মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে নিহত হন আবুল কালাম। হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে নিহত হন আবুল কালাম। হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি

মতামত

উন্নয়নের বয়ান ও মেগা প্রকল্পের রাজনীতি

বিগত দশকজুড়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়েছে, মেগা প্রকল্প ছিল সেই বয়ান তৈরির প্রধান হাতিয়ার। মেগা প্রকল্পের আড়ালে বাংলাদেশের যে উন্নয়নের বয়ান তৈরি করা হয়েছে, সেটি না মেটাতে পেরেছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, না অর্জন করতে পেরেছে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশা।

বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের মেগা প্রকল্পের বয়ানের প্রতি পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল দুর্নীতি এবং শোষণমূলক প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কত যে দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাধর ব্যক্তি দেশের মুনাফা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বিভিন্ন দেশের উন্নত শহরগুলোতে, তার ইয়ত্তা নেই।

এর সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর চটুল বুলি; কিন্তু আফসোসের বিষয়, কেউ বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটি সমৃদ্ধিশালী এবং উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন আমাদের দেখাতে পারেননি।

একটি উন্নত বাংলাদেশের চেহারা কেমন হতে পারে, সেই আকাঙ্ক্ষা আমাদের সাধারণ মানুষের চিন্তায় তাঁরা নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে উন্নয়নের অভিজ্ঞতা সারা বাংলাদেশের আপামর জনগণ অনুভব করতে পারবেন এবং তার ইতিবাচক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তাঁরা উন্নয়নকে বুঝতে পারবেন, সেই উন্নয়নের ধারণা ও আকাঙ্ক্ষা বিগত সময়ে আমরা তৈরি করতে পারিনি।

বিগত সময়ে তথাকথিত উন্নয়নের বয়ান কী করে বাংলাদেশের মানুষকে একটি মেকি ও ফাঁপা উন্নয়নের বাবলের মধ্যে রেখে গেছে, সেটি আমরা এখন বুঝতে পারি। এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে আরও বেশি অনুন্নয়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কেননা, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দুর্নীতির এক বিশাল বাণিজ্য, যে কারণে মেগা প্রকল্প, রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ও তাঁদের সুবিধাভোগী শ্রেণির কাছে একটি লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বিষয়ও।

এ প্রসঙ্গে আমরা বিখ্যাত নয়া মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের ‘অনুন্নয়নের উন্নয়নের’ (ডেভেলপমেন্ট অব আন্ডারডেভেলপমেন্ট) ধারণা নিয়ে আসতে পারি। নয়া ঔপনিবেশিক পরিসরে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করার জন্য ব্যবহৃত হলেও বিগত সময়ে তথাকথিত উন্নয়নের বয়ান কী করে বাংলাদেশের মানুষকে একটি মেকি ও ফাঁপা উন্নয়নের বাবলের মধ্যে রেখেছে, সেটিও এই ধারণা দিয়ে বুঝতে পারি।

এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে আরও বেশি অনুন্নয়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কেননা, এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দুর্নীতির এক বিশাল বাণিজ্য, যে কারণে মেগা প্রকল্প, রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ও তাঁদের সুবিধাভোগী শ্রেণির কাছে একটি লোভনীয় ও আকর্ষণীয় বিষয়ও।

এভাবে যে উন্নয়নের বয়ান তৈরি করা হয়েছে, তা কেবল একটি সুবিধাভোগী শ্রেণিরই ইচ্ছা পূরণ করত, আর তারাই ছিল সেই উন্নয়নের ভোগী। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় সেই উন্নয়ন। তেমন উন্নয়নের চাপে পড়ে কী করে আমাদের দেশের মানুষকে আরও বেশি অনুন্নত একটি ব্যবস্থার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে, যা আদতে আমাদের একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে দিয়েছে, সেটিকে বিশ্লেষণ করার জন্য ফ্রাংকের ‘অনুন্নয়নের উন্নয়নের’ ধারণা একটি চমৎকার সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উন্নয়ন হলো একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আর মেগা প্রকল্পগুলো সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একটি দীর্ঘস্থায়ী রূপ দেওয়ার বয়ান তৈরির যন্ত্র। তাই শহরজুড়ে বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যা একটি রাজনৈতিক দলের উন্নয়নের নিজস্ব বয়ান তৈরির মাধ্যম হয়ে পড়ে।

বিগত আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করেছি। একজন সাধারণ নাগরিকের দ্বারপ্রান্তে তথাকথিত সেই উন্নয়নের স্বাদ পৌঁছায় না; বরং দুর্নীতি ও যথাযথ মান নিশ্চিত না করার জন্য অনেক প্রকল্প হয়ে পড়ছে মৃত্যুফাঁদ। সাম্প্রতিক মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে পথচারীর মৃত্যু কিংবা কয়েক বছর আগে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনাসহ অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মেগা প্রকল্প নানা ঝুঁকি তৈরি করছে।

