন্য সবকিছু মিলে পরিস্থিতি আরও অনেক জটিল। বিএইচপি গোপন কোনো দফারফার মাধ্যমে তাই আগেভাগেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল।

আবাদি জমি, মাটির ওপরের ও নিচের পানিসম্পদ, বসতভিটা সবকিছু ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে, উত্তরবঙ্গকে অনুর্বর বিরান ভূমিতে পরিণত করে, দেশের কয়লা সম্পদ দ্রুত বিদেশে পাচারের এই প্রকল্পই ‘উন্নয়ন’ নামে চালু করার চেষ্টা হয়েছিল। পুরো প্রকল্পটি ছিল জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বুকের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মানুষ এ রকম একটি প্রকল্প ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে।

৪.

বিস্ময়কর যে বিএইচপির মতো অভিজ্ঞ সংস্থা যা সাহস করেনি, তা করার কথা বলে নতুন অনভিজ্ঞ একটি কোম্পানি লাইসেন্স পেয়ে গেল। পরিবেশগত সমীক্ষা করার আগেই তারা ছাড়পত্রও পেল! পুরো প্রকল্পই তাই প্রথম থেকেই অনিয়ম, দুর্নীতি আর বাটপারিতে পরিপূর্ণ।

কোম্পানির করা সমীক্ষা আর পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেও অসংগতি, অস্বচ্ছতা আর প্রতারণার দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে পাতায় পাতায়।

এর আগে এশিয়া এনার্জির পেশ করা ‘খনি উন্নয়ন পরিকল্পনা’ পরীক্ষা করে মতামত দেওয়ার জন্য সরকার বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে।

কমিটি তাদের রিপোর্টে এই প্রকল্প অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও আইনগত বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দেয় (বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬)। পরবর্তী সময়ে পাটোয়ারী কমিটি (২০০৭-০৮) ও মোশাররফ কমিটি (২০১১-১২) ও এই প্রকল্পের বিরুদ্ধেই মত দিয়েছে।

৫.

এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সে সময় জনপ্রতিরোধ সৃষ্টি হয় প্রধানত তিনটি কারণে।

প্রথমত, উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি, যেটি স্পষ্টতই ফসলের ভান্ডার এই অঞ্চলে তিন ফসলি আবাদি জমি নষ্ট করবে, ছয় থানাসহ উত্তরবঙ্গের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নামিয়ে মরুকরণ সৃষ্টি করবে, পানিদূষণ করে সারা দেশের পানিসম্পদকে বিপর্যস্ত করবে এবং সর্বোপরি যাতে খনি এলাকা ও খনি এলাকার বাইরে কয়েক লাখ মানুষ উচ্ছেদ হবেন। আরও কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা হারাবেন।

দ্বিতীয় কারণ ছিল, মালিকানা। এই প্রকল্পের প্রায় পুরো কয়লাখনির মালিকানা পেতে যাচ্ছিল এশিয়া এনার্জি। বাংলাদেশের ভাগে ছিল শুধুমাত্র ছয় ভাগ রয়্যালটি, যার মধ্যে আবার কয়লা বিদেশে রপ্তানির জন্য সুন্দরবন পর্যন্ত রেললাইনসহ অবকাঠামো নির্মাণের খরচও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তৃতীয়ত কারণ ছিল দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজন না মিটিয়ে কয়লা সম্পদ বিদেশে রপ্তানি। যে রপ্তানির আয়ও বাংলাদেশ নয়, মালিকানা অনুযায়ী সেটা পেত এশিয়া এনার্জি। রপ্তানি থেকে তাদের আয় এমনকি দেশের ভেতরে ব্যাংকেও আসবে না—সেভাবেই চুক্তি করা হয়েছিল।

৬.

আবাদি জমি, মাটির ওপরের ও নিচের পানিসম্পদ, বসতভিটা সবকিছু ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু করে, উত্তরবঙ্গকে অনুর্বর বিরান ভূমিতে পরিণত করে, দেশের কয়লা সম্পদ দ্রুত বিদেশে পাচারের এই প্রকল্পই ‘উন্নয়ন’ নামে চালু করার চেষ্টা হয়েছিল।

পুরো প্রকল্পটি ছিল জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্যনিরাপত্তা ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বুকের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মানুষ এ রকম একটি প্রকল্প ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছে।

তারপরও গত ১৯ বছরে বিভিন্ন সরকারের আমলে (বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট, সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং কয়েক পর্বে আওয়ামী লীগ সরকার) বারবার এই প্রকল্প চালু করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু অবিরাম প্রতিরোধে তারা বারবারই পরাজিত হয়েছে।

ওই অঞ্চল থেকে কোম্পানি পালালেও দূর থেকে এখনো চক্রান্ত চালাচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে আন্দোলনের নেতাদের হয়রানি করা, এলাকায় সন্ত্রাস তৈরি, চীনা কোম্পানিকে সঙ্গে নিয়ে জোর বাড়ানোর চেষ্টা—সবই চলছে।

৭.

কোনো বৈধ অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে প্রায় ২০ বছর ধরে। কোনো সরকারই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

গত সরকারের সময় আমদানি ও বিদেশি ঋণ—কোম্পানিনির্ভর কয়লা-পারমাণবিক-এলএনজিকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনার অধীন রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ীসহ অনেক প্রাণবিনাশী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সব তথ্য গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট, দেশের গ্যাস–সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগালে কয়লা বা পারমাণবিকের মতো বিপজ্জনক ব্যয়বহুল পথে বাংলাদেশকে হাঁটতে হয় না।

জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানির সমন্বয়ে যে পথনকশা ‘তেল–গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ থেকে ২০১৭ সালে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সারা দেশে সুলভ, নিরবচ্ছিন্ন, পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ জোগান দিতে সক্ষম।

কিন্তু গত সরকার কম খরচে, পরিবেশবান্ধব নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের এই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ না করে বেশি ব্যয়বহুল, প্রাণবিনাশী, জাতীয় স্বার্থবিরোধী পথেই চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে।

৮.

মনে রাখতে হবে, ফুলবাড়ী আন্দোলন শুধু ওই অঞ্চলের মানুষের জমি আর বসতবাটি রক্ষার আন্দোলন নয়, এটি দেশের পানিসম্পদসহ সব সম্পদ রক্ষার। এসব সম্পদের ওপর সর্বজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। জাতীয় নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন তোলে এই আন্দোলন।

এই আন্দোলন বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি ও তার দেশি সহযোগীদের মুনাফার জন্য দখল লুণ্ঠন ও মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো, পানিসম্পদ, আবাদি জমি, প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধের ঐতিহাসিক চিহ্ন।

এই আন্দোলন মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে নতুন উন্নয়ন দর্শন হাজির করারও জোর তাগিদ দেয়। এই জনপ্রতিরোধ তাই কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের উন্নয়ন পথ নির্দেশ করে।

২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের মধ্যে ‘বৈষম্যহীন প্রাণপ্রকৃতির বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন করতে গেলে এই শিক্ষা মাথায় রাখতে হবে।

  • আনু মুহাম্মদ, সম্পাদক, সর্বজনকথা এবং সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বন্দর-বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্যসচিব।

    *মতামত লেখকের নিজস্ব