মতামত

এ কোন নুর? একে তো আমরা চিনি না

নুরুল হক নুর
ছবি: সংগৃহীত

তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসে দেখা যায়, ‘চোর-ডাকাতের বংশের ছেলে’ নিতাইচরণ আচমকা ‘কবি হইয়া গেল’। লেখকের ভাষায় ‘এ দস্তুরমতো বিস্ময়কর ঘটনা’।

নিতাইচরণের সঙ্গে নুরুল হক নুরের অমিল হলো, তিনি নিতাইয়ের হঠাৎ কবি হওয়ার মতো আচমকা নেতা হননি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে কমপক্ষে ২০ বার ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে; পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে, আবার পড়ে আবার দাঁড়িয়ে একটা ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতা হয়েছেন। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

নেতা নুরের আত্মপ্রকাশের মধ্যে নিতাইয়ের রাতারাতি কবি হওয়ার মতো ততটা আকস্মিকতা ছিল না—এটি ঠিক। কিন্তু নুর যে কায়দায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন, তা নিতাইয়ের ফট করে কবি হয়ে ওঠার মতোই ‘দস্তুরমতো বিস্ময়কর ঘটনা’।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় নুরুল হকের ডাকসুর ভিপি হওয়া; একপর্যায়ে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামের রাজনৈতিক দল গঠন এবং সম্প্রতি আর্থিক অস্বচ্ছতা ও ‘ইসরায়েলি এজেন্টের’ সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগে বিতর্কের মুখে পড়া বিস্ময়করই বটে।

প্রশ্ন হলো, পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা নুরুল হকের ওপর শিক্ষিত তরুণসমাজের একটি অংশ কেন এত ভরসা করল? তাঁর মধ্যে কী এমন জাদু ছিল যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তাঁর কথায় সরকারের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অসংখ্য তরুণ রাস্তায় আন্দোলন করছিল? তাঁর মধ্যে কী এমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আভাস উদ্ভাসিত হয়েছিল যে গণ অধিকার পরিষদ একটি আলোচিত উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াচ্ছিল? ইসরায়েলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগ ওঠার আগপর্যন্ত ফেসবুকে পোস্ট করা নুরুল হকের বক্তব্যের মন্তব্যের ঘরে হাজারো তরুণ কেন ‘এগিয়ে যান ভাই, পাশে আছি’ বলে সমর্থন জানাচ্ছিল?

‘আন্দোলনের মাঠে নুরের গায়ে প্রথম দিকে সাধারণ জামা দেখা যেত।’

নুর কি কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে অকাতরে টাকা ছড়ানোর ক্ষমতা রাখা বিত্তবান পরিবারের সন্তান? তাঁর কি সবাইকে আকর্ষণ করার মতো ‘নেতাসুলভ’ অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব আর বিশুদ্ধ শব্দচয়নশোভিত প্রমিত উচ্চারণের বক্তৃতা ছুড়ে দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা আছে?

না, এর কোনোটাই নুরের মধ্যে নেই। তিনি কোটিপতির সন্তান নন। তিনি পটুয়াখালীর গলাচিপার কৃষক মো. ইদ্রিস হাওলাদারে ছেলে। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

খবরের কাগজের প্রতিবেদন বলছে, নুর যখন ২০১৯ সালে ডাকসুর ভিপি হন, তখনো এত বড় সংসারের ঘানি টানতে তাঁর বাবা কৃষিকাজ করার পাশাপাশি উপজেলার চর বিশ্বাস ইউনিয়নের একটি বাজারে চায়ের দোকান চালাতেন। মূলত এ দোকানের আয় দিয়েই তিনি সংসার চালাতেন। তাঁর দুই ভাই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ছোটখাটো ব্যবসা করতেন (গণ অধিকার পরিষদের একজন নেতা ফেসবুক লাইভে বলেছেন, তাঁরা কলা বিক্রি করতেন)।

নুরের চেহারায় আভিজাত্যসঞ্জাত স্নেহজাতীয় লাবণ্য গলে গলে পড়ে না। এ দেশের খেটে খাওয়া মেদহীন মানুষের আটপৌরে চেহারা তাঁর। সেই চেহারায় ধনীর দুলালের মতো বড়লোকি লালিত্য নেই।

