ডোনাল্ড ট্রাম্প ও টনি ব্লেয়ার
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও টনি ব্লেয়ার

মতামত

গাজা শাসনে ব্লেয়ারের কেন এত আগ্রহ

গত ২৯ সেপ্টেম্বর গাজায় শান্তি ফেরাতে হোয়াইট হাউস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা পেশ করেছে, যেখানে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে পরিচয় করানো হয়েছে ‘শান্তি পরিষদ’–এর সদস্য; যেই পরিষদ গাজা যুদ্ধ–পরবর্তী ফিলিস্তিনি কারিগরি কমিটির তত্ত্বাবধান করবে।

কিন্তু ঠিক তার আগের দিন ইসরায়েলের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হারেৎজ ‘গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথরিটি’ (জিআইটিএ)-এর পরিকল্পনা নথি প্রকাশ করে দেয়।

জিআইটিএর ২১ পৃষ্ঠার এই ‘গোপন’ পরিকল্পনা, যা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, হারেৎজ জানায় যে ইসরায়েলের সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে, তা টনি ব্লেয়ারের মাধ্যমে প্রস্তাবিত।

ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, জিআইটিএ জাতিসংঘের পাঁচ বছরের ম্যান্ডেটে ‘সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও আইনি কর্তৃত্ব’ হিসেবে কাজ করবে, যা আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাটদের দিয়ে পরিচালিত হবে।

ব্লেয়ার ২৫ জনের একটি সচিব দল এবং ৭ জনের বোর্ড মেম্বারের মাধ্যমে গাজার বাইরে থেকে তত্ত্বাবধান পরিচালনা করবেন। গাজার বাইরে মানে প্রাথমিকভাবে মিসরের এল-আরিশ থেকে পরিচালিত হবে, পরে গাজায় স্থানান্তরিত হবে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে আরব বহুজাতিক বাহিনী।

নিউ আরবের কলামিস্ট জো ম্যাকরনের মতে, ‘আমেরিকা-ইসরায়েল সমর্থিত এই পরিকল্পনা এক তিক্ত পরিহাস এবং ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজ ভূমিতে প্রান্তিক করে দেওয়ার একটি ছক।’ তিনি লেখেন, ‘এই পরিকল্পনায় সন্দেহ জাগা শুরু হয় তখন থেকে, যখন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী ১০ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ী সামির খালিলাকে গ্রেপ্তার করে, যিনি আমেরিকার সমর্থনে গাজার ট্রানজিশনাল গভর্নর হিসেবে প্রস্তাবিত ছিলেন।’

ব্লেয়ার গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন, তা ইতিমধ্যে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তাঁর ‘গাজা আন্তর্জাতিক স্থানান্তর কর্তৃপক্ষ’ (জিআইটিএ) নামের এই পরিকল্পনা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় একটি বিদেশি-নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা গড়তে চায়।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের একটি পুনরাবৃত্তি—যেখানে ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ দমিয়ে বিদেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠেছে গত দুই বছরে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর এই পরিকল্পনা কি শান্তি আনবে, নাকি গাজাকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেবে?

কীভাবে শাসন চালাবেন ব্লেয়ার

জিআইটিএ পরিকল্পনা একটি জটিল শাসনকাঠামো, যার আইনি ভিত্তি নেওয়া হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ছাড়পত্রের মাধ্যমে। এটি গাজার রাজনীতি, আইন ও নিরাপত্তার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ নেবে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের হাতে থাকবে নামমাত্র ক্ষমতা।

হারেৎজের ফাঁস হওয়া দলিল অনুযায়ী, শীর্ষে থাকবে ৭ থেকে ১০ জনের একটি আন্তর্জাতিক বোর্ড, যার নেতৃত্ব দেবেন ব্লেয়ার নিজে। এই বোর্ডে প্রাধান্য থাকবে ব্যবসায়ীদের। ইতিমধ্যে যে ৪ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, যাঁদের কেউই ফিলিস্তিনি নন। তাঁরা হলেন:
১. জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সমন্বয়কারী সিগ্রিড কাগ, যিনি নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আফগানিস্তানে ইসলামিক এমিরেত (তালেবান) ক্ষমতা দখল করার পরে ডাচ বাহিনীর সঙ্গে যেসব আফগান কাজ করেছেন, তাদের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে ফেলে এসেছেন তিনি এবং এই অভিযোগে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁকে বলা হয় এই প্রস্তাবিত সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে কম বিতর্কিত।
২. অ্যাপোলো গ্লোবাল ম্যানেজমেন্টের প্রধান আমেরিকান ইহুদি ব্যবসায়ী মার্ক রোয়ান; যিনি নিজেকে ইসরায়েলের গর্বিত সমর্থক বলেন। গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনকে ‘ন্যায্য যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
৩. মিসরীয় ধনকুবের নাগুইব সাওয়িরিস, টেলিযোগাযোগ ও স্বর্ণের ব্যবসা থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছেন তিনি। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক।
৪. ইহুদি ধর্মীয় নেতা আরিয়ে লাইটস্টোন; যিনি বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) সঙ্গে জড়িত। এই সংস্থায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন; যাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস।