আমরা আর সেই মেগা প্রকল্পের উন্নয়নের বয়ান শুনতে চাই না, যা কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য হাতে নেওয়া হয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিবেদন থাকবে তারা যেন তাদের ইশতেহারে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প যা সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বাস্তবিক অর্থে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে, সেই ধরনের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এর সঙ্গে আমাদের সীমাহীন দুর্নীতির যে চর্চা এবং উদাহরণ আমরা গড়ে তুলেছি, তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।

রাজনৈতিক ব্যক্তিবিশেষের স্বপ্ন বাস্তবায়নই যেন আমাদের উন্নয়নের মডেল না হয়। উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা যেন দলমত–নির্বিশেষে একই থাকে, সেদিকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে নজর দিতে হবে।

আমরা জানি যে একেকটি রাজনৈতিক দলের ইশতেহার একেক রকম হবে, যা দিয়ে তারা জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার দৌড়ে নিজেদের এগিয়ে নিতে চাইবে, যা সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক। কিন্তু দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের কিছু বিষয়ে একমত থাকতে হবে। যার মধ্য দিয়ে আমাদের সর্বজনীন উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবে। যে আকাঙ্ক্ষা কখনোই হারিয়ে যাবে না; বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার পালাবদল হলেও সেই মহাপরিকল্পনা রয়ে যাবে।

একটু সুখী, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যাকে আমরা ‘বাংলাদেশি ড্রিম’ বা ‘বাংলাদেশি স্বপ্ন’ বলতে পারি। বাংলাদেশকে আমাদের বাংলাদেশই বানাতে হবে, সিঙ্গাপুর কিংবা হংকং নয়।

সামনে নির্বাচন, এই নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিপুল উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। আমরা আশা রাখব, এই উদ্দীপনা যেন তাদের মধ্যে গবেষণাভিত্তিক ইশতেহার তৈরির একটি প্রচেষ্টায়ও থাকে।

একটি জ্ঞানভিত্তিক মহাপরিকল্পনার রূপরেখা যদি কোনো দল আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারে, তাহলে জনগণও কিছুটা হলে আশ্বস্ত হবে। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের একটি দীর্ঘ আস্থাহীনতা গড়ে উঠেছে শোষণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। তাই জনগণকে আশ্বস্ত করার একমাত্র উপায় হলো বাস্তব ও গণমুখী উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি।

এর সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে স্থানীয় জনগণের চাহিদাভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন। সেদিক দিয়ে কম বিনিয়োগে অধিক সুফল নিয়ে আসে তেমন খাত খুঁজে বের করে অধিক সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি করাই হতে হবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনীতি হতে হবে উন্নয়নকেন্দ্রিক, উন্নয়নকে ঘিরে রাজনীতি নয়, তবেই দেশের ইতিবাচক বদল আসবে।

এ বিষয়ে অন্য দলগুলো কতটা এগিয়েছে, সেটি বোঝা না গেলেও বিএনপি যে গবেষণাভিত্তিক পলিসি নির্মাণের দিকে যাচ্ছে, সেটি বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন সময় ভবিষ্যতের উন্নয়নের যে ব্যাখ্যা তুলে ধরছেন, সেখানে মেগা প্রকল্পের চেয়ে গণমুখী উন্নয়নের রূপরেখা অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। এর সঙ্গে উন্নয়নকে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হিসেবে আমাদের দেখতে হবে এবং ধীরে ধীরে উন্নয়নের সেই মেগা ধাপে যেতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়নের মডেলের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, তারা উন্নয়ন ও সংস্কারকে একটি চলমান প্রক্রিয়া বিবেচনা করে দেশকে সাফল্যজনক জায়গায় নিয়ে গেছে। এসব শিক্ষা নিয়ে উন্নয়নের একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে হবে। আমরা দেখেছি, কীভাবে পশ্চিমা উন্নয়ন মডেল আমাদের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশপ্রেমের উদ্যম নিয়ে উন্নয়নের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে যে উন্নয়ন যেন কেবল মেগা প্রকল্পকেন্দ্রিক না হয়; বরং উন্নয়ন হোক জনগণকেন্দ্রিক, জনগণের স্বার্থ ও চাহিদাকেন্দ্রিক। আমাদের উন্নয়নের বয়ান যেন হয় একটি বাংলাদেশি স্বপ্নের বাস্তবায়নের বয়ান।    

  • বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • মতামত লেখকের নিজস্ব