নুরের বক্তব্যে ‘টাইপ করা’ শহুরে ভাষার তথাকথিত সুললিত ব্যঞ্জনা নেই। নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনা করলেও কখনোই বক্তব্যের মধ্যে মধ্যে ইংরেজি শব্দের বুগনি গুঁজে দেননি। বক্তব্য দেওয়ার সময় অনেক প্রমিত শব্দও তাঁর ‘বরিশাইল্যা’ উচ্চারণের কারণে ‘খ্যাতমার্কা’ আঞ্চলিকতার ব্যঞ্জনা পায়। তবে তাঁর সেই আঞ্চলিকতাবিশিষ্ট ভাষণের মধ্যে এমন একধরনের অনমনীয়তা ছিল, যাকে সরল সোজা মানুষের একরোখামি বলা যেতে পারে। দৃশ্যত উপরচালাকিহীন সেই নুরকেই বঞ্চিত দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত তরুণেরা ‘আমাদের লোক’ এবং সেই অশুদ্ধ উচ্চারণঋদ্ধ ভাষণকেই ‘আমার কথা’ মনে করেছিল।

আন্দোলনের মাঠে নুরের গায়ে প্রথম দিকে সাধারণ জামা দেখা যেত। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর সেই জামার জায়গায় আটপৌরে দ্যোতনাহীন সাধারণ সুতির পাঞ্জাবি দেখা গেল। একই পাঞ্জাবি গায়ে তাঁকে অনেক দিন দেখা যেত।

অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণেরা যে নুরুল হককে নেতা হিসেবে সমীহ করেছে, ভালোবেসেছে, বিশ্বাস করেছে; সেই নুরুল হক একজন দরিদ্র কৃষকের সন্তান, সেই নুরুল হকের চেহারা-ছবিতে বাবুয়ানা মার্কা মাখোমাখো লালটু ভাব নেই, সেই নুরুল হকের শরীরী ভঙ্গিমায় সরকারবিরোধী দৃঢ় দ্রোহ থাকলেও সহযোদ্ধাদের প্রতি ঔদ্ধত্য নেই; সেই নুরুল হকের পোশাক–পরিচ্ছদে কোনো ব্যয়বহুল আভিজাত্যের ফোড়ন নেই।

‘পোশাকে-চেহারায় তাঁকে এখন আর আগের মতো খেটে খাওয়া মানুষের কাছের মানুষ মনে হয় না।’

নুরুল হকের পরিপার্শ্বকে ঘিরে রাখা উপরচালাকিহীন সারল্যমাখা ‘গরিবি গন্ধ’ তারুণ্যের ভালোবাসায় একটা প্রবল আকর্ষক মধুর সৌরভে পরিণত হয়েছিল। সেই সৌরভের টানে দেশে নতুন ধারার রাজনীতির যাত্রা শুরু করতে চাওয়া নতুন প্রজন্ম ছুটে এসেছিল। বিশেষ করে গ্রাম ও মফস্‌সল শহরের তরুণেরা নুরের আর্থিক অবস্থা, তাঁর চেহারা, তাঁর পোশাক, তাঁর কথা বলার ধরনের মধ্যে নিজের শ্রেণির প্রতিনিধিকে খুঁজে পেয়েছিল। নুরুল হক সত্যিকারের গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের একটি অঘোষিত আশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন।

তবে ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’—এই থিওরি মেনে নুরুল হকের মধ্যে বিবর্তন দেখা গেছে। সোজাসাপ্টা ভাষায় ‘গোঁয়ারের’ মতো দরাজ গলায় প্রতিবাদমুখর দাবি তোলা আন্দোলনকর্মী থেকে মেপে মেপে অতি সতর্কতাপূর্ণ চালাকির সঙ্গে কথা বলতে শিখে যাওয়া রাজনীতিক হয়ে উঠেছেন তিনি।

সম্প্রতি নুরুল হকের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের দলের মধ্য থেকে যতগুলো অভিযোগ উঠেছে, তার মধ্যে প্রধান অভিযোগ হলো দুটি। একটি হলো দলের জন্য চাঁদা হিসেবে তোলা অর্থের বিশ্বাসযোগ্য হিসাব তিনি দিচ্ছেন না। আরেকটি হলো ইসরায়েলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তিনি গোপনে বৈঠক করেছেন। দুটি অভিযোগই নুরুল হক সরাসরি অস্বীকার করেছেন।

জগতের অন্যতম ধ্রুব সত্য হলো, যিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছ নন, মোটাদাগে তিনি মানুষ হিসেবেও সরল নন। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠামাত্রই নুরুল হকের পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে তিনি গতানুগতিক রাজনীতিকদের মতোই ‘বাঁয় বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে’ খুব সতর্কভাবে জবাব দিচ্ছেন। সোজা কথায় জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে সঞ্চালক নুরুল হককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘জনাব নুর, আপনার পেশা কী? আপনার আয়ের উৎস কী?’

