
গত বছরটি মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর একটি। এ সময়ে একের পর এক সামরিক উত্তেজনা পুরো অঞ্চলকে নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছে।
গাজা থেকে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত সংঘাতগুলো গভীর কৌশলগত উদ্বেগ সামনে এনেছে। একই সঙ্গে যুদ্ধগুলো অস্থির ভূরাজনৈতিক পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট করেছে।
গত বছর পুরো অঞ্চলে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান নাটকীয়ভাবে বিস্তৃত হয়েছে। গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলা ধ্বংসযজ্ঞ নজিরবিহীন মানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে চরম বিভাজন তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি ও হিজবুল্লাহর অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। লেবাননেও একই ধরনের অভিযান ছড়িয়ে পড়েছে। এতে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইয়েমেনে হুতিদের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করার লক্ষ্যে ইসরায়েলি হামলা আরেকটি ফ্রন্ট যুক্ত করেছে। ফলে সংঘাতের মানচিত্র আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গত সেপ্টেম্বর। ওই সময় ইসরায়েল কাতারে হামলা চালায়। কাতার যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি সেখানে অবস্থিত।
হামলার পর ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, দোহায় আলোচনায় থাকা হামাস নেতাদের লক্ষ্য করেই তাঁরা হামলাটি চালিয়েছেন, কিন্তু হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কাতার একে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানায়। আন্তর্জাতিক পরিসরেও ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়।
এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে আবারও ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণার প্রতি সমর্থন জানান।
ইসরায়েলের কট্টর জায়নবাদীদের সমর্থিত এই ধারণা অনুযায়ী দখলকৃত পশ্চিম তীর, গাজা, লেবানন ও জর্ডান গ্রেটার ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও সৌদি আরবের কিছু অংশও ধরা হয়।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একযোগে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ওয়াশিংটন একে ‘সীমিত’ ও প্রতিরোধমূলক অভিযান বলে দাবি করে। কিন্তু ইরানের প্রতিক্রিয়া অনেককেই বিস্মিত করে। ইরান ইসরায়েলের শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইরানি হামলার প্রভাব স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ইসরায়েল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহু ভবন ধ্বংস করেছে।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি পরিকল্পনার আওতায় গাজাকে ফিলিস্তিনি প্রশাসনের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের অধীন দেওয়া হয়। ওই পরিকল্পনার সমর্থকদের মতে, নতুন করে সশস্ত্র তৎপরতা ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত। এতে দখলকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর বাইরের তত্ত্বাবধানকে কার্যত বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
এ পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কের ২০০৭ সালের এক স্বীকারোক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, ২০০১ সালে পেন্টাগন একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। তিনি সেই পরিকল্পনার কথা জেনেছিলেন। সেখানে পাঁচ বছরে সাতটি দেশ আক্রমণের কথা ছিল। প্রথমে ইরাক, এরপর সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং শেষে ইরান।
গত এক বছর দেখিয়ে দিয়েছে একতরফা সিদ্ধান্ত, সামরিক কৌশল ও চরমপন্থী আদর্শ কতটা বিপজ্জনক। জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তাকাঠামো গঠন এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমন্বিত সংলাপ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে সংঘাতের চক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।
ট্রাম্প প্রশাসন ২০২৫ সালের ইরান হামলাকে ‘ঐতিহাসিক সাফল্য’ বললেও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ভয়াবহ। ওয়াশিংটন এখন এমন শক্তির কাতারে পড়েছে, যারা সরাসরি ইরানের ভূখণ্ডে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে চেঙ্গিস খান ও সাদ্দাম হোসেনের মতো নাম। ইরানের সভ্যতাগত স্মৃতি থেকে এ দাগ মুছে যাবে না। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধরে ইরানি জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক নীতিকে প্রভাবিত করবে।
যদি ২০২৬ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি অপরিবর্তিত থাকে, তবে মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধ, অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র এমন এক অঞ্চলে আরও জড়িয়ে পড়বে, যেখান থেকে ইতিমধ্যেই সরে আসার চেষ্টা করেছে প্রতিটি প্রশাসন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৫ সালের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে চিহ্নিত অগ্রাধিকারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম গোলার্ধ, চীন, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। ফলে ইরানে হামলা ছিল অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ের জন্যই একটি কৌশলগত ব্যর্থতা।
যত দিন তেল আবিব গ্রেটার ইসরায়েল ধারণা অনুসরণ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ইরান সামরিক সংঘাত চলবে, তত দিন স্থায়ী শান্তির আশা ক্ষীণ।
ইরান ও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস গভীর। পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কাঠামোও ভঙ্গুর।
এ অবস্থায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নে সক্রিয় হতে হবে। আট দশকের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান ছাড়া কোনো আঞ্চলিক কাঠামো টেকসই হবে না।
দ্বিতীয়ত, ২০২৫ সালের জুনে ইরান হুমকি দেয়, আবার হামলা হলে তারা ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে দেবে। একই বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও ইরান ও লেবাননকে ধ্বংস করার হুমকি দেন। এ পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের প্রভাব ব্যবহার করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারে এবং করা উচিত। এতে সামরিক উত্তেজনা কমানো সম্ভব।
তৃতীয়ত, উপসাগরীয় অঞ্চলের আটটি দেশকে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতা কাঠামোর দিকে এগোতে হবে। এতে বাইরের শক্তির ওপর নির্ভরতা কমবে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ও পূর্বানুমেয় সংলাপ গড়ে উঠবে।
চতুর্থত, ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থাকে শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হতে হবে। এতে তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের দেশগুলো যুক্ত হতে পারে।
সবশেষে ওয়াশিংটন ও তেহরানকে স্থবির কূটনীতি থেকে বেরিয়ে নতুন আলোচনায় ফিরতে হবে। এতে একটি টেকসই পারমাণবিক চুক্তি সম্ভব হতে পারে। একই সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ, সহযোগিতার ক্ষেত্র এবং দীর্ঘদিনের বিরোধগুলো নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে।
গত এক বছর দেখিয়ে দিয়েছে একতরফা সিদ্ধান্ত, সামরিক কৌশল ও চরমপন্থী আদর্শ কতটা বিপজ্জনক। জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়ন, আঞ্চলিক নিরাপত্তাকাঠামো গঠন এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমন্বিত সংলাপ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের পক্ষে সংঘাতের চক্র থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।
সাইয়েদ হোসেইন মুসাভিয়ান প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং রিসার্চ কলাবরেটর ও ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সাবেক প্রধান।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