হারেৎজের প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, তিনি হোয়াইট হাউসের সঙ্গে মিলে গাজার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কাজ করছেন। একই সঙ্গে তিনি আব্রাহাম অ্যাকর্ডস পিস ইনস্টিটিউটের প্রধান, যা ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি সম্পন্ন করেছে।

মুসলিম বিশ্ব থেকে মনোনীত সদস্যরাও থাকবেন, তবে তাঁরা থাকবেন আঞ্চলিক সমর্থনের জন্য এবং তাঁদের ব্যবসায়িক পটভূমিই বেশি গুরুত্ব পাবে। ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি ‘অন্তত একজন’ থাকবে বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু কারও নাম প্রস্তাব করা হয়নি।

নথিতে বলা হয়, এই বোর্ডের নির্দেশে একটি নির্বাহী সচিবালয় দৈনন্দিন প্রশাসন চালাবে, যার অধীনে থাকবে ফিলিস্তিনি নির্বাহী কর্তৃপক্ষ (পিইএ)। এই কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশের মতো স্থানীয় সেবা দেবে, কিন্তু তাদের প্রধান হবেন বোর্ডের নির্ধারিত ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তি (কে? উল্লেখ নেই)। মানবিক সাহায্য, পুনর্গঠন, আইন ও নিরাপত্তার বিষয়ে বিদেশি কমিশনাররা নজর রাখবেন।

নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠিত হবে, যেখানে ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ থেকে সেনা আনার কথা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে ২০ হাজার সৈন্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এবারে জাতিসংঘের অধিবেশনে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি প্রাবোও সুবিয়ান্তো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ারও আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার কথা তুলে ধরেছেন, এমনকি তিনি তাঁর বক্তৃতা শেষ করেছেন হিব্রু সম্ভাষণ ‘শ্যালোম’ বলে, যার অর্থ শান্তি।

গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। হামলার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

ব্লেয়ারের প্রস্তাবিত নথিতে গাজা বিনিয়োগ প্রচার কর্তৃপক্ষ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়বে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘রিভিয়েরা’ পরিকল্পনারই আরেক রূপ, অর্থাৎ, গাজাকে রিসোর্ট আর বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরের স্বপ্ন এখনো পরিত্যাগ করেননি ট্রাম্প।
বিস্ময়ের কথা হলো, এই শাসন কার্যক্রম গাজায় বসে হবে না, বরং প্রথম বছরে এই শাসন চলবে মিসরের সিনাই উপদ্বীপের এল-আরিশ থেকে, কায়রো বা আম্মানের সমর্থনে। এল-আরিশ গাজার সীমান্তের কাছে একটি মিসরীয় শহর, যেখান থেকে ইসরায়েল ও মিসরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।

বাজেট শুরু হবে ৯০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে, তৃতীয় বছরে পৌঁছাবে ১৬৪ মিলিয়ন ডলারে—এটি শুধু পরিচালনার খরচ, পুনর্গঠন বা মানবিক সাহায্যের খরচ এর বাইরে। পরিকল্পনা ধাপে ধাপে চলবে। কিন্তু এই অর্থের জোগান কে দেবে, কতটুকু দেবে, কখন দেবে, না দিলে কী হবে, তা বিস্তারিত নেই।

সবার শেষে রয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা। কবে? সেটা অস্পষ্ট। যদিও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু স্পষ্ট বলেছেন, তিনি চান না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ অথবা হামাস কারও হাতে গাজার ক্ষমতা থাকুক। ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায়ও বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) সংস্কারের পরে তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, কিন্তু কবে সেটা, তা বলা হয়নি।

কেন গাজা শাসনে এত আগ্রহ ব্লেয়ারের

বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্লেয়ারের এই পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে তাঁর ইসরায়েলপন্থী অতীত আর ব্যক্তিগত স্বার্থ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসে তিনি বেলফোর ঘোষণার (১৯১৭) ধারাবাহিকতা বহন করেন, যা ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল। এরপর আসে ১৯৪৮-এর নাকবা এবং গাজার দীর্ঘ দুর্ভোগের সূচনা।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ব্লেয়ার অসলো চুক্তিতে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি এহুদ বারাক ও ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বটে, কিন্তু ইসরায়েলি বসতি বন্ধ করতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং ২০০৭-২০১৫ সালে কোয়ার্টেট দূত হিসেবে ফিলিস্তিনে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি হিসেবে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ঝুঁকেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি ফিলিস্তিনিদের অর্থনীতির কিছুটা উন্নতি তখন ঘটিয়েছেন, কিন্তু অভিযোগ আছে, এই উন্নয়নের পেছনে তাঁর ব্যবসায়িক লাভ জড়িত ছিল।

টাইম ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘জেপিমর্গান’ ও পরামর্শক কোম্পানির সঙ্গে এখানে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে। বিশেষ করে, ‘ওয়াতানিয়া চুক্তি’র কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে ব্লেয়ার জড়িত ছিলেন। এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি বা তাঁর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান জেপিমর্গান আর্থিক লাভ করেছেন। কিন্তু এই লাভের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে ইসরায়েলের যুদ্ধ অপরাধের তদন্ত জাতিসংঘে এগিয়ে না নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, ব্যবসায়িক সুবিধার বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচারের দাবি ত্যাগ করতে হয়েছিল।

গাজাবাসীদের কাছে নিশ্চয় এটা মনে হবে নতুন দখলদারির ছক। কারণ, এই বাহিনী ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারলেও ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে কি না সন্দেহ। পাশেই লেবাননে হিজবুল্লাহ দমনের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলার দৃশ্য নিশ্চয় গাজাবাসীর অদেখা নয়।

মূল ঘটনাটি হলো, ওয়াতানিয়া নামে পশ্চিম তীরে একটি ফিলিস্তিনি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির জন্য ব্লেয়ার তখন ইসরায়েলের কাছ থেকে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন; যেন ওয়াতানিয়া দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি মোবাইল অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করতে পারে।

ব্লেয়ার তখন জেপিমর্গানেরও উপদেষ্টা, যে কোম্পানি ওয়াতানিয়ার মূল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু ইসরায়েল ওয়াতানিয়ার জন্য ফ্রিকোয়েন্সি ছাড়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কাছে শর্ত দেয় যে তারা ২০০৮-০৯ সালের ‘অপারেশন কাস্ট লেড’-এর সময় গাজায় সংঘটিত ইসরায়েলের যুদ্ধ অপরাধের তদন্ত জাতিসংঘে স্থগিত রাখবে। ওই অপারেশনে ইসরায়েলি হামলায় বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল।

ভঙ্গুর অর্থনীতি দাঁড় করানো আর টেলিযোগাযোগের সুবিধার কথা বিবেচনা করে নিরুপায় ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচারের দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, যার মধ্যস্থতা করেন টনি ব্লেয়ার। এই চুক্তি থেকে জেপিমর্গান আর্থিকভাবে লাভবান হয়, উপদেষ্টা হিসেবে যেই লাভের ভাগীদার হন ব্লেয়ার নিজে। যদিও ব্লেয়ার দাবি করেন, তিনি ওয়াতানিয়া ও জেপিমর্গানের মধ্যকার সম্পর্কের কথা জানতেন না।

গাজা যুদ্ধ নিয়ে আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

এ ছাড়া ফিন্যান্সিয়াল টাইমস উদ্ঘাটন করেছে যে তাঁর টনি ব্লেয়ার ইনস্টিটিউট ট্রাম্পের ‘রিভিয়েরা’ পরিকল্পনায় জড়িত ছিল, যেখানে ৫ লাখ গাজাবাসীকে সরিয়ে রিসোর্ট ও উৎপাদন এলাকা গড়ার কথা ছিল।

ইরাক যুদ্ধে (২০০৩) ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আক্রমণ করে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছড়িয়েছেন ব্লেয়ার। আফগানিস্তান (২০০১) এবং যুগোস্লাভিয়া (১৯৯৯) যুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত।

নথিতে উল্লেখ রয়েছে যে জিআইটিএ পরিকল্পনা কসোভোতে জাতিসংঘের দেওয়া মডেল থেকে অনুপ্রাণিত। সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সেই মডেল কসোভোতে বিদেশি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে শান্তি এনেছিল বটে, কিন্তু জাতীয় সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিয়েছিল। ব্লেয়ার নিশ্চয় গাজায় সেই পরিকল্পনা প্রয়োগ করে ইরাক যুদ্ধের ক্ষুণ্ন ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চান, যা তাঁর ব্যবসায়িক লাভও নিশ্চিত করবে, আবার ইসরায়েলের নিরাপত্তাও বহাল থাকবে।

কীভাবে শান্তি আসতে পারে গাজায়

সন্দেহ নেই ব্লেয়ারের পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের নিজেদের অধিকার খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সবচেয়ে বড় সংশয়ের জায়গা হলো, আইএসএফ নামে বিদেশি সেনা মোতায়েন, যারা ‘সীমানা রক্ষা ও সন্ত্রাস মোকাবিলা করবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গাজাবাসীদের কাছে নিশ্চয় এটা মনে হবে নতুন দখলদারির ছক। কারণ, এই বাহিনী ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারলেও ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে পারবে কি না সন্দেহ। পাশেই লেবাননে হিজবুল্লাহ দমনের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলার দৃশ্য নিশ্চয় গাজাবাসীর অদেখা নয়।

তা ছাড়া লাভজনক প্রকল্পে জোর দেওয়া হলেও গাজার গরিব মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা উপেক্ষিত হওয়ারও সংশয় রয়েছে। পরিকল্পনায় ত্রাণের দায়িত্ব ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)-কে বাদ দিয়ে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) হাতে হস্তান্তরের কথা বলা হয়েছে, যার হাতে ইতিমধ্যে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে হাজারো ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। ইউএনআরডব্লিউএ ছাড়া আর কোনো সংস্থার ফিলিস্তিনে এত বিপুল কর্মযজ্ঞের অভিজ্ঞতা নেই, সবাই স্বীকার করছেন।

ফলে এই পরিকল্পনা হতে পারে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ছদ্মবেশ। এল-আরিশ থেকে দূরবর্তী শাসন স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকবে, যা অস্থিরতা বাড়াবে। বলা যায় এটা একটা ঔপনিবেশিক ছক—ফিলিস্তিনিদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জাতীয় উদ্যোগের (পিএনআই) মুস্তফা বারগুছি বলেন, ‘ব্রিটিশ উপনিবেশের ক্ষত এখনো তাজা।’ তাঁর মতে, ফলে এই পরিকল্পনা গাজাকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কোনো উন্নতি আনবে না। বরং এটি নতুন সংঘাতের বীজ বপন করবে।

সুতরাং এসব পরিকল্পনা গাজায় শান্তি আনবে না। গাজায় শান্তির জন্য বিদেশি শাসন নয়, বরং দরকার ইসরায়েলের সংশোধন। দরকার ইসরায়েলের ওপর থেকে পশ্চিমা সমর্থন প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব ফিলিস্তিনিদের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার মতো সাহস।

যদি ইসরায়েলের রাজনীতি ও জনমত থেকে ‘চরমপন্থা’ দূর করা না যায়, যদি নেতানিয়াহুর মতো নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো না হয়, যদি গাজার অবরোধ তুলে মানুষ ও পণ্যের অবাধ যাত্রা নিশ্চিত করা না হয়, যদি পশ্চিম তীরের বসতি অপসারণ করা না হয়, যদি সব ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে শুধু গাজায় নয়, শুধু ফিলিস্তিনে নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে কখনো শান্তি আসবে না। বিশ্বের মানুষ কখনো মানবতাবোধ ফিরে পাবে না।

গাজার মানুষ রিসোর্ট বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র চায় না, তারা চায় স্বাধীনতা, সম্মান আর নিরাপত্তা। ব্লেয়ারের পরিকল্পনা তাদের এই স্বপ্নকে পদদলিত করবে। বিশ্বের উচিত গাজাবাসীর আওয়াজ শোনা, তাদের স্বপ্নকে সম্মান করা। শান্তির পথ এখানেই।

  • মনযূরুল হক লেখক ও সাংবাদিক