জবাবে নুর বলেন, ‘আপনি একজন লোকাল প্রতিনিধি পাঠিয়ে জানবেন, আমার বাবার কতটুকু কৃষিজমি আছে। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলি। আমরা তিন ভাই। আমার দুই ভাই কিন্তু পেশাজীবী। তারা কিন্তু উত্তরাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। বিভিন্ন কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আমার ওয়াইফ একজন প্রাইমারি শিক্ষক। সেখান থেকে সাপোর্ট পাই। আমার যারা শুভাকাঙ্ক্ষী, যারা চায় আমি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাই, সে জন্য তারাও আমাকে সব ধরনের সহযোগিতা করে।...ফেসবুক থেকে আমার মাসে অন্তত এক–দেড় লাখ টাকা আর্নিং হয়। দেখবেন, আমার মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউয়ার...সেখান থেকে একটা পরিমাণে ডলার ইনকাম হয়।’

নুরুল হক বলেন, ‘আমার মাছের প্রজেক্ট আছে। অ্যাগ্রিকালচার থেকে আমার আর্নিং হয়। ধানের সিজনে ধান, ডালের সিজনে ডাল... মাছের সিজনে মাছ।’

অর্থাৎ নুরুল হক বাংলাদেশের বাস্তবতায় বর্তমানে একজন বেশ সচ্ছল মানুষ। তিনি একা সচ্ছল নন। তাঁর পুরো পরিবার বেশ সচ্ছল হয়ে উঠেছে। এই সচ্ছলতা এসেছে গত দুই থেকে আড়াই বছরে।

প্রথম আলোর পটুয়াখালী প্রতিনিধি, নুরুল হকের এলাকা চরবিশ্বাসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, দুই বছর আগে নুরুল হকের বাবা গ্রামে যে দোকানটি চালাতেন, সে দোকান তিনি এখন আর চালান না। দোকানটি তাঁরা ভাড়া দিয়েছেন। নুর যখন ডাকসুর ভিপি হন, তখন তাঁদের মাটির মেঝের টিনের ঘর ছিল, এখন সেখানে একটি বিল্ডিং উঠেছে। নুরুল হকের দুই ভাই ছোট্ট দোকান চালাতেন, এখন তাঁরা বেশ বড় ব্যবসায়ী।

জীবনযাপনের ধরনে, পোশাক-আশাকে, আচার-আচরণে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এনে তিনি নিজের গায়ের সেই গৌরবময় ‘গরিবি গন্ধ’ মুছে ফেলতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ক্রমেই তিনি ‘অভিজাত’ হয়ে উঠতে চাইছেন। ভাগ্য খুলছে। তাঁর চেহারায়-পোশাকে পরিবর্তন আসছে। তাঁর ভাই-বোন-ভগ্নিপতি-শ্যালকদেরও ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি বদলাচ্ছেন আর দলের কর্মী-সমর্থকেরা মনে মনে বলছেন, ‘এ কোন নুর? একে তো আমরা চিনি না।’

নুরুল হকের মাছের খামার আছে কি না জানতে চাইলে এলাকা চরবিশ্বাসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, তাঁর জানামতে মাছের খামারটি নুরুল হকের শ্যালক দেখাশোনা করেন। সেটি নুরুল হকের কি না, তা তিনি জানেন না।

গণ অধিকার পরিষদের একজন প্রথম সারির নেতা বলেছেন, যে গাড়িটি নুরুল হক ব্যবহার করেন, সেটির মালিক তাঁর (নুরুল হকের) একজন আত্মীয় বলে প্রথম দিকে নুরুল হক দাবি করেছিলেন। পরে তিনি স্বীকার করেছেন, ২০২১ সালে গাড়িটি তিনি কিস্তিতে ২৬ লাখ টাকায় কিনেছেন।

আমাদের মনে থাকার কথা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার যখন প্রতিদিন নতুন নতুন ডিজাইনের দামি দামি পাঞ্জাবি পরে বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছিলেন, তখন এসব পাঞ্জাবির উৎস কী বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। এই গুঞ্জন অতি স্বাভাবিক। কারণ, তখন গণজাগরণ মঞ্চ যে চেতনার কথা বারবার বলছিল, তার সঙ্গে ইমরান এইচ সরকারের নিত্যনতুন পাঞ্জাবি প্রদর্শন মিল খাচ্ছিল না।

ঠিক একইভাবে নুরুল হক নুরের বেশভূষা ও শারীরিক ভাষায় একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। সম্প্রতি তাঁকে যে ফ্যাশনদুরস্ত এবং দামি পরিচ্ছদে দেখা যাচ্ছে, তা তাঁকে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ধীরে ধীরে অচেনা করে তুলছে। পোশাকে-চেহারায় তাঁকে এখন আর আগের মতো খেটে খাওয়া মানুষের কাছের মানুষ মনে হয় না।

খেয়াল করতে হবে, নুরুল হক তাঁর উপার্জনের যে উৎসগুলোর কথা বলেছেন, তার জন্য একটা প্রাথমিক পুঁজির দরকার হয়। রাজধানীতে কোনো কোম্পানির ডিলারশিপ নিতে জামানত হিসেবে যে অর্থের প্রয়োজন, তা আচমকা জোগাড় করা কঠিন। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা বলছে, সেই পুঁজি জোগাড় মাত্র দুই বছরের মধ্যে। নুরুল হকের বিরুদ্ধে অর্থসংক্রান্ত যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তার সময়কালের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে এই সময়কাল মিলে যাচ্ছে।

নুরুল হক বলেছেন, ফেসবুক থেকে তাঁর মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয়। খেয়াল করুন, কোনো অভিনেতা, গায়ক বা পারফরমার হিসেবে নুরুল হকের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করা হয় না।

তিনি একটি দলের মুখপাত্র হিসেবে যে বক্তব্য দেন, রাজনীতিসচেতন মানুষ সেই বক্তব্যের ভিডিও দেখেন। এখানে তাঁরা ব্যক্তি নুরুল হককে দেখেন না, দেখেন গণ অধিকার পরিষদের মুখপাত্র নুরুল হককে। সুতরাং এই ফেসবুক পেজ থেকে যে অর্থ আসে, নৈতিকভাবে সেই অর্থের একক দাবিদার নুরুল হক হতে পারেন না। আইনগত দিক থেকে এই অর্থের দাবিদার নুরুল হক হলেও নৈতিক জায়গা থেকে এর প্রকৃত হকদার গণ অধিকার পরিষদ। কারণ, কর্মীদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক প্রভাব গণ অধিকার পরিষদ অর্জন করছে, তার সুফল শুধু নুরুল হক ভোগ করবেন, সেটি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

আসলে নুরুল হক তাঁর অর্থের উৎসের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে আমাদের প্রথাগত দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও রাজনীতিকদের ব্যাখ্যার মধ্যে মৌলিক কোনো তফাত দেখা যাচ্ছে না। প্রায়ই আমরা প্রভাবশালী আমলা ও রাজনীতিকদের ভাই, ভাগ্নে, শ্যালকদের আচমকা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে মাছের খামার করার প্রবণতা খুবই সাধারণ।  

মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করার অভিযোগ সম্পর্কে আত্মপক্ষ সমর্থনে নুরুল হক বলেছেন, প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতাদের অনেকেই তো সাফাদির সঙ্গে দেখা করেছেন, তা নিয়ে তো মিডিয়ায় হইচই নেই, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে কেন এত হইচই হচ্ছে? তিনি বলেছেন, যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, তিনি সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাহলে তাতে অসুবিধা কোথায়?

নুরুল হক মূল অসুবিধাটাই ধরতে পারছেন না। অন্য রাজনীতিকদের থেকে তাঁকে যে তাঁর সমর্থকেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের নেতা হিসেবে জেনে এসেছেন এবং তাঁর কাছে যে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আশা করে এসেছেন, এটিই তিনি ধরতে পারছেন না। এই না পারার কারণে তিনি ক্রমেই কর্মী-সমর্থকদের কাছে অচেনা হয়ে উঠছেন। আমাদের চারপাশের সাধারণ রাজনীতিক বা আমলাদের কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তাঁরা সাধারণত দুর্নীতি বা অনিয়মের সোজাসাপ্টা জবাব দেন না। লুকোচুরিমার্কা কিছু কথাবার্তা বলে মুখস্থ গৎ বাজিয়ে দেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চক্রান্ত করছে।’ নুরুল হক সেই একই সুরে কথা বলছেন।  

জীবনযাপনের ধরনে, পোশাক-আশাকে, আচার-আচরণে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এনে তিনি নিজের গায়ের সেই গৌরবময় ‘গরিবি গন্ধ’ মুছে ফেলতে চাইছেন বলে মনে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ক্রমেই তিনি ‘অভিজাত’ হয়ে উঠতে চাইছেন। ভাগ্য খুলছে। তাঁর চেহারায়-পোশাকে পরিবর্তন আসছে। তাঁর ভাই-বোন-ভগ্নিপতি-শ্যালকদেরও ভাগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি বদলাচ্ছেন আর দলের কর্মী-সমর্থকেরা মনে মনে বলছেন, ‘এ কোন নুর? একে তো আমরা চিনি না।’

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই–মেইল: sarfuddin2003@gmail. com