ভোটের সাথে ভ্যাটের বিরাট মিল। গুলশানের পাঁচতলার আমির আতর আলির ভোটের যে দাম, গাবতলীর গাছতলার ফকির ক্যাতর আলির ভোটের সেই একই দাম। কোনো উনিশ-বিশ নাই।
আমির আতর আলি শখ করে চকচকে গাড়ি নিয়ে চকবাজার থেকে চকলেট কিনলে তাঁকে যে ভ্যাট দিতে হয়; ফকির ক্যাতর আলি মগ হাতে মগা শরীরে হেঁটে গিয়ে মগবাজার থেকে একই চকলেট কিনলে তাঁকে একই ভ্যাট দিতে হয়। কোনো উনিশ-বিশ নাই। তার মানে, ‘বৈষম্যবিরোধী’ ভ্যাটের চক্ষে আমির-ফকির কোনো ভেদাভেদ নাই।
আতর আলি আর ক্যাতর আলির আরেকটি মিল হলো, আতর আলির একটি প্যাট আছে; ক্যাতর আলিরও একটি প্যাট আছে। এই দুই প্যাটের ধরন এবং ধারণক্ষমতাও এক। কিন্তু দুই প্যাটের খিদের ধরন আলাদা।
কারওয়ান বাজারে হাজারে হাজারে মজুর-মিন্তি, কর্মী-কামলা, মুচি-মেথর, অফিসচারী কর্মচারীর আনাগোনা। টি-স্টল তাঁদের আড্ডাস্থল। একটা রুটি বা বিস্কুট বা কেক; সঙ্গে একটা কলা—এরপর একটা চা। আতর আলিদের কাছে এগুলো ‘অখাদ্য’; বড়জোর ‘খুদে’ খিদের নাশতা। কিন্তু ক্যাতর আলিদের কাছে এই রুটি-বিস্কুটই অনেক সময় ভাতের খিদে মেটানোর জিনিস।
আমাদের দেশে বড় লোকদের বড় করের আওতায় না এনে গরিবের প্যাটে লাথি মারতে ভ্যাটকে রাজস্ব আয়ের বড় হাতিয়ার বানানো হয়েছে
কিন্তু দিন দিন সব ছোট হচ্ছে। পাউরুটির সাইজ হাঁটাহাঁটি করে জামবাটি থেকে নুনের বাটিতে নেমে আসছে। কুট কুট করে চিবানো বিস্কুটের চেহারা লিলিপুটের মতো ঠেকছে। কেকের স্লাইস স্লিম হতে হতে জিরো ফিগারে নেমে আসছে। অফিসের পাশে মোল্লার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে রিকশাচালক সাদেকুল বলছিলেন, ‘সকালে পাউরুটি, কলা আর চা খাই। আগে এতেই মোটামুটি প্যাট ভরত। এহন রুটি-মুটি, কেক ফেক ছুডো হয়া গ্যাছে গা। প্যাট ভরে না। কিন্তুক দাম আগের মতোই দেওয়া লাগে। এহন এই ছোট রুটি-বিস্কুট খায়াই দাঁত কেটকি মাইরা ব্যালা পার করতে অয়।’
শুধু কি রুটি বিস্কুট? অন্য সব খাদ্যপণ্যও একদিকে সাইজে কমছে, অন্যদিকে দামে বাড়ছে। চাল-ডাল-তেল-নুন-মিষ্টির লিস্টি ছোট হয়ে আসছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে যে খবর এসেছে, তা প্রীতিকর না, ভীতিকর। সেখানে দেখা যাচ্ছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে এ বছরও বাংলাদেশ লাল তালিকায় ফাল পাড়ছে।
দিন কয়েক আগে ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্ক নামের একটি গবেষণা সংস্থা একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, মূল্যস্ফীতির চরম চাপে চ্যাপ্টা হচ্ছেন রিকশাচালক, দিনমজুরসহ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। তাদের ভাষ্য, খাদ্যপণ্যে ভ্যাটের বোঝা এর বড় কারণ।
তাদের প্রতিবেদন বলছে, বেদনাদায়কভাবে গরিব মানুষের একটি বড় অংশ এক বেলা ভারী খাবার না খেয়ে রুটি-বিস্কুটে উদরপূর্তি করছেন। এসব খাদ্যে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট চাপানো আছে। এই ভ্যাটে গরিবের প্যাট আরও চুপসে যাচ্ছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ২২ জন লোকের ৯৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা কোনো না কোনো সময় শুধু পয়সার অভাবে খাবার বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। ভাতের বিকল্প সস্তা ও পেট–ভরানো খাবারের মধ্যে বিস্কুট, কলা, পরোটা, ডিম এগিয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার বিস্কুটের ওপরও আছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট।
দুনিয়ার সব দেশে সরকারি পেয়াদা রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত হিসেবে প্রত্যক্ষ করকে বেছে নেয়। যার আয়ের অঙ্ক যত বড়, তার আয়কর তত বেশি। কিন্তু আমাদের দেশে বড় লোকদের বড় করের আওতায় না এনে গরিবের প্যাটে লাথি মারতে ভ্যাটকে রাজস্ব আয়ের বড় হাতিয়ার বানানো হয়েছে। নিত্যখাদ্যে বসানো ভ্যাট আতর আলিদের প্যাটের মখমলের ম্যাটের মতো মসৃণ ফ্যাটকে আরও খোলতাই করছে। সেই একই ভ্যাট ক্যাতর আলিদের প্যাটে পাড়া দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করছে।
গেল জানুয়ারিতে রুটি বিস্কুটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছিল সরকার। এসব পণ্যে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে এক লাফে ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এরপর সমালোচনার মুখে সেই ভ্যাট ১৫ শতাংশের বদলে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়। গত রমজান মাসে নিত্যপণ্য বিবেচনায় নিয়ে এক মাসের জন্য এসব খাদ্যপণ্যে কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল। রমজান চলে যাওয়ার পর আবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল করা হয়।
এর মধ্য দিয়ে সরকার আমাদের যে দরকারি শিক্ষাটা দিলেন, তা হলো শুধু রমজান মাসে এই খাদ্যপণ্যগুলো ‘নিত্যপ্রয়োজনীয়’ থাকে। বাকি মাসগুলোতে সেগুলো হয় ‘নিত্য-অপ্রয়োজনীয়’ পণ্য। সামনে নতুন সরকারের নতুন বাজেট। এই বাজেটে গরিব মানুষ সহানুভূতি চায় না; ন্যায্যতা চায়।
ক্যাতর আলিদের জন্য কর কমানো, ভর্তুকি ও সহায়তা বাড়ানো এবং আতর আলিদের কর বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সেই ন্যায্যতা আনা যায়। অন্তত নিত্যখাদ্যপণ্যে কর–ভ্যাট না চাপিয়ে ক্যাতর আলিদের প্যাটের পীড়ন কিছুটা কমানো যায়।